বিশ্বজুড়ে উষ্ণায়ন অগ্রসর হলেও সব অঞ্চলে একই হারে তাপমাত্রা বাড়েনি। মেরুবৃত্তে ও উচ্চ অক্ষাংশে গড় তাপ বেড়েছে দ্রুত, আর নিরক্ষরেখার কাছে তুলনামূলক ধীর। তবে একটি এলাকায় চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা—দক্ষিণ এশিয়া। গত ৪০ বছরে এখানে গড়ে প্রতি দশকে তাপমাত্রা বেড়েছে মাত্র ০.০৯° সেলসিয়াস, যেখানে বৈশ্বিক ভূমিভাগে গড় বৃদ্ধি ০.৩০° ছিল। বিজ্ঞানীরা এ ‘উষ্ণায়ন-গর্ত’–এর নিখুঁত ব্যাখ্যা এখনো খুঁজে পাননি, তবে বায়ুদূষণ ও সেচব্যবস্থার পরিবর্তনকে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন। সমস্যাটি হল, দূষণ কমানো ও সেচ সম্প্রসারণ থমকে গেলে এই সূচক হঠাৎই উর্ধ্বমুখী হতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার শান্ত উত্তাপের আড়াল
এ অঞ্চল বরাবরই গরম। এপ্রিল–জুনের খরায়, বিশেষত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতলে, ৪০° সেলসিয়াস তাপমাত্রা অস্বাভাবিক নয়। আবার আর্দ্রতার সঙ্গে মিলিয়ে হিসেব করা ‘হিট স্ট্রেস’ সূচকে বৈশ্বিক সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই এখানকার বাসিন্দা। তবু সামগ্রিক উষ্ণায়ন তুলনামূলক কম—এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ঘন সুতো ধোঁয়া।
দূষণ: ঠান্ডা করে, আবার গরমও
কার্বন ডাই–অক্সাইডের মতো দীর্ঘস্থায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস সারা বিশ্বে সমানভাবে ছড়ালেও, সালফেট কণা ও কালো ধোঁয়া (এয়ারোসোল) স্থানীয়ভাবেই প্রভাব ফেলে। সূর্যালোকের একটা অংশ তারা প্রতিফলিত কিংবা শোষণ করে ভূমির কাছাকাছি পৌঁছাতে দেয় না; ফলে জমি অপেক্ষাকৃত ঠান্ডা থাকে। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমতল শিল্প-ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া, খড়-কাঠ পোড়ানো ও জ্বালানি কাঠের ব্যবহার—সব মিলিয়ে বিশ্বের দূষিততম অঞ্চলের একটি। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, এই এয়ারোসোলের আধিক্য গত দুই দশকে উষ্ণায়নের প্রভাব আংশিক ঠেকিয়ে রেখেছে। তবে কালো ধোঁয়া সূর্যালোক শোষণ করে উপরেকার বায়ুমণ্ডল গরমও করে, যা জলবায়ু সমীকরণকে জটিল করে তোলে।
সেচ: মাঠ ঠান্ডা, পানির তৃষ্ণা
১৯৮০-র পর থেকে ভারতে সেচাধীন জমি দ্বিগুণ হয়েছে। সেচের পানির বাষ্পীভবন শীতল প্রভাব সৃষ্টি করে। ২০২০ সালে ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় অনুমান করা হয়, সেচ না থাকলে দক্ষিণ এশিয়ায় অতিউষ্ণ দিনের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় দুই থেকে আট গুণ বেশি হতো।
দুর্দিনের পূর্বাভাস
কিন্তু এ দুটি ঢাল বেশিদিন টিকবে না। ভূগর্ভস্থ পানিশোষণ সীমায় পৌঁছেছে—দীর্ঘমেয়াদে সেচ বৃদ্ধি আর সম্ভব নয়। অপরদিকে মোদির ভারতসহ গোটা অঞ্চল দূষণ কমাতে নীতি নির্মাণে তৎপর। ২০১৭-এর তুলনায় ২০২৬-এর মধ্যে এয়ারোসোল ৪০% কমানোর লক্ষ্য ধরা হয়েছে। কিছু শহর ইতিমধ্যে আংশিক সাফল্য পেলেও স্বাস্থ্যের স্বার্থেই দূষণ কমাতে হবে। ফলে ‘ঠান্ডা’ রাখার কৃত্রিম আচ্ছাদন সরে যেতে শুরু করবে। মার্কিন ও ভারতীয় জলবায়ু বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক দিল্লি বৈঠকে ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ডেভিড বাটিসতি সতর্ক করেছেন—আগামী দুই দশকে ভারতের উষ্ণতা বৃদ্ধির গতি বিগত ২০ বছরের দ্বিগুণ হতে পারে। হার্ভার্ডের ড্যানিয়েল শ্রাগও একই পূর্বাভাস দিয়েছেন।
জনস্বাস্থ্যের মূর্ত আতঙ্ক
দূষণ এখনই প্রাণঘাতী—ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্সের হিসাব মতে, ২০২১ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় এয়ারোসোল-সম্পর্কিত মৃত্যু ২০-৩০ লাখ, বিপরীতে চরম গরমে মৃত্যু ১-৬ লাখ। অর্থাৎ দূষণ কমালে স্বাস্থ্যের বিশাল উপকার মিলবে; তবে এর ফলশ্রুতিতে যাদুর মায়া সরে গিয়ে তাপমাত্রা দ্রুত বাড়তে পারে। ইতিমধ্যে কিছু অঞ্চল ৪৫° সেলসিয়াস ও ৫০% আর্দ্রতার সমতুল্য বিপজ্জনক সীমা ছুঁই-ছুঁই করছে। ২০৪৭ নাগাদ, দূষণ ও সেচ পরিস্থিতি অপরিবর্তিত ধরলেও, গড় ভারতীয় নাগরিকের জন্য এমনি হিট স্ট্রেসের দিন প্রায় চার গুণ বাড়তে পারে—আর পরিস্থিতি বদলে গেলে সংখ্যাটি আরও বাড়বে।
নিরবচ্ছিন্ন খোলা আকাশে জীবন
হিন্দুস্তান টাইমসের ২০২২-এর বিশ্লেষণ বলছে, অর্ধেক ভারতীয় আউটডোর পেশায় যুক্ত; এয়ারকন্ডিশনার আছে মাত্র ১০% বাড়িতে। কয়েকটি শহর ‘হিটওয়েভ অ্যাকশন প্ল্যান’ নিলেও, শহর কাঠামোকে গরমের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার বড় উদ্যোগ সীমিত। এমন অবস্থায় তাপদাহের সুপ্রশস্ত পথ অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।
কী করা যেতে পারে
• দূষণ নিয়ন্ত্রণকে জনস্বাস্থ্য-অগ্রাধিকার হিসাবে অব্যাহত রাখা
• সেচনির্ভর কৃষিতে পানি-ব্যবস্থাপনা পুনর্বিচার; ক্ষয়িষ্ণু ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরতা কমানো
• শহরে সবুজায়ন, ছায়া ও শীতল ছাদ বাড়ানো
• কর্মস্থলে ও জনপরিসরে ঠান্ডা আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা
• জলবায়ু-সহিষ্ণু অবকাঠামো বিনিয়োগে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বৃদ্ধি
উপসংহার
দূষণ কমানো ও সেচ সংকোচনের স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সুফল অনস্বীকার্য। তবে এই ‘ঠান্ডা মুখোশ’ সরে গেলে দক্ষিণ এশিয়া দ্রুত একটি প্রচণ্ড গরম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চলেছে। পরিস্থিতি সামলাতে এখনই সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে, কয়েক দশকের মধ্যেই এই জনবহুল অঞ্চল মানব বসবাসের সীমা ছাড়িয়ে বিপর্যয়ময় গরমে জর্জরিত হতে পারে।