সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে
- সবুজ কারখানা, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন, ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে হবে
- উচ্চমূল্যের পণ্য, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ, নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ জোরদার করা প্রয়োজন
- নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার, বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর, সুশাসন নিশ্চিতকরণ ও কর্মশক্তির উন্নয়নের মাধ্যমে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব
বাংলাদেশ তার পোশাক রফতানিতে বৈশ্বিক নেতা হিসেবে অবস্থান আরও সুদৃঢ় করতে চায়। কিন্তু সম্প্রতি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) পূর্বে ঘোষিত প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানিকে সংশোধন করে প্রায় ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে এনেছে। ফলে সংশোধিত তথ্যের আলোকে রফতানির লক্ষ্যও পুনর্নির্ধারণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে শিল্পের অংশীজনরা দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবসম্মত এবং অর্জনযোগ্য একটি লক্ষ্য নির্ধারণের ওপর জোর দিচ্ছেন।
বৈচিত্র্যকরণ ও প্রযুক্তিগত অগ্রযাত্রা
- উচ্চমূল্যের পণ্য: অ্যাকটিভওয়্যার ও টেকনিক্যাল টেক্সটাইলের মতো উচ্চমূল্যের পণ্য রফতানিতে জোর দেওয়া দরকার।
- প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ: অটোমেশন ও আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন ইআরপি সিস্টেম) ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদন খরচ কমানো এবং দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব।
- নতুন বাজার অনুসন্ধান: মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো অনাবিষ্কৃত বাজারগুলোতেও প্রবেশাধিকার বৃদ্ধির মাধ্যমে রফতানি সম্প্রসারণ করা যেতে পারে।
- ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ জোরদার: একটি শক্তিশালী সাপ্লাই চেইন তৈরি করলে আমদানির ওপর নির্ভরতা কমবে এবং প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়বে।
টেকসই উন্নয়ন ও বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং
- সবুজ কারখানা ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ: দেশে ইতোমধ্যে ২৩৭টির বেশি সবুজ কারখানা রয়েছে। বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে এসব সাফল্য আরও প্রচার করতে হবে।
- পরিবেশগত টেকসই উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে ব্র্যান্ডিং: বাংলাদেশের কারখানাগুলোকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার কৌশল প্রয়োজন।
- সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রধান বাজারগুলোয় দেশের টেকসই কার্যক্রম প্রচারে সরকারি পর্যায়ের কার্যক্রম জোরদার করা দরকার।
ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ ও শ্রমিক কল্যাণ
- ন্যায্যমূল্য বা এথিক্যাল প্রাইসিং: ক্রেতারা যে মূল্য প্রদান করবে, তা যাতে শ্রমিকের সুরক্ষা, আবাসন ও কল্যাণমূলক খরচ নিশ্চিত করে।
- শ্রমিকদের কল্যাণ: ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ আবাসন এবং স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা শিল্পের স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
রফতানির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চ্যালেঞ্জ
- জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট: গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা, পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় শিল্পে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।
- শ্রম ঘাটতি: কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে শ্রমিক স্বল্পতা ও কর্মশক্তির গতিশীলতার পরিবর্তন শিল্পকে চাপে ফেলেছে।
- অতিরিক্ত বিনিয়োগ ও ওভার ক্যাপাসিটি: নতুন বিনিয়োগের ফলে অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ও আর্থিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।
- এলডিসি থেকে উত্তরণ: স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সুবিধা হারানোর ফলে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কমে যেতে পারে, যার কারণে রফতানি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমার আশঙ্কা আছে।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও বাণিজ্য চুক্তি
- বাণিজ্য চুক্তি: এলডিসি–উত্তর সময়ে প্রতিযোগিতামূলক হতে নতুন বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর অপরিহার্য।
- উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি: আধুনিক প্রযুক্তি, দক্ষতা ও উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো দরকার।
- সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি খরচ কমানো ও শিল্পের পরিবেশবান্ধব ভাবমূর্তি গড়তে সহায়ক।
সস্তা শ্রম থেকে টেকসই ভ্যালু-চেইনে রূপান্তর
- উদ্ভাবন ও মান: শিল্পকে কেবল সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর না করে উদ্ভাবন, মান, টেকসই উৎপাদন ইত্যাদিতে মনোযোগী হতে হবে।
- শক্তিশালী ভৌত অবকাঠামো: নির্ভরযোগ্য জ্বালানি, উন্নত লজিস্টিকস ও ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।
সুশাসন, নীতি সহায়তা ও ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ
- রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও স্বচ্ছতা: ব্যাংক, শুল্ক ও করব্যবস্থায় সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ব্যবসার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বজায় থাকে।
- আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা: উৎপাদন, শ্রম ও পরিবেশগত মানদণ্ড মেনে চললে বৈশ্বিক ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের আস্থা বাড়বে।
কর্মশক্তির উন্নয়ন
- দক্ষতা বৃদ্ধি: ভাষাগত, যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত দক্ষতায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু রেখে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
- শ্রমিক কল্যাণ: নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও ব্যবস্থাপনা-ট্রেড ইউনিয়ন সহযোগিতামূলক সম্পর্ক টেকসই প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
সারসংক্ষেপ
বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকে শক্তিশালী করতে প্রস্তুতকারক, ক্রেতা ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, শ্রমিকদের কল্যাণ, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হলে শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য সম্ভব। সুশাসন, দক্ষ কর্মশক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সহজ হবে বলে আশা করা যায়।