ঈদুল আজহার মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেও ঢাকার বিভিন্ন পাড়ায়, বিশেষ করে পুরান ঢাকা ও উপশহরাঞ্চলে ঈদের আশেপাশের দিনগুলোতে জমে ওঠে নানা ঐতিহ্যবাহী খেলার আয়োজন। এই খেলাধুলা একদিকে যেমন বিনোদন, তেমনি এলাকাভিত্তিক গর্ব, সামাজিক সংহতি এবং ঐতিহ্যচর্চারও অংশ। আজকের ঢাকায় এই খেলাধুলা কিছুটা কমে এলেও এখনো কিছু এলাকায় তার রেশ টিকে আছে।
গরুর লড়াই—এক হারিয়ে যেতে বসা উৎসব
ঈদুল আজহা ঘিরে গরুর লড়াই এক সময় পুরান ঢাকার ও আশেপাশের অঞ্চলের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। বংশাল, কামরাঙ্গীরচর, জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ, শ্যামপুর ও দোহার-নবাবগঞ্জ এলাকায় ঈদের পরদিন বা তার পরদিন গরুর লড়াই হতো বড় মাঠে বা খোলা প্রান্তরে। গরু দুটি একে অপরের দিকে তেড়ে যেত, আর দর্শকেরা করত উল্লাস। এটিকে ঘিরে চলত বাজি, হর্ষধ্বনি, ঢাকঢোল।
যদিও নিরাপত্তা ও পশু সুরক্ষার প্রশ্নে প্রশাসন এই আয়োজনের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে, তবু কিছু এলাকায় আজও এই খেলা গোপনে কিংবা প্রতীকী রূপে টিকে আছে। স্থানীয়দের মতে, এটি ছিল ঈদের অন্যতম সেরা বিনোদন।
দড়ি টানাটানি ও মহল্লা কাপ
ঈদের পরে বা দ্বিতীয় দিনে ঢাকার বিভিন্ন পাড়ায় ‘দড়ি টানাটানি’ প্রতিযোগিতা খুব পরিচিত আয়োজন ছিল। রাস্তায় বড় দড়ি পেতে দুই দলে ভাগ হয়ে এই খেলা হত। খেলায় জিতলে এক দল আরেক দলকে নিয়ে ‘ব্যানার’ করে র্যালি করত। এখনো মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মগবাজার, আগারগাঁওয়ের কিছু এলাকায় এই ঐতিহ্য নতুন রূপে ফিরে আসছে।
কিছু জায়গায় স্থানীয় কিশোর ও তরুণদের উদ্যোগে হয় ‘মহল্লা কাপ’ টুর্নামেন্ট—যেখানে ঈদের ছুটিতে আয়োজিত হয় ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, দড়ি টানাটানি, পেনাল্টি শ্যুটআউট ইত্যাদি। এতে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি তৈরি হয় বন্ধুত্বের বন্ধন।
পিঠি (পিঠ খেলা)—পুরান ঢাকার ব্যতিক্রমী আয়োজন
পিঠি একটি রুক্ষ, বলভিত্তিক খেলা, যা ঈদ উপলক্ষে পুরান ঢাকার ওয়ারি, সদরঘাট ও কাশ্মীরি টোলায় বিশেষভাবে আয়োজিত হত। দুই দলের খেলোয়াড় বল কেড়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিত এবং প্রতিপক্ষকে ছোঁয়া বা বল নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করত।
এই খেলায় তীব্র শারীরিক পরিশ্রম ও কৌশলের প্রয়োজন হতো, তাই কিশোর ও তরুণদের মধ্যে এটি ছিল বেশ জনপ্রিয়। যদিও এখন এই খেলা প্রায় হারিয়ে গেছে, তবে কিছু এলাকার প্রবীণেরা এখনও স্মৃতিচারণ করেন, “ঈদ মানেই পিঠির দিন”।
ঘুড়ি উৎসব ও ছাদ সংস্কৃতি
ঈদের পরে ছুটির দিনগুলোতে ঢাকার কিছু এলাকায় হতো ঘুড়ি ওড়ানোর আয়োজন। বিশেষ করে ওয়ারি, বাংলাবাজার, সূত্রাপুর, কিংবা পুরান ঢাকার rooftops হয়ে উঠত রঙিন ঘুড়ির মেলা। ছোটরা যেমন ঘুড়ি ওড়াতো, বড়রা তেমন ‘পেচানো দড়ি’ দিয়ে কেটে দিত প্রতিপক্ষের ঘুড়ি।
এই ঘুড়ি ওড়ানো ঘিরে এক ধরনের সামাজিক প্রতিযোগিতা তৈরি হতো, এবং কখনো কখনো গানে-আবৃত্তিতে ছাদ হতো মেতে ওঠা ঈদের ছন্দে।
ঈদের ক্রীড়া উৎসব ও সমাজিক সম্প্রীতি
ঢাকার অনেক এলাকায় স্থানীয় ক্লাব বা সংগঠন ঈদের সময় শিশুদের নিয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, গল্প বলা, ছোট নাটিকা, বা কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো বই, পেনসিল বক্স বা জার্সি। এইসব ক্ষুদ্র আয়োজনের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে নতুন প্রজন্মের আত্মবিশ্বাস ও স্থানীয় সম্প্রীতি।
রাজনৈতিক দল বা কাউন্সিলরদের উদ্যোগ
সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বা রাজনৈতিক নেতারাও ঈদের পরদিন খেলা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। এর মাধ্যমে তারা জনগণের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে এবং মহল্লাভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলেন। যদিও অনেক সময় এসব আয়োজন হয় লোক দেখানো, তবু সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এটিকে একধরনের নতুন ‘ঐতিহ্য’তে পরিণত করেছে।