উত্তরাঞ্চলের রংপুর জেলার বেশ কিছু এলাকা—তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচড়া—আলু চাষে বিখ্যাত হলেও এবছরের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। অসময়ে বৃষ্টি, শুষ্ক মাটি, পানির অভাব এবং উৎপাদন খরচের উর্ধ্বগতিতে কৃষকেরা চাপে পড়েছেন। এই চাপ শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিকও। ঈদুল আজহা যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে অনিশ্চয়তা, আত্মসম্মান আর পরিবারের চাহিদা মেটানোর চিন্তা।
চাষ হলো, লাভ হলো না
রংপুরের তারাগঞ্জের কৃষক হারুনুর রশিদ (৫৫) জানালেন, “তিন বিঘা জমিতে আলু করেছিলাম। ফলন হয়েছিল গড়ে ২৪০ মণ। কিন্তু দামে যা খেল, তাতে আমার খরচই উঠেনি। ১২ টাকায় বিক্রি করেছি, আর খরচ পড়েছে কেজিপ্রতি ১৫ টাকা।”
তিনি যোগ করেন, “হিমাগারে রাখিনি, কারণ আগের বছর সেখানেও ঠকেছিলাম। এবার নগদ পেয়ে বিক্রি করেছি। এখন মনে হচ্ছে, অন্তত কিছুটা অপেক্ষা করলে হয়তো ভালো হতো, কিন্তু কে জানত?”
খরা আর শুষ্কতার ভয়
রংপুর অঞ্চলে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তুলনামূলক খরা দেখা যায়। কৃষকেরা পানির জন্য গভীর নলকূপের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। এতে সেচ খরচ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। বদরগঞ্জের কৃষক আমজাদ হোসেন বলেন, “এক বিঘা জমিতে শুধু সেচেই পড়েছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। তার ওপর সার, বীজ, শ্রম—সব মিলে মাথার ওপর চাপ বেড়েই গেছে।”
ঈদ মানেই অপূর্ণতার হিসাব
হারুনের স্ত্রী সেলিনা বেগম বলেন, “বড় ছেলেটা বলেছে, ওর গরুর সঙ্গে ছবি তুলতে মন চায়। আমি শুধু বলেছি, বাবার হাতে টাকা নেই। ঈদে খুশি হতেই তো আল্লাহ বলেছেন, কিন্তু আমরা কিভাবে খুশি হব, সেটাই ভাবি।”
ঈদ মানে নতুন জামা, ভালো খাওয়া আর আনন্দ—এই ধারণা এখানকার অনেক ঘরে এখন কেবল স্মৃতির অংশ। অনেক পরিবার এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ছোট পরিসরে ঈদ করবে, ছাগল কোরবানি অথবা ভাগে গরু।
‘আমরা কি শুধুই শ্রমিক?’
গঙ্গাচড়ার কৃষক রমিজ উদ্দিন বলেন, “আমরা মাঠে কাজ করি, ঘাম ঝরাই, কিন্তু দাম পায় ফড়িয়ারা। আমাদের কষ্টের দাম কেউ বোঝে না। আমরা কি শুধুই শ্রমিক, যাদের কেবল মাথা নিচু করে থাকতে হয়?”
তিনি বলেন, “এবার ছেলেমেয়েদের বলেছি, কোরবানি হবে না। ওরা চুপচাপ থাকল, কিন্তু মনটা খারাপ বুঝতে পারছি।”
সামাজিক মান আর অভিমান
রংপুর অঞ্চলে ঈদের কোরবানি সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিবেশী গরু কোরবানি দিলে নিজেরা না দিলে যেন আত্মসম্মান ক্ষুন্ন হয়। কৃষক হাফিজুল ইসলাম বলেন, “গরু না কেটেও ঈদ করা যায়, কিন্তু আত্মীয়স্বজনের কথা, প্রতিবেশীর চোখ—সব মিলে এক ধরনের অপমান লাগে।”
তবে অনেকেই এবার গরু থেকে সরে এসে ছাগল কিংবা খাসির দিকেই ঝুঁকছেন। কেউ আবার দুই-তিন পরিবার মিলে একটা গরু নিচ্ছেন।
চাষের ভবিষ্যৎ চিন্তা
ঈদের পরে আবার মাঠে নামতে হবে। বীজ, সার, জমি প্রস্তুতির খরচ মাথায় রেখেই অনেকে এখন থেকেই টাকা বাঁচাতে চাচ্ছেন। আমজাদ বলেন, “একবার ঈদ মানে যদি আবার ঋণ—তাহলে সেই ঈদের দাম কী?”
তিনি যোগ করেন, “আমার ছেলে কলেজে পড়ে। তার ফি, খাতা-কলমের খরচ—সবই মাথায় রাখতে হয়। তাই কোরবানির গরুর বদলে আমি বাঁচিয়ে রাখছি আগামী দিন।”
প্রশাসনের নীরবতা, কৃষকের আর্তি
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অফিস বলছে, কৃষকদের সচেতনতা বাড়ছে, অনেকেই খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখছেন। তবে বাস্তবতা হলো, বাজার নিয়ন্ত্রণ না হলে, হিমাগারে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য না কমলে, কৃষকের ভাগ্য বদলাবে না।
রমিজ বলেন, “সরকার যদি কৃষকের আলু সরাসরি কিনত, তাহলে অনেকটা ভালো হতো। আমরা শুধু ন্যায্য দাম চাই, দয়া চাই না।”
সীমিত ঈদ, সীমাহীন ভালোবাসা
এই ঈদে রংপুরের অনেক পরিবারে গরু থাকবে না, নতুন কাপড়ও সীমিত। কিন্তু ঈদের নামাজ, মিলেমিশে খাওয়া, আর পরিবারের একসঙ্গে থাকা—এইসবই ঈদের প্রকৃত রূপ।
সেলিনা বলেন, “আমার ছেলে বলেছে, গরু নাই তো কি হয়েছে, আমরা তো একসঙ্গে আছি। এই কথা শুনে মনটা হালকা হয়ে যায়।”
রংপুরের আলুচাষিরা জানেন, তাঁদের কোরবানি কেবল পশু নয়, তাঁদের কষ্ট, দায়িত্ব, আর ভবিষ্যতের জন্য ত্যাগও। ঈদুল আজহা তাই তাঁদের কাছে জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তেরও নাম।