০১:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

জনপ্রিয়তা, শাসন ও দম্ভ

জনপ্রিয়তা রাজনীতির একটি তাৎক্ষণিক উপাদান, যা সাধারণত নেতৃত্বের আদর্শ, ত্যাগ এবং এক ধরনের কারিসমার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, একজন নেতার জনপ্রিয়তা যত দ্রুত গড়ে ওঠে, তার পতনও তত দ্রুত ও করুণ হয়, যদি ক্ষমতার প্রয়োগে নৈতিকতা, সংবেদনশীলতা ও জনসম্পৃক্ততা না থাকে। এমন অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা আন্দোলনের নেতা হিসেবে ছিলেন প্রেরণার প্রতীক, কিন্তু শাসক হয়ে উঠেই তারা হয়ে গেছেন জনবিচ্ছিন্ন, অমানবিক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ব্যতিক্রমী নেতা পাওয়া তাই দুষ্কর, যিনি ক্ষমতা পেয়েও নিজের অবস্থানকে চিরস্থায়ী করার চিন্তা করেননি, বরং সময়মতো বিদায় নিয়ে ইতিহাসে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এই বিচ্যুতির দৃষ্টান্ত প্রচুর। হুগো শাভেজ ভেনেজুয়েলায় ছিলেন বামপন্থী গণমানুষের নেতা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। প্রথমদিকে তাঁর অনেক নীতি জনগণের মধ্যে আশাবাদের জন্ম দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিরোধীদল দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পথে হাঁটার কারণে তাঁর শাসনকাল এক প্রকার আধা-স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নেয়। তাঁর উত্তরসূরি মাদুরো পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যান। জনপ্রিয়তা যার ভিত্তি ছিল গণমানুষের দুর্ভোগ দূরীকরণ, শেষ পর্যন্ত তা পরিণত হয় খাদ্য সংকট, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের এক করুণ অধ্যায়ে।
রবার্ট মুগাবে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক ছিলেন। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসনীয়। কিন্তু ৩৭ বছরের শাসনকালে তিনি এমন একনায়কত্ব কায়েম করেন, যেখানে গণতন্ত্রের স্থান হয় ক্ষীয়মান এবং দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। কৃষি সংস্কারের নামে শ্বেতাঙ্গ খামারিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে তিনি জনগণের মনে প্রথমে গর্বের সঞ্চার করলেও, খাদ্য উৎপাদনের অভাবে পরিস্থিতি দুঃসহ হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়—একজন মহান মুক্তিযোদ্ধার বিদায় ঘটে লাঞ্ছিতভাবে।

বাঙালির রাজনীতির ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক, যাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে পূর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র গঠনের জটিলতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং রাজনীতির অস্থিরতা তাঁকে বাধ্য করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করতে। অনেক গবেষক একে স্বেচ্ছাচার বলে সমালোচনা করলেও, কেউ কেউ মনে করেন এটি ছিল রাষ্ট্র রক্ষার জরুরি পদক্ষেপ। তারপরও বাস্তবতা হলো, গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি তাঁকে বিতর্কিত করে তোলে এবং তাঁর জীবন শেষ হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে। ইতিহাস তাঁকে শ্রদ্ধার আসন দিয়েও প্রশ্ন তুলবে তাঁর শাসনকাল নিয়ে। এ যেন ‘মহান নেতা’ এবং ‘সমালোচিত শাসক’-এর দ্বৈত ভূমিকার এক জটিল পাঠ।
ভারতের ইন্দিরা গান্ধীও একাধিকবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা জারি করে তিনি সংবিধান, গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করেন। স্বজনপোষণ, দমননীতি এবং আধিপত্যবাদী রাজনীতির অভিযোগে তিনি হারান জনসমর্থন। যদিও ১৯৮০ সালের নির্বাচনে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন, কিন্তু ১৯৮৪ সালে শিখ দাঙ্গা এবং অপারেশন ব্লু স্টারের প্রেক্ষিতে তাঁর জীবন শেষ হয় আততায়ীর হাতে। একসময়ের ‘ইন্ডিয়ার আয়রন লেডি’ হয়ে ওঠেন দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তিত্ব।
নেপালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা কিংবা পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোও একই পরিণতির শিকার। তাঁদের রাজনৈতিক সংগ্রাম মহৎ হলেও ক্ষমতা পাওয়ার পর তাঁরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হন। দুর্নীতি, দলীয়করণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয়। বেনজিরের ক্ষেত্রে চরম পরিণতি ঘটে এক আত্মঘাতী হামলায়।

পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টান্তগুলোও এই সমস্যার বাইরে নয়। পুতিন রাশিয়ায় জাতীয় গর্ব ফিরিয়ে আনেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস করে তাঁর শাসন একচ্ছত্রতন্ত্রে রূপ নেয়। ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে বিশ্বরাজনীতিতে একঘরে করে ফেলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ‘আউটসাইডার’ রাজনীতির একটি প্রবণতা সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর শাসনকাল বিভাজন, সত্য বিকৃতি এবং গণতন্ত্রবিরোধী আচরণে চিহ্নিত হয়। ক্যাপিটল হিল হামলার মাধ্যমে তাঁর শাসনের অবসান ঘটে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে। একইভাবে মিয়ানমারের অং সান সু চি, যিনি ছিলেন শান্তির প্রতীক, রোহিঙ্গা নিপীড়নের সময় নীরব থেকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাস হারান।
নেতৃত্বের বিবর্তন অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট ধাপে এসে পথ হারায়। আদর্শ থেকে যাত্রা শুরু করে ক্ষমতার মোহে পড়ে তা হয়ে ওঠে শাসনকেন্দ্রিক এবং একসময় নিয়ন্ত্রণমুখী। এই নিয়ন্ত্রণ যখন যুক্তির বদলে ভয় ও বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়ায়, তখনই নেতার চারপাশে ‘হ্যাঁ-মানুষে’ ভরা এক বলয় গড়ে ওঠে। এই বলয় তাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার শেষের দিনগুলো হয়ে পড়ে অসম্মানজনক।
এই বিচ্যুতি থেকে যে কজন নেতা নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যতম। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তিনি ক্ষমতায় এসেও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি করেননি। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মাধ্যমে তিনি অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একতাবদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার চেষ্টা করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেননি, বরং সময়মতো বিদায় নিয়েছেন। ক্ষমতা ত্যাগের এই নৈতিক অবস্থান তাঁকে ইতিহাসে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা এই আলোচনার বাইরে নয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের বদলে দেখা যায় পালাবদলের রাজনীতি।

সরকারপ্রধানরা ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদলের প্রতি সহনশীলতা হারিয়ে ফেলেন। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়া এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল কন্ট্রোল’-এর আওতায় পড়ে যায়। বিরোধী মতকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত করে। ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলয়ে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা বাড়ছে, আর বিরোধীদের সাংবিধানিক জায়গা সীমিত হচ্ছে। পাকিস্তানে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বও প্রমাণ করে, জনপ্রিয়তা থাকলেই সুশাসন নিশ্চিত হয় না।
এই সব দৃষ্টান্ত একটিই শিক্ষা দেয়—জনপ্রিয়তা এক সময় শেষ হয়, কিন্তু নৈতিকতা এবং সুশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়। একজন প্রকৃত নেতা নিজেকে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের চেয়ে বড় ভাবেন না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য থাকে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের নিয়মতান্ত্রিকতায়, বিরোধী মতের প্রতি সহনশীলতায় এবং জনগণের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সক্ষমতায়। যারা ক্ষমতাকে ‘অধিকার’ নয়, ‘দায়িত্ব’ হিসেবে দেখেন, তারাই ভবিষ্যতে নেতৃত্বের মানদণ্ড স্থাপন করেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বের দর্শন ছিল অনেকটা এমন : নমনীয়, পেছন থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং অন্যকে সামনে যেতে দেওয়া।
আজকাল এমন নেতা পাওয়া কঠিন যিনি নিজে পেছনে থেকে অন্যকে সামনে এগিয়ে দিতে ভূমিকা রাখবেন। এখন ক্ষমতা এবং দম্ভ একাকার হয়ে গেছে। বিনয় এখন দুর্বলতা বলে মনে হয়। তাই আজকের পৃথিবী এমন নেতার অপেক্ষায় আছে, যিনি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও ক্ষমতার মোহে নিজেকে হারাবেন না, বরং প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে যাবেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

জনপ্রিয়তা, শাসন ও দম্ভ

০৮:০০:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৩১ মে ২০২৫

জনপ্রিয়তা রাজনীতির একটি তাৎক্ষণিক উপাদান, যা সাধারণত নেতৃত্বের আদর্শ, ত্যাগ এবং এক ধরনের কারিসমার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। কিন্তু ইতিহাসে বহুবার দেখা গেছে, একজন নেতার জনপ্রিয়তা যত দ্রুত গড়ে ওঠে, তার পতনও তত দ্রুত ও করুণ হয়, যদি ক্ষমতার প্রয়োগে নৈতিকতা, সংবেদনশীলতা ও জনসম্পৃক্ততা না থাকে। এমন অনেক নেতাকে দেখা গেছে, যারা আন্দোলনের নেতা হিসেবে ছিলেন প্রেরণার প্রতীক, কিন্তু শাসক হয়ে উঠেই তারা হয়ে গেছেন জনবিচ্ছিন্ন, অমানবিক ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। নেলসন ম্যান্ডেলার মতো ব্যতিক্রমী নেতা পাওয়া তাই দুষ্কর, যিনি ক্ষমতা পেয়েও নিজের অবস্থানকে চিরস্থায়ী করার চিন্তা করেননি, বরং সময়মতো বিদায় নিয়ে ইতিহাসে নিজের স্থান অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এই বিচ্যুতির দৃষ্টান্ত প্রচুর। হুগো শাভেজ ভেনেজুয়েলায় ছিলেন বামপন্থী গণমানুষের নেতা, দারিদ্র্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার। প্রথমদিকে তাঁর অনেক নীতি জনগণের মধ্যে আশাবাদের জন্ম দেয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিরোধীদল দমন, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পথে হাঁটার কারণে তাঁর শাসনকাল এক প্রকার আধা-স্বৈরতান্ত্রিক রূপ নেয়। তাঁর উত্তরসূরি মাদুরো পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে যান। জনপ্রিয়তা যার ভিত্তি ছিল গণমানুষের দুর্ভোগ দূরীকরণ, শেষ পর্যন্ত তা পরিণত হয় খাদ্য সংকট, রাজনৈতিক নিপীড়ন এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের এক করুণ অধ্যায়ে।
রবার্ট মুগাবে জিম্বাবুয়ের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক ছিলেন। বর্ণবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসনীয়। কিন্তু ৩৭ বছরের শাসনকালে তিনি এমন একনায়কত্ব কায়েম করেন, যেখানে গণতন্ত্রের স্থান হয় ক্ষীয়মান এবং দেশের অর্থনীতি হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। কৃষি সংস্কারের নামে শ্বেতাঙ্গ খামারিদের উচ্ছেদের মাধ্যমে তিনি জনগণের মনে প্রথমে গর্বের সঞ্চার করলেও, খাদ্য উৎপাদনের অভাবে পরিস্থিতি দুঃসহ হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়—একজন মহান মুক্তিযোদ্ধার বিদায় ঘটে লাঞ্ছিতভাবে।

বাঙালির রাজনীতির ইতিহাসও এর ব্যতিক্রম নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপসহীন নেতৃত্বের প্রতীক, যাঁর জীবন ছিল সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে পূর্ণ। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাষ্ট্র গঠনের জটিলতা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং রাজনীতির অস্থিরতা তাঁকে বাধ্য করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা গ্রহণ করতে। অনেক গবেষক একে স্বেচ্ছাচার বলে সমালোচনা করলেও, কেউ কেউ মনে করেন এটি ছিল রাষ্ট্র রক্ষার জরুরি পদক্ষেপ। তারপরও বাস্তবতা হলো, গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি তাঁকে বিতর্কিত করে তোলে এবং তাঁর জীবন শেষ হয় এক নির্মম হত্যাকাণ্ডে। ইতিহাস তাঁকে শ্রদ্ধার আসন দিয়েও প্রশ্ন তুলবে তাঁর শাসনকাল নিয়ে। এ যেন ‘মহান নেতা’ এবং ‘সমালোচিত শাসক’-এর দ্বৈত ভূমিকার এক জটিল পাঠ।
ভারতের ইন্দিরা গান্ধীও একাধিকবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা জারি করে তিনি সংবিধান, গণমাধ্যম এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করেন। স্বজনপোষণ, দমননীতি এবং আধিপত্যবাদী রাজনীতির অভিযোগে তিনি হারান জনসমর্থন। যদিও ১৯৮০ সালের নির্বাচনে তিনি আবার ক্ষমতায় ফেরেন, কিন্তু ১৯৮৪ সালে শিখ দাঙ্গা এবং অপারেশন ব্লু স্টারের প্রেক্ষিতে তাঁর জীবন শেষ হয় আততায়ীর হাতে। একসময়ের ‘ইন্ডিয়ার আয়রন লেডি’ হয়ে ওঠেন দ্বিধাবিভক্ত ব্যক্তিত্ব।
নেপালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা কিংবা পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টোও একই পরিণতির শিকার। তাঁদের রাজনৈতিক সংগ্রাম মহৎ হলেও ক্ষমতা পাওয়ার পর তাঁরা জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হন। দুর্নীতি, দলীয়করণ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা তাঁদের ভাবমূর্তি নষ্ট করে দেয়। বেনজিরের ক্ষেত্রে চরম পরিণতি ঘটে এক আত্মঘাতী হামলায়।

পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টান্তগুলোও এই সমস্যার বাইরে নয়। পুতিন রাশিয়ায় জাতীয় গর্ব ফিরিয়ে আনেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হ্রাস করে তাঁর শাসন একচ্ছত্রতন্ত্রে রূপ নেয়। ইউক্রেন আক্রমণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে বিশ্বরাজনীতিতে একঘরে করে ফেলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ‘আউটসাইডার’ রাজনীতির একটি প্রবণতা সৃষ্টি করেন। কিন্তু তাঁর শাসনকাল বিভাজন, সত্য বিকৃতি এবং গণতন্ত্রবিরোধী আচরণে চিহ্নিত হয়। ক্যাপিটল হিল হামলার মাধ্যমে তাঁর শাসনের অবসান ঘটে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ে। একইভাবে মিয়ানমারের অং সান সু চি, যিনি ছিলেন শান্তির প্রতীক, রোহিঙ্গা নিপীড়নের সময় নীরব থেকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাস হারান।
নেতৃত্বের বিবর্তন অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট ধাপে এসে পথ হারায়। আদর্শ থেকে যাত্রা শুরু করে ক্ষমতার মোহে পড়ে তা হয়ে ওঠে শাসনকেন্দ্রিক এবং একসময় নিয়ন্ত্রণমুখী। এই নিয়ন্ত্রণ যখন যুক্তির বদলে ভয় ও বলপ্রয়োগের ওপর দাঁড়ায়, তখনই নেতার চারপাশে ‘হ্যাঁ-মানুষে’ ভরা এক বলয় গড়ে ওঠে। এই বলয় তাকে বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং তার শেষের দিনগুলো হয়ে পড়ে অসম্মানজনক।
এই বিচ্যুতি থেকে যে কজন নেতা নিজেদের দূরে রাখতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে নেলসন ম্যান্ডেলা অন্যতম। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর তিনি ক্ষমতায় এসেও প্রতিশোধমূলক রাজনীতি করেননি। ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’-এর মাধ্যমে তিনি অপরাধীদের দায়মুক্তি দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য একতাবদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার চেষ্টা করেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তিনি দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করেননি, বরং সময়মতো বিদায় নিয়েছেন। ক্ষমতা ত্যাগের এই নৈতিক অবস্থান তাঁকে ইতিহাসে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতা এই আলোচনার বাইরে নয়। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের বদলে দেখা যায় পালাবদলের রাজনীতি।

সরকারপ্রধানরা ক্ষমতায় আসার পর বিরোধীদলের প্রতি সহনশীলতা হারিয়ে ফেলেন। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা ও মিডিয়া এক ধরনের ‘পলিটিক্যাল কন্ট্রোল’-এর আওতায় পড়ে যায়। বিরোধী মতকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত করে। ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলয়ে সংখ্যালঘুদের আশঙ্কা বাড়ছে, আর বিরোধীদের সাংবিধানিক জায়গা সীমিত হচ্ছে। পাকিস্তানে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ এবং শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বও প্রমাণ করে, জনপ্রিয়তা থাকলেই সুশাসন নিশ্চিত হয় না।
এই সব দৃষ্টান্ত একটিই শিক্ষা দেয়—জনপ্রিয়তা এক সময় শেষ হয়, কিন্তু নৈতিকতা এবং সুশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়। একজন প্রকৃত নেতা নিজেকে প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের চেয়ে বড় ভাবেন না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য থাকে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের নিয়মতান্ত্রিকতায়, বিরোধী মতের প্রতি সহনশীলতায় এবং জনগণের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সক্ষমতায়। যারা ক্ষমতাকে ‘অধিকার’ নয়, ‘দায়িত্ব’ হিসেবে দেখেন, তারাই ভবিষ্যতে নেতৃত্বের মানদণ্ড স্থাপন করেন।
নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বের দর্শন ছিল অনেকটা এমন : নমনীয়, পেছন থেকে দিকনির্দেশনা দেওয়া এবং অন্যকে সামনে যেতে দেওয়া।
আজকাল এমন নেতা পাওয়া কঠিন যিনি নিজে পেছনে থেকে অন্যকে সামনে এগিয়ে দিতে ভূমিকা রাখবেন। এখন ক্ষমতা এবং দম্ভ একাকার হয়ে গেছে। বিনয় এখন দুর্বলতা বলে মনে হয়। তাই আজকের পৃথিবী এমন নেতার অপেক্ষায় আছে, যিনি ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও ক্ষমতার মোহে নিজেকে হারাবেন না, বরং প্রজন্মের জন্য ভবিষ্যতের পথ নির্মাণ করে যাবেন।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক