ঈদুল আজহা মানেই ত্যাগ আর পশু কোরবানির মধ্য দিয়ে আত্মিক পরিশুদ্ধি। আর এই কোরবানির পশু কেনাকাটার অভিজ্ঞতা ঢাকাবাসীর কাছে এক সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক উৎসবের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঈদের এক থেকে দেড় সপ্তাহ আগে শুরু হয় এই প্রাণচঞ্চলতা—যা ঘুরে দাঁড়ায় এক বিশাল বাজার ব্যবস্থায়।
গাবতলী থেকে শ্যামপুর—বিস্তৃত হাটের জাল
ঢাকার মূল ও অস্থায়ী কোরবানির পশুর হাটগুলো হচ্ছে গাবতলী, আমিনবাজার, সায়েদাবাদ, শ্যামপুর, তুরাগ, বসিলা, উত্তরার দিয়াবাড়ি, যাত্রাবাড়ি, ও ভাটারা এলাকায়। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার ও সিটি করপোরেশন বেশ কিছু অস্থায়ী হাটের অনুমোদন দেয় প্রতি বছর।
বিশেষত গাবতলী হাট—দেশের সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর হাট হিসেবে পরিচিত। এখানে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, এমনকি সীমান্তবর্তী ভারত থেকে আসা গরু দেখা যায়। একাধিক খামার মালিক, স্থানীয় কৃষক এবং দালালদের নিয়ে এই হাটে তৈরি হয় এক রকম উৎসবমুখর পরিবেশ।
চিত্র-বিচিত্র গরুর প্রদর্শনী ও দরদাম যুদ্ধ
গরুর হাটে গেলে চোখে পড়ে বাহারি নামের ও সাজসজ্জার পশু। কারো নাম ‘বাদশা রাজা’, কারো নাম ‘সাহেব চাঁদ’, কেউ আবার ‘বঙ্গ বাহাদুর’। এই নামগুলো সাধারণত বিক্রেতার দেওয়া—খরিদ্দারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই এমন নামকরণ।
কিন্তু গরুর হাট মানেই শুধু দর্শন নয়—সেখানে চলে এক প্রকার দরদামের যুদ্ধ। ক্রেতা চায় ন্যায্যমূল্যে ভালো পশু, বিক্রেতা চায় লাভ নিশ্চিত করে বিক্রি। এই দরদামে কখনও হয় চাতুর্য, কখনও রসিকতা, কখনও আবার বিরক্তি।
দালাল চক্র ও অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি
এ হাটগুলোর এক অন্ধকার দিক হচ্ছে দালাল চক্রের আধিপত্য। বিশেষ করে গাবতলী ও আমিনবাজার হাটে দালালরা পশু বিক্রেতা ও ক্রেতার মাঝে মধ্যস্থতা করে অতিরিক্ত কমিশন আদায় করে। অনেক সময় তারা ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে দামে ধোঁকা দেয়। এমনকি নিরীহ গরু দেখিয়ে দাম হাঁকে রাজকীয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই দালাল-চক্র কোরবানির পশুর প্রকৃত বাজারমূল্য নষ্ট করছে এবং সাধারণ জনগণকে চাপে ফেলছে।
খামারিদের উত্থান ও গরুর পালক অর্থনীতি
গত এক দশকে ঢাকার হাটগুলোতে খামারিদের সরাসরি উপস্থিতি বেড়েছে। রাজধানীর আশপাশে যেমন সাভার, ধামরাই, নবাবগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রচুর খামারি গরু নিয়ে আসে। এদের মধ্যে অনেকে অনলাইন মাধ্যমে অর্ডার নিয়ে সরাসরি বাসায় পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে।
এই খামার অর্থনীতি গ্রামের হাজারো পরিবারকে উৎসবকেন্দ্রিক আয় নিশ্চিত করেছে। খামারি শাহীন বলেন, “একটা গরু লালন করতে আমাদের ৯-১০ মাস সময় লাগে। ঈদ মানেই আমাদের বছরের রোজগারের প্রধান উৎস।”
হাট ব্যবস্থাপনা: ভালো উদ্যোগ, সীমাবদ্ধ বাস্তবতা
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রতি বছর হাট ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করে। থাকে পশুর জন্য পানির ব্যবস্থা, টয়লেট, ভেটেরিনারি চিকিৎসা, কসাই সুবিধা, এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি।
তবে বাস্তবে অনেক সময় দেখা যায় পানির অভাব, গরুর চিকিৎসক না থাকা, কাদা ও দুর্গন্ধে ভরা মাঠ। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে অস্থায়ী হাটগুলোতে হাঁটু সমান কাদা হয়ে যায়। এসব ব্যবস্থাপনার ঘাটতি হাটের প্রতি মানুষের আস্থা কমিয়ে দিচ্ছে।
ভেটেরিনারি পরীক্ষার গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা
সরকারি ভাবে পশু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা খুবই সীমিত। হাটে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়, তবে সেগুলো সব হাটে কার্যকরভাবে থাকে না। এর ফলে অনেক সময় অসুস্থ গরু বা ইনজেকশন দেওয়া পশু বিক্রির ঝুঁকি থেকে যায়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, “এই পরীক্ষার ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত করতে হবে। অন্যথায় জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক ঝুঁকি থেকে যাবে।”
অনলাইন হাট ও ভবিষ্যতের দিগন্ত
করোনা মহামারির পর অনলাইন কোরবানি হাটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বেশ কিছু প্ল্যাটফর্ম যেমন ‘সাধারন কৃষক’, ‘সারোয়ার খামার’, ‘ফার্মহাউস বিডি’ কোরবানির পশু অনলাইনে অর্ডার নেওয়া শুরু করে। ক্রেতা ফোনে বা ওয়েবসাইটে গরু দেখে অর্ডার দেন, এবং তা বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ে।
এই নতুন প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতি অনেককে হাটের ভিড় ও দালাল সমস্যার বাইরে নিয়ে এসেছে, তবে এখনও বিশাল জনগোষ্ঠী প্রচলিত হাটকেই বেশি বিশ্বাস করে।