ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানি ও ধর্মীয় রীতি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই একসময় ঢাকায় ছিল মেলার সামাজিক আবেদন। পুরান ও মধ্য ঢাকার ঐতিহ্যে দুইটি মেলা বিশেষভাবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল—আজিমপুর মেলা এবং ঢোলাইখাল মেলা। এই মেলাগুলো মূলত ঈদের পরদিন অথবা ঈদের দুদিন পরে শুরু হতো এবং তা চলত ৩–৫ দিন পর্যন্ত। পরিবারভিত্তিক আনন্দ, ছেলেমেয়েদের শৌখিন আনন্দদৃষ্টি, এবং নারী-অংশগ্রহণে ভরা ছিল এই মেলাগুলোর মূল চরিত্র।
আজিমপুর মেলা: ইতিহাস, পরিসর ও আনন্দের নস্টালজিয়া
ঢাকার আজিমপুর এলাকায় ঈদের পরদিন থেকে শুরু হওয়া মেলাটি একসময় স্থানীয়দের কাছে ঈদের দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ছিল। মূলত আজিমপুর কবরস্থানের দক্ষিণাংশ এবং পুরোনো আবাসিক এলাকা সংলগ্ন মাঠে বসত এই মেলা।
মূল আকর্ষণ কী ছিল?
- বাচ্চাদের খেলনা ও মুখোশ স্টল: বাঁশি, পুতুল, মুখোশ, প্লাস্টিকের রাইফেল—যা শিশুরা নিজের ঈদের সেলামির টাকা দিয়ে কিনত।
- মাটির পাত্র ও হস্তশিল্প: গ্রামের কারিগররা পাতা গ্লাস, টবে গাছ, ছোট পাঁকঘর ইত্যাদি বিক্রি করতেন। শহরের মানুষ এসব কিনে ঘরের শোভা বাড়াতেন।
- চকলেট-চানাচুর ও স্থানীয় খাবার: চটপটি, বাতাসা, চিঁড়া-মুড়ির প্যাকেট, মিষ্টির ঠেলা গাড়ি নিয়ে আসতেন মেলার প্রান্তিক বিক্রেতারা।
নারী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ
এই মেলায় মেয়েদের জন্য থাকত গয়নাদানার দোকান, আলতা-মেহেদি, চুড়ির স্টল। মায়ের সঙ্গে আসা কিশোরীরা দল বেঁধে এসব দোকানে গিয়ে বাছাই করত ঈদের দ্বিতীয় দিনের সাজ। রাস্তায় রিকশায় বসানো ছাউনি স্টল ছিল মেয়েদের আলাদা আনন্দস্থল।
সমাজসংলগ্নতা ও মিলনমেলা
এই মেলার বড় একটি দিক ছিল—সামাজিক মিলনমেলা। আশেপাশের পরিবারগুলো ঈদের পরদিন সেখানে দেখা করত, একসঙ্গে বসত। কেউ কেউ ঈদের জামাকাপড় পড়ে আবার নতুন করে সাজসজ্জা নিয়ে আসতেন যেন এটি ‘ঈদের দ্বিতীয় পর্ব’।
আজ কোথায় সেই মেলা?
নগরায়ন, ট্র্যাফিক বেড়ে যাওয়া, মাঠের সংকোচন, এবং অননুমোদিত দোকানদারির কারণে এই মেলাটি একসময় বন্ধ হয়ে যায়। এখন আজিমপুরে সেই ধরণের উৎসব আর চোখে পড়ে না, বরং সেখানকার মানুষের স্মৃতিতে রয়ে গেছে এক ‘হারানো ঈদ উৎসব’।
ঢোলাইখাল মেলা: পিতৃপুরুষের ঐতিহ্য, কারিগরদের মিলন ও নগরজীবনের আনন্দ
ঢোলাইখাল এলাকায় বসত আরেকটি ঈদ-পরবর্তী জনপ্রিয় মেলা। এটি কেবল শিশুদের মেলা ছিল না, বরং স্থানীয় লৌহশিল্পী, মেকানিক ও কাঠমিস্ত্রিদের জন্যও ছিল এক মিলনমেলা। ঈদের পরদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তার পাশে, খালের ধারে, পুরোনো গ্যারেজ ও দোকানের সামনে সাজানো হতো পসরা।
কী থাকত এই মেলায়?
- লোকশিল্প ও খেলনার দোকান
- লৌহকর্ম শিল্পের প্রদর্শনী: ছোট ছোট লোহার তৈরি ঘোড়া, কলমদানি, প্যাঁচার মাথা—যা স্থানীয় কারিগররা তৈরি করতেন শখের বসে।
- গাড়ি ও যন্ত্রপাতির প্রদর্শনী: অনেক দোকান গ্যাস সিলিন্ডার বা ছোট মেশিন অংশ সাজিয়ে রাখতেন উৎসবের আবহে, যা দেখে শিশুরা তাকিয়ে থাকত বিস্ময়ে।
আজ আর নেই কেন?
ঢোলাইখাল এলাকায় খালের অস্তিত্ব হারানো, অবৈধ দখল, এবং ব্যস্ত রাস্তার কারণে এই মেলা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায়। দোকানদাররা এখন আর জায়গা পান না; প্রশাসনিক অনুমোদনও বন্ধ হয়ে গেছে। একসময় যে এলাকা ছিল ‘ঈদের কারিগরি উৎসব’—তা এখন শুধুই কর্মব্যস্ত নগরের অংশ।
দুই মেলার মিল ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য
- এই দুই মেলার মাধ্যমে ঈদের উৎসব কেবল ধর্মীয় বা পারিবারিক ছিল না, বরং নাগরিক মেলা ও সামাজিক মেলবন্ধনের অংশও ছিল।
- এখানে ধর্ম, শ্রেণি বা বয়সভেদে সকলের উপস্থিতি দেখা যেত—এক প্রকার সামাজিক অন্তর্ভুক্তির উৎসব।
- আজকের ‘মেগাসিটি ঢাকা’য় এই উৎসবের জায়গাগুলো হারিয়ে গিয়ে ঈদের আনন্দ অনেকটাই গৃহবন্দি হয়ে গেছে।
মেলাগুলো পুনরুজ্জীবনের সুযোগ আছে কি?
বিশেষজ্ঞ ও সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণে এই দুই মেলার ঐতিহ্য নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সরকারি পরিকল্পনার আওতায় “ঈদ ও লোকায়ত উৎসব মেলা” নামে এই মেলাগুলো শহরের পার্ক বা মুক্তমঞ্চে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।