ধীরেনদের বাসায়
এই সুন্দর মেয়েটির অসুখে তাহার ভাই-বোন মাতা-পিতা কেহই সেবা করিতে আসিল না। তাহারা কেহ রোগীর সেবা করিতেও জানিত না। কলেরা রোগীকে সেবা করা আরও বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন। এইজন্য বাড়ির লোকেরা রোগিণীর স্পর্শ বাঁচাইয়া দূরে দূরে থাকিতেন। মেয়ের বাবা দিনে তিন-চারবার আসিয়া রোগিণীর খোঁজখবর লইতেন। তিনি ডাক্তারকে বলিতেন, “যত টাকা লাগে আমি দিব। আমার বেলাকে ভালো করিয়া দাও।” মা এ-কাজে ও-কাজে অবসর পাইলেই আসিয়া খবর লইতেন, “আমার বেলা কেমন আছে?” কিন্তু মেয়েকে স্পর্শ করিতেন না। রাত্রে শুইতে যাইবার আগে মেয়ের বিছানার সামনে দাঁড়াইয়া গলায় কাপড় লইয়া বলিতেন, “মা কালী। তোমার সামনে জোড়া-পাঁঠা বলি দিব। আমার বেলাকে ভালো করিয়া দাও।” তারপর বারবার মা কালীকে প্রণাম করিয়া উপরতলায় চলিয়া যাইতেন। আমরা এই জোড়া-পাঁঠা বলি দেওয়ার ব্যাপার লইয়া অনেক হাসি-তামাশা করিতাম। অমিয়দাদা বলিতেন, “মেয়ে ভালো হইয়া উঠিলে মা কালী নিশ্চয়ই এই জোড়া-পাঁঠা পাইবেন না।”
সারারাত জাগিয়া আমরা বেলার দেখাশুনা করিতাম। মাঝে মাঝে তাহার হিক্কা উঠিত। নাড়ি বন্ধ হইয়া যাইত। হাত-পা ঠাণ্ডা হইত। আমরা আগুনে নেকড়া গরম করিয়া তাহার হাত-পা সেঁকিয়া দিতাম। রোগিণীর অবস্থা খুব খারাপ দেখিলে অটল ডাক্তারকে পাশের ঘর হইতে ডাকিয়া আনিতাম। তিনি রোগিণীর জন্য বাড়ির কর্তা কর্তৃক নিয়োজিত হইয়াছিলেন।
এইরূপে চার-পাঁচদিন দারুণ রোগের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করিয়া বেলা ভালো হইয়া উঠিল। অমিয়দার কথাই ঠিক। এতদিনও বোধহয় এ-বাড়ি হইতে কালী-মাতার জোড়া-পাঁঠা পাওয়া মূলতবি আছে।
বেলা সারিয়া গেলে এই বাড়িতে আমি সকলের আরও প্রিয়পাত্র হইয়া পড়িলাম। মা বারবার বলিতেন, “সাধু! তোমার সেবায়ই আমার বেলাকে ফিরিয়া পাইয়াছি।” ইহার পর এই বাড়িতে কাহারও কোনো অসুখ হইলে আমি তাহার সেবার ভার গ্রহণ করিতাম। মা বড়ই শুচিবাইগ্রস্ত মেয়ে ছিলেন। চৌকির এক কোণে আমি বসিয়া আছি। অন্য কোণে তাঁহার এক ছেলে যদি মাকে হঠাৎ ছুঁইয়া দিত তিনি রাগিয়া বলিয়া উঠিতেন, “তুই মুচি মোছলমান ছুঁইয়া আমার গায়ে হাত দিলি। এখনই আমাকে স্নান করিতে হইবে।” এই কথা শুনিয়া আমার বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করিয়া উঠিত। মানুষকে মানুষ এমনভাবে অপমান করিতে পারে। একবার মাঘ মাসে রাত দশটার সময় তাঁহার একটি ছেলে এইভাবে তাঁকে ছুঁইয়া দিল।
তিনি তাহাকে নানাভাবে গাল পাড়িতে পাড়িতে সেই শীতের রাত্রে স্নান করিয়া আসিলেন। লজ্জায় অপমানে আমি মরমে মরিয়া গেলাম। একবার মনে হইল, এখনই বইপত্র লইয়া এখান হইতে চলিয়া যাই। কিন্তু চলিয়া যাইব কোথায়? পদ্মায় আমাদের বাড়ি ভাঙিয়াছে। অপরের বাড়ির একখানা মাত্র ঘরে আমার মা-বাবা ভাই-বোনেরা কোনোরকমে জড়সড় হইয়া থাকেন। সেখানে পড়িব কোথায় বসিয়া? এই বাড়িতে সভ্যতা, কৃষ্টি। এখানে থাকিলে পড়াশুনা ভালো হয়। লেখাপড়া শিখিয়া আমি বড় হইব। দেশ-জোড়া নামকরা কবি হইব। এই অপমানের অগ্নি-দাহনে পুড়িয়া আমি জীবনকে উজ্জ্বল করিয়া তুলিব। মনে মনে মহৎ লোকদের নাম জপ করি। প্রথম-জীবনে আমার চাইতেও কত অপমান তাঁহাদের সহ্য করিতে হইয়াছে।
চলবে…