০৫:১৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

রুই কাতলা ইলিশ চিতল সহ ৭১ রকমের মাছে ভরা ছিলো বুড়িগঙ্গা

একটি ভোরের ছবিষাটের দশক

ঢাকার কো ঝুপড়ি‑ঘেরা সদরঘাটে তখনও ইঞ্জিনচালিত লঞ্চের কোলাহল নেই। মেঘলা ভোরে নৌকায় বসে জাল ছুড়ে দিচ্ছেন জেলে খলিল মিয়া—আজ তাঁর বয়স বিরানব্বই, কিন্তু সেই দিনগুলোর কথা তুললেই চোখ চকচক করে ওঠে। “এক টান মারতাম, কাতলা‑ইলিশে জাল ভরে যেত; পানি ছিল কাঁচা গঙ্গাজল,” স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। ১৯৫৫‑৬৫ সালের মাঝামাঝি বুড়িগঙ্গা ছিল ঢাকার মৎস্যভাণ্ডার, যার স্বচ্ছ পানির ঝলকে একসময় ৭১টি দেশি প্রজাতি ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াত।

আলী লুৎফর ভুইয়ার তালিকা

১৯৬৪‑এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ আলী লুৎফর ভুইয়া তাঁর “Fishes of Dacca” জরিপে বুড়িগঙ্গা‑কেন্দ্রিক ২৫টি পরিবারের ৭১টি স্বাদুপানি মাছ নথিবদ্ধ করেন। বড় কার্প (কাতলা, রুই, মৃগেল), রাজকীয় চিতল‑ফলই, ছিপে উঠত এমন বোয়াল‑বাগাড়, আর বর্ষাকাল এলেই জোয়ার বেয়ে ঢুকত রুপালি ইলিশ। পুঁটি‑সরপুঁটি‑চাপিলার ঝাঁক, শোল‑টাকি‑কৈয়ের দল, শিং‑মাগুর‑গুলশা—নদীর প্রতিটি খাঁড়ি যেন এক‑একটি ছোটো জৈব আশ্রয়কেন্দ্র।

কেন বুকভরা মাছ ছিল?

  • স্বচ্ছ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ পানি—শিল্পবর্জ্য তখনও দূষণের মাত্রা পেরোয়নি।
  • প্রবল বর্ষার প্লাবন—গঙ্গা‑পদ্মা‑ধলেশ্বরীর ধারা বুড়িগঙ্গায় ঢুকে বিশাল প্লাবনভূমি বানাত, যা প্রাকৃতিক নার্সারি হয়ে ওঠে।
  • অবাধ প্রবাহ—ড্রেজিং বা নদী নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছিল না; মাছের চলাচলে বাধা পড়েনি।
  • স্থানীয় বাজার‑নির্ভর আহরণ—শীতলক্ষ্যা বা তুরাগ থেকে নৌকায় করে মাছ আসত ঢাকার হাটে, রপ্তানি‑চাপ প্রায় ছিল না।

ধূসর আজকের নদী

শীতকালের রোদে আজ বুড়িগঙ্গা কালচে; পানিতে ভেসে থাকে প্লাস্টিক আর ট্যানারি‑বর্জ্য। ২০১৩‑এর সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ জরিপ জানায়, প্রজাতি নেমে এসেছে ৫৬‑এ—দু’দশকে অন্তত ২১ শতাংশ কমে যাওয়া। বড় বোয়াল বা বাটা রুই এখন চোখে পড়ে না; ইলিশ নদীমুখেই মারা পড়ছে নৌযানের তেলের দুষণে। জলে মিশ্রিত অক্সিজেনের মাত্রা কখনও‑সখনও শূন্যের কাছাকাছি।

৮২‑বছরের জেলে খলিল মিয়া আক্ষেপ করেন, “এখন জাল ফেলে খালি পলিথিন ওঠে।” তাঁর ছেলে শহিদুল দু‑বেলা ট্রলার চালিয়ে খুচরো যাত্রী টানেন—মাছ ধরা আর পেট চালায় না।

এখনও আশার আলো

  • শিল্পবর্জ্য শোধনাগার সম্পূর্ণ চালু করে দূষণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
  • মে‑আগস্ট প্রজনন মৌসুমে বুড়িগঙ্গায় নো‑ফিশিং জোন ঘোষণা জরুরি।
  • ধলেশ্বরী‑তুরাগ‑বুড়িগঙ্গা সংযোগে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরাতে ড্রেজিং‑নিয়ন্ত্রিত নদী‑শাসন প্রয়োজন।
  • জেলে‑সমিতিকে বিকল্প আয় ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দিলে অতিরিক্ত নিধন কমবে।
  • নিয়মিত জৈব সমীক্ষা আর স্কুল‑কলেজের নদী‑পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে পারে।

কাতলা‑চিতল‑ইলিশের বুড়িগঙ্গা এখন স্মৃতিচিহ্ন মাত্র, কিন্তু স্মৃতি মানেই শেষ নয়। নদী যেমন করোনার সময়ে স্ব‑শুদ্ধ হতে পেরেছিল, মানুষ চাইলে পরিকল্পিত উদ্যোগে আবার প্রাণ ফেরাতে পারে। গণদাবি, নীতি‑সমর্থন আর সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ—এই তিন হাত ধরলে বুড়িগঙ্গার কালো জল একদিন হয়তো আবার চিরচেনা সবুজে ফিরবে, আর খলিল মিয়ার নাতি‑পুতি তার ভোরে জাল ছুঁড়ে কাটলা ভরা হাসি নিয়ে ঘরে ফিরবে।

রুই কাতলা ইলিশ চিতল সহ ৭১ রকমের মাছে ভরা ছিলো বুড়িগঙ্গা

০৬:৩০:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ মে ২০২৫

একটি ভোরের ছবিষাটের দশক

ঢাকার কো ঝুপড়ি‑ঘেরা সদরঘাটে তখনও ইঞ্জিনচালিত লঞ্চের কোলাহল নেই। মেঘলা ভোরে নৌকায় বসে জাল ছুড়ে দিচ্ছেন জেলে খলিল মিয়া—আজ তাঁর বয়স বিরানব্বই, কিন্তু সেই দিনগুলোর কথা তুললেই চোখ চকচক করে ওঠে। “এক টান মারতাম, কাতলা‑ইলিশে জাল ভরে যেত; পানি ছিল কাঁচা গঙ্গাজল,” স্মৃতিচারণ করলেন তিনি। ১৯৫৫‑৬৫ সালের মাঝামাঝি বুড়িগঙ্গা ছিল ঢাকার মৎস্যভাণ্ডার, যার স্বচ্ছ পানির ঝলকে একসময় ৭১টি দেশি প্রজাতি ঝাঁক বেঁধে ঘুরে বেড়াত।

আলী লুৎফর ভুইয়ার তালিকা

১৯৬৪‑এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ আলী লুৎফর ভুইয়া তাঁর “Fishes of Dacca” জরিপে বুড়িগঙ্গা‑কেন্দ্রিক ২৫টি পরিবারের ৭১টি স্বাদুপানি মাছ নথিবদ্ধ করেন। বড় কার্প (কাতলা, রুই, মৃগেল), রাজকীয় চিতল‑ফলই, ছিপে উঠত এমন বোয়াল‑বাগাড়, আর বর্ষাকাল এলেই জোয়ার বেয়ে ঢুকত রুপালি ইলিশ। পুঁটি‑সরপুঁটি‑চাপিলার ঝাঁক, শোল‑টাকি‑কৈয়ের দল, শিং‑মাগুর‑গুলশা—নদীর প্রতিটি খাঁড়ি যেন এক‑একটি ছোটো জৈব আশ্রয়কেন্দ্র।

কেন বুকভরা মাছ ছিল?

  • স্বচ্ছ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ পানি—শিল্পবর্জ্য তখনও দূষণের মাত্রা পেরোয়নি।
  • প্রবল বর্ষার প্লাবন—গঙ্গা‑পদ্মা‑ধলেশ্বরীর ধারা বুড়িগঙ্গায় ঢুকে বিশাল প্লাবনভূমি বানাত, যা প্রাকৃতিক নার্সারি হয়ে ওঠে।
  • অবাধ প্রবাহ—ড্রেজিং বা নদী নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ছিল না; মাছের চলাচলে বাধা পড়েনি।
  • স্থানীয় বাজার‑নির্ভর আহরণ—শীতলক্ষ্যা বা তুরাগ থেকে নৌকায় করে মাছ আসত ঢাকার হাটে, রপ্তানি‑চাপ প্রায় ছিল না।

ধূসর আজকের নদী

শীতকালের রোদে আজ বুড়িগঙ্গা কালচে; পানিতে ভেসে থাকে প্লাস্টিক আর ট্যানারি‑বর্জ্য। ২০১৩‑এর সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ জরিপ জানায়, প্রজাতি নেমে এসেছে ৫৬‑এ—দু’দশকে অন্তত ২১ শতাংশ কমে যাওয়া। বড় বোয়াল বা বাটা রুই এখন চোখে পড়ে না; ইলিশ নদীমুখেই মারা পড়ছে নৌযানের তেলের দুষণে। জলে মিশ্রিত অক্সিজেনের মাত্রা কখনও‑সখনও শূন্যের কাছাকাছি।

৮২‑বছরের জেলে খলিল মিয়া আক্ষেপ করেন, “এখন জাল ফেলে খালি পলিথিন ওঠে।” তাঁর ছেলে শহিদুল দু‑বেলা ট্রলার চালিয়ে খুচরো যাত্রী টানেন—মাছ ধরা আর পেট চালায় না।

এখনও আশার আলো

  • শিল্পবর্জ্য শোধনাগার সম্পূর্ণ চালু করে দূষণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
  • মে‑আগস্ট প্রজনন মৌসুমে বুড়িগঙ্গায় নো‑ফিশিং জোন ঘোষণা জরুরি।
  • ধলেশ্বরী‑তুরাগ‑বুড়িগঙ্গা সংযোগে স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরাতে ড্রেজিং‑নিয়ন্ত্রিত নদী‑শাসন প্রয়োজন।
  • জেলে‑সমিতিকে বিকল্প আয় ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা দিলে অতিরিক্ত নিধন কমবে।
  • নিয়মিত জৈব সমীক্ষা আর স্কুল‑কলেজের নদী‑পর্যবেক্ষণ কর্মসূচি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করতে পারে।

কাতলা‑চিতল‑ইলিশের বুড়িগঙ্গা এখন স্মৃতিচিহ্ন মাত্র, কিন্তু স্মৃতি মানেই শেষ নয়। নদী যেমন করোনার সময়ে স্ব‑শুদ্ধ হতে পেরেছিল, মানুষ চাইলে পরিকল্পিত উদ্যোগে আবার প্রাণ ফেরাতে পারে। গণদাবি, নীতি‑সমর্থন আর সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ—এই তিন হাত ধরলে বুড়িগঙ্গার কালো জল একদিন হয়তো আবার চিরচেনা সবুজে ফিরবে, আর খলিল মিয়ার নাতি‑পুতি তার ভোরে জাল ছুঁড়ে কাটলা ভরা হাসি নিয়ে ঘরে ফিরবে।