আগুনের লেলিহান শিখায় ছারখার গ্রাম
তিন দিকে বিল, এক দিকে পাকা সড়ক। সড়ক ঘেঁষে ছোট ছোট ঘর। ইটের দেয়াল, ছাউনি টিনের। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দেয়ালগুলো। বেশিরভাগ ঘরের আগুনে পোড়া টিনগুলো এলোমেলো হয়ে নিচে পড়ে আছে। কয়েকটি ঘরের টিন পুড়ে দেয়ালের সাথে লেপ্টে গেছে। ঘরের মধ্যে সবকিছু পুড়ে পুরু ছাই হয়ে আছে। পোড়া কিছু জিনিসপত্রের অবশিষ্ট অংশ ঘরের মেঝেতে ছাইয়ের ওপর কাত হয়ে পড়ে আছে। পুড়ে কালো হয়ে গেছে ঘরের দেয়ালগুলো। তখনও সম্পূর্ণ নেভেনি আগুন। ঘরের ভেতর থেকে বের হচ্ছে পোড়া গন্ধ।
হত্যাকাণ্ডের পর ভয়াবহ হামলা
আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া বাড়িগুলো যশোরের অভয়নগর উপজেলার ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের। একটি হত্যাকাণ্ডের পর গত ২২ মে রাতে একদল লোক হামলা চালিয়ে গ্রামের হিন্দুধর্মাবলম্বীদের অন্তত ২০টি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। একই রাতে সুন্দলী বাজারে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের দুটি দোকানে অগ্নিসংযোগ এবং চারটি দোকান ভাঙচুর করা হয়। অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের আগে বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট চালানো হয়। হামলাকারীরা অন্তত ১০ জনকে পিটিয়ে আহত করে।
কীভাবে ছড়াল সহিংসতা
২২ মে সন্ধ্যায় ডহর মশিয়াহাটী গ্রামের পিল্টু বিশ্বাসের (৪০) বাড়িতে কৃষক দল নেতা তরিকুল ইসলামকে (৫০) কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।
তরিকুল উপজেলার ধোপাদী গ্রামের ইব্রাহিম সরদারের ছেলে এবং নওয়াপাড়া পৌর কৃষক দলের সভাপতি ছিলেন।
হত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে একদল লোক বাড়ি ও দোকানগুলোতে লুটপাট, ভাঙচুর এবং পরে অগ্নিসংযোগ করে।
পুড়ে যাওয়া বাড়ির মর্মন্তুদ দৃশ্য
২৩ মে সকালে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িগুলো পুড়ে কঙ্কাল হয়ে আছে। ঘরের টিনগুলো পুড়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। অনেক ঘরের ভেতরে ঢুকতেই নাকে আসে পোড়া গন্ধ।
আসবাবপত্র, জামাকাপড়, লেপ-তোশক-বিছানা, টেলিভিশন, ফ্রিজ সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মেঝে ছাইয়ে ঢাকা। কোথাও কোথাও খাট, পালংক, চেয়ার, টেবিল, আলনা, আলমারি ভাঙা অবস্থায় ছড়িয়ে আছে।
পোড়া বাড়িগুলোর সামনে পড়ে আছে পাঁচটি পোড়া মোটরসাইকেল ও একটি ইঞ্জিনচালিত ভ্যান। কয়েকটি বাড়ির পাশের গাছও পুড়ে গেছে। পাশাপাশি তিনটি হারমোনিয়াম ও তিনটি ঢোল পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।
অনেক বাড়িতে তখনও আগুন জ্বলছিল। প্রত্যেক ঘর থেকে বের হচ্ছিল পোড়া গন্ধ।
নারীদের আতঙ্ক
হামলার পর বাড়িগুলোতে কোনো পুরুষ ছিল না। তাঁরা অন্যত্র সরে গেছেন। কয়েকটি বাড়িতে কিছু নারী ছিলেন। তাঁদের চোখেমুখে আতঙ্ক। তাঁরা জানান, গ্রামের সুজিত বিশ্বাসের বাড়িতে তিন দিনব্যাপী মতুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান চলছিল। ২২ মে ছিল দ্বিতীয় দিন।
প্রায় ৬০০ লোক আমন্ত্রিত ছিলেন। সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে জানা যায়, পাশের এক বাড়িতে খুন হয়েছে। রাত আটটার দিকে প্রথমে চার-পাঁচজন এবং পরে দেড় শতাধিক লোক এসে হামলা চালায়। লোকজন প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়।
হামলাকারীরা ঘরে ঢুকে আসবাবপত্র লুট করে ও পরে আগুন দেয়। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের হারমোনিয়াম, ঢোল ভেঙে ফেলে, খাবার নষ্ট করে দেয়। অন্তত ১০ জনকে পিটিয়ে আহত করে। সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাসকে (২৫) ধরে নিয়ে যায়।
এরপর সুন্দলী বাজারের দোকানগুলোতেও অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়। রাত ১০টার দিকে সেনাবাহিনী ও পুলিশের প্রহরায় ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা এসে আগুন নেভান।
ব্যক্তিগত সাক্ষ্য: পুড়ে যাওয়া ঘরের করুণ কাহিনী
২৭ মে ফের গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বিলের মধ্যে মাটির রাস্তা বেয়ে একটি পাকা গাঁথুনির দুই কক্ষের টিনের ছাউনির ঘর। উঠানে লেপ-কাঁথা-তোষকের পোড়া স্তুপ। বারান্দায় উঠতেই পোড়া গন্ধ। এক কক্ষে রাখা সব ধান পুড়ে গেছে। অপর কক্ষে পোড়া টেলিভিশন, টেবিল ফ্যান, খাট পড়ে আছে। মেঝে জুড়ে ছাই। বারান্দায় বসেছিলেন তরুলতা বিশ্বাস (৭৫)।
তিনি জানান, ছেলে দিলীপ বিশ্বাস (৪৬), দুই নাতনি হৈমন্তী (১৩) ও দেবশ্রী বিশ্বাস (১১) নিয়ে সংসার। ছেলে দিনমজুর। বৃহস্পতিবার রাতে হামলাকারীরা ঘরে রাখা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা নিয়ে যায় এবং পরে সবকিছু পুড়িয়ে দেয়।
এরপর থেকে ছেলে মেয়েদের নিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। ঘরে থাকার অবস্থা নেই। বারান্দায় থাকি। ভয় করে। মাঝে কয়দিন না খেয়ে থেকেছি। কেউ ভাত দিলে খাই।
আরও ধ্বংসের বর্ণনা
পাশের বাড়িতে পিয়া বিশ্বাস (২২) তাঁর পাঁচ বছরের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পাশে তাঁর শাশুড়ি চন্দ্রিকা বিশ্বাস (৭০)।
চন্দ্রিকা জানান, ছেলে বাসুদেব বিশ্বাস (৩০) ভ্যান চালান। ঘরে দেড় লাখ টাকা, তিন ভরি সোনার গয়না ছিল। সেগুলো লুট করে ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তাঁরা পাশের বিলে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান।
আসবাবপত্র, টেলিভিশন, ১৫টি মুরগি, ১৫০ কেজি চাল, বৈদ্যুতিক মোটর, সেলাই মেশিন, জমির দলিলপত্র, আইডি কার্ড সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পরদিন বাড়ি ফিরে এলেও রাতে অন্যত্র থাকতে হয়। যেটুকু খাবার পাওয়া যায়, সেটাই খাচ্ছেন।
প্রতিটি ঘরের একই করুণ দৃশ্য
তুলসী বিশ্বাস (৭৫) জানালেন, দুই ছেলে, বউমা ও দুই নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর সংসার। ঘরে থাকা আড়াই লাখ টাকা, তিন ভরি সোনা ও একটি মোটরসাইকেল লুট হয়। আগুনে ৩০ মণ ধান, চার মণ চাল, দুটি টিভিসহ সব ছাই হয়ে গেছে।
ছেলে বিষ্ণুপদ বিশ্বাস (৪৮) ও প্রদীপ বিশ্বাস (৪৭) ভয়ে বাড়ি আসতে পারছেন না। দিনে বাড়ি থাকলেও রাতে অন্যত্র থাকতে হচ্ছে।
স্মৃতি বিশ্বাস (৪৫) বলেন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের সময় হামলাকারীরা পাঁচ ভরি সোনা, ৩০ হাজার টাকা লুট করে ও তাঁকে মারধর করে। স্বামী মহিতোষ বিশ্বাস (৫০) ঘটনার পর থেকে বাড়ি ফেরেননি। সন্ধ্যা নামলে ভয় বাড়ে।
ক্ষতিগ্রস্ত আরও পরিবার
সুশান্ত বিশ্বাস (৫৬) ও তাঁর স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাস (৪৫) জানান, তাঁদের ঘরে থাকা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা লুট হয়। ১৫ মণ ধান ও সাড়ে তিন কাহন খড় পুড়ে যায়। রাতে অন্যত্র থেকে থাকতে হয়।
গৃহবধূ পান্না বিশ্বাস (৩৫) বলেন, ঘরে টিভি, ফ্রিজ, সোনা-দানা, পাসপোর্ট, প্রেসক্রিপশন, দেড় লাখ টাকা ছিল। এখন শুধু ছয়জন মানুষ বেঁচে আছেন।
আগুনে পুড়েছে পবন বিশ্বাস (৫৫), অমর বিশ্বাস (৫০), প্রতাপ বিশ্বাস (৪৫), সুকৃতি বিশ্বাস, বিকাশ বিশ্বাস (৫৬) ও প্রণব বিশ্বাসের (৩৫) বাড়িও। পবন, অমর ও প্রতাপ বিশ্বাস ঘটনার পর থেকে ফেরেননি। বিকাশ ও প্রণব দিনে বাড়ি থাকলেও রাতে অন্যত্র থাকেন।
বিরোধের মূল কারণ
স্থানীয়রা জানান, সুন্দলী ইউনিয়নের বিল বোকড়ায় তরিকুল ইসলামের একটি মাছের ঘের ছিল। ইজারার মেয়াদ শেষ হলে তিনি নতুনভাবে ঘেরটি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য এক ব্যক্তি একই জমি ইজারা নিতে আগ্রহী হন। এ নিয়ে বিরোধের জেরে ২২ মে সন্ধ্যায় তরিকুলকে পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়।