ঢাকার ইতিহাসে ঈদ মানেই এককালে ছিল নবাব বাড়ির উৎসব। বিখ্যাত নবাব খাজা পরিবারের এই আয়োজনে যেমন থাকত ধর্মীয় আনুগত্য, তেমনি থাকত রাজকীয় ঐশ্বর্য, সামাজিক দান, ও সুশৃঙ্খল উৎসবের পরম্পরা। ঈদুল আজহা ছিল নবাবদের জন্য কেবল ধর্মীয় পালন নয়, এটি ছিল জনতার প্রতি তাঁদের ‘সামাজিক প্রতিশ্রুতি’রও বহিঃপ্রকাশ। আজকের শহরে সেই দৃশ্য আর অবশিষ্ট নেই, কিন্তু ইতিহাস আর কিছু প্রবীণদের স্মৃতিতে সে চিত্র এখনও জীবন্ত।
ঈদের আগের প্রস্তুতি: এক মাসব্যাপী রাজকীয় আয়োজন
নবাব পরিবারের ঈদুল আজহার প্রস্তুতি শুরু হতো ঈদের প্রায় এক মাস আগে। মোহাম্মদপুরের বাবর রোড, আজিমপুর, এবং পুরান ঢাকার নবাববাড়ির আঙ্গিনায় বাড়ির কর্মচারীরা ঘর সাজানো, গরু-ছাগল খোঁজা, অতিথিদের তালিকা প্রস্তুত করা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকত। কুরআনখানি, দোয়া-মাহফিল, এবং দরিদ্রদের জন্য নতুন পোশাক কিনে বণ্টনের কাজ চলত পুরো রমজানজুড়ে।
কোরবানির পশু নির্বাচন: প্রতীকি রাজকীয়তা
ঈদের তিন–চার দিন আগে নবাব পরিবারের নিজস্ব ‘কান্দা’ বা খামার থেকে আনা হতো বিশাল আকৃতির গরু বা উট। এই পশুগুলোর জন্য থাকত আলাদা পরিচর্যা—তাজা ঘাস, মালিশ, পানি খাওয়ানোর সময় নির্ধারিত হতো। কিছু গরুর গায়ে গোলাপজল ও আতরও ছিটানো হতো। পশুগুলোর গলায় পড়ানো হতো রেশমি ফুলের মালা, আর পিঠে থাকত মখমলের চাদর।
ঈদের সকাল: নামাজ ও নবাবদের জনতার মাঝে অবস্থান
ঈদের দিন সকালে নবাব পরিবারের সদস্যরা অংশ নিতেন শাহী ঈদগাহে নামাজে। তাঁদের সামনে থাকত আলাদা চাদর পাতা, নিরাপত্তার জন্য থাকত সেনানায়কদের মতো পোশাক পরা সিপাহি। কিন্তু নামাজ শেষে নবাব পরিবার মিশে যেত সাধারণ মুসল্লিদের সঙ্গে। মানুষ তাঁদের সালাম করত, নবাবেরা করতেন আলিঙ্গন।
এটা ছিল নবাবদের “সমাজের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করার” নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রকাশ।
কোরবানি: শৃঙ্খলা, সংখ্যাবহুলতা ও উদারতা
নবাব বাড়িতে ঈদের দিন কোরবানি হতো অনেকটা সামরিক শৃঙ্খলায়। সকাল ৯টা থেকে শুরু করে দুপুর অবধি চলত পশু জবাইয়ের কাজ। প্রায় ১০–২০টি পশু একসঙ্গে কোরবানি দেওয়া হতো, এবং প্রতি কোরবানির আগে কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া এবং নির্দিষ্ট একজন ওলামার তত্ত্বাবধান থাকত।
গরু জবাইয়ের জন্য নির্দিষ্ট ‘মাটির প্রাঙ্গণ’ ছিল, যেখানে জবাইয়ের পরপরই মাংস কাটা, ভাগ করা, ও পরিষ্কার করার কাজ সম্পন্ন হতো।
মাংস বণ্টন: এক মহাকর্মযজ্ঞ
নবাব বাড়ির কোরবানির সবচেয়ে পরিচিত অংশ ছিল মাংস বণ্টন। নবাব পরিবারের সদস্যরা নিজের হাতে ভাগ করতেন মাংস। নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী দরিদ্র পরিবার, এতিমখানা, মাদ্রাসা, স্থানীয় মসজিদ ও কর্মচারীদের মাঝে বিতরণ করা হতো।
এই বণ্টন ব্যবস্থা এতটাই নিখুঁত ছিল যে, প্রতিটি পরিবার জানত তাদের কবে ও কীভাবে মাংস পৌঁছাবে। কোরবানির পরদিন পর্যন্ত এই বিতরণ চলত। নবাব পরিবারের নারী সদস্যরাও পেছনে থেকে অংশ নিতেন বণ্টনের কাজে।
সামাজিক অনুষ্ঠানের রেওয়াজ
ঈদের দিন সন্ধ্যায় নবাব বাড়িতে থাকত একটি “ঈদ মিলন অনুষ্ঠান”। সেখানে অংশ নিতেন ব্রিটিশ-ভারতীয় আমলের সরকারি কর্মকর্তারা, উকিল-বিচারক, ব্যবসায়ী, ও শিল্পীসমাজের প্রতিনিধিরা। নবাবরা সেখানে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিতেন, যেখানে সমাজের দায়িত্ব, ত্যাগের মহত্ব এবং ইসলামি ঐক্যের কথা থাকত।
তখনকার সংস্কৃতিতে এই অনুষ্ঠান ছিল সামাজিক নেতৃত্বের পরিপূর্ণতা—এক রকম ‘সাংস্কৃতিক ঈদ কনভেনশন’ বলা যেতে পারে।
নবাব পরিবারের নারীদের ঈদ
নারীরা সরাসরি ময়দানে যেতেন না, কিন্তু নবাব বাড়ির আঙ্গিনায়, ঝর্ণার পাশে, কিংবা ‘জেনানা মহলে’ বসে তারা ঈদের দিন দোয়া মাহফিল ও মেহেদি উৎসব করতেন। ছোট মেয়েরা সাজগোজ করত, কোরবানি দেখার জন্য ছাদে উঠে পড়ত। ঈদের দিন বিকালে নারীদের জন্য আলাদা ঘরেই থাকত আবৃত কণ্ঠে গান পরিবেশনের ছোট আয়োজন, কখনো কখনো তবলা-হারমোনিয়াম নিয়ে।
আজকের বাস্তবতায় নবাব বাড়ি ও ঈদের স্মৃতি
ঢাকার নবাব পরিবারের প্রাসাদিক ঐতিহ্য এখন অনেকটাই অতীত। নবাব পরিবার ছড়িয়ে পড়েছে, ঐ রাজকীয় আয়োজন আর ফিরে আসেনি। তবে কিছু পরিবার এখনও ছোট পরিসরে কোরবানি, দান, ও স্মরণসভা আয়োজন করে।
পুরান ঢাকার প্রবীণদের মতে—“নবাবদের ঈদ ছিল ধর্ম আর দায়িত্বের এক অনবদ্য মিলন।”