সারাক্ষণ রিপোর্ট
সনক্রান উৎসব ও গরমের দাপট
প্রতি বছর এপ্রিল মাসে থাইল্যান্ডে উদযাপিত হয় বৌদ্ধ নববর্ষ সনক্রান, আর সেই সময় দেশের তাপমাত্রা থাকে প্রচণ্ড। নীল আকাশ আর আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে স্বস্তি এনে দেয় পানি-যুদ্ধ কিংবা ঐতিহ্যবাহী ঠান্ডা খাবার—‘খাও চ্যে’। এটি একটি ঠান্ডা চালের খাবার, যা ফুলের সুবাসযুক্ত পানিতে ভিজিয়ে পরিবেশন করা হয়।
‘খাও চ্যে’-এর ঐতিহাসিক পটভূমি
খাও চ্যে-র ইতিহাস শত শত বছর পুরোনো। এটি মূলত মন জাতিগোষ্ঠীর রীতির অংশ ছিল, যারা ১৬শ শতকে থাইল্যান্ডের (তৎকালীন সিয়াম) সমাজে একীভূত হয়। প্রথমদিকে এটি ছিল সাধারণ ভাতের পোরিজ, যা ঠান্ডা রাখতে মাটির হাঁড়িতে পরিবেশন করা হতো।
পরবর্তীতে, রাজা রামা চতুর্থের আমলে এটি রাজপরিবারের খাবারে রূপ নেয়। তখন এতে ফুলের পাপড়ি দিয়ে সৌন্দর্য ও গন্ধ যোগ করা হয় এবং বরফ ব্যবহার শুরু হয়—যা সাধারণ মানুষের জন্য তখন বিলাসবহুল।
রান্নার পদ্ধতি ও ফুলের সুবাস
খাও চ্যে তৈরির প্রথম ধাপ হল জ্যামিন চাল ধুয়ে সমস্ত স্টার্চ দূর করা। এরপর সেটি সেদ্ধ করে বরফের ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। এই পানিকে সৌরভ দিতে ব্যবহার করা হয় জ্যামিন, ইল্যাং ইল্যাং, রজনীগন্ধা ও অন্য ফুল। কখন কোন ফুল ফুটবে, তা নিয়েও থাকে সূচনামূলক পরিকল্পনা। ফুলগুলো পানিতে ভিজিয়ে সুবাসিত করার সময়সীমাও গুরুত্বপূর্ণ—না হলে পানি তেতো বা মৃদু গন্ধহীন হয়ে পড়ে। কিছু ক্ষেত্রে থাই সুগন্ধি মোমবাতি (তিয়ান অপ) জ্বালিয়ে পানিতে ধোঁয়া দেওয়া হয় বাড়তি গন্ধের জন্য।
সুস্বাদু সঙ্গী পদ ও খাওয়ার নিয়ম
খাও চ্যে শুধু চাল নয়, এটি একাধিক ঝাল, মিষ্টি, ঝাল-মিষ্টি ও মাছঘেঁষা খাবারের সমন্বয়। এর সাথে থাকে:
খাওয়ার সময় একসাথে সব কিছু চালের সাথে না মেশানোর পরামর্শ দেন রন্ধনবিশারদরা। বরং চাল ও আলাদা আলাদা সাইড ডিশ একে একে খেলে ফুলের সুবাসযুক্ত পানির স্বচ্ছতা বজায় থাকে।
আধুনিক পুনরুজ্জীবন ও জনপ্রিয়তা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাও চ্যে নতুন করে জনপ্রিয় হয়েছে, বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে এর চিত্রশোভিত পরিবেশনা ছড়িয়ে পড়েছে। আগের দিনে এটি ছিল অভিজাত শ্রেণির সীমিত খাবার, কিন্তু এখন অনেক রেস্তোরাঁ ও হোম কুকরাও এটি পরিবেশন করছেন। থাই সমাজ আবারও তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকে ফিরে যাচ্ছে।
‘খাও চ্যে’-র সহজ রেসিপি (৮ জনের জন্য)
উপকরণ (চাল ও ফুলের পানি):
চিংড়ি পেস্ট বলের উপকরণ:
ভরা মরিচের উপকরণ:
প্রস্তুত প্রণালি সংক্ষেপে: ১. চাল ধুয়ে আধা সেদ্ধ করে বারবার ধুয়ে পরিষ্কার করে নিন, তারপর ভাপে সিদ্ধ করুন। ঠান্ডা করুন।
২. চিংড়ি বল তৈরির উপকরণ মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে রান্না করুন ও বল বানিয়ে ডিমে ডুবিয়ে ভাজুন।
৩. ভরা মরিচের জন্য মিশ্রণ তৈরি করে মরিচে ভরুন ও ভাপে রান্না করুন।
৪. ডিম জাল তৈরি করে তাতে মরিচ মুড়িয়ে পরিবেশন করুন।
৫. ফুলের সুবাসযুক্ত ঠান্ডা পানি চালের উপর ঢেলে পরিবেশন করুন।
নোট: ফুলের সুবাসিত পানি তৈরি করতে জ্যামিন, ইল্যাং ইল্যাং ও চম্মানাদ ফুল পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং চাইলে থাই মোমবাতি দিয়ে ধোঁয়া দিন।
উপসংহার
খাও চ্যে শুধু একটি খাবার নয়, এটি থাই সংস্কৃতির গর্ব ও ঐতিহ্যের নিদর্শন। উৎসব, গরম, ও ঐতিহ্যের মিলনে গঠিত এই অনন্য ডিশ আজ সবার নাগালে—রাজপ্রাসাদের দেয়াল পেরিয়ে সাধারণ মানুষের টেবিলে পৌঁছে গেছে।
Leave a Reply