প্রারম্ভিকা: দরিদ্রতার দুষ্টচক্রে আটকে পড়া শিক্ষা
বাংলাদেশে এখনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া ৯৬ শতাংশের কাছাকাছি হলেও দারিদ্র্য, পুষ্টিহীনতা ও কাজের চাপের কারণে অনেক শিশুই পঞ্চম শ্রেণি পেরোনোর আগেই ঝরে পড়ে। গ্রাম থেকে নগর বস্তি—সবখানেই অভিভাবকদের বড় দুশ্চিন্তা, ‘পেটে ভাত না থাকলে স্কুলের খরচ মেটাব কীভাবে?’ এরই ফাঁকে এগিয়ে এসেছে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেস (এসকন)। ধর্মীয় সংগঠন হওয়ার পাশাপাশি তারা নিজেদেরকে খাদ্য, শিক্ষা ও মানবিক সহায়তার ‘পরম্পরা’ রক্ষা করার কর্মসূচির সংগঠক হিসেবে তুলে ধরছে।
এসকন বাংলাদেশ: উপস্থিতি ও সামাজসেবামূলক দায়বদ্ধতা
১৯৭৮ সালে ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রথম মন্দির স্থাপনের পর থেকে আজ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ১০০-এর বেশি আশ্রম ও কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। সংগঠনটি তিনটি মূল সেবায় জোর দেয়—ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিক্ষা-প্রচারণা ও সামাজিক সাহায্য। ‘ফুড ফর লাইফ’ শীর্ষক খাদ্য বিতরণ কর্মসূচি দিয়ে তারা দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় শিশুদের স্কুলমুখী করতে চায়।

‘ফুড ফর লাইফ’: স্কুলে টানতে বিনামূল্যের মধ্যাহ্নভোজ
এসকনের বৈশ্বিক ‘ফুড ফর লাইফ’ কর্মসূচি প্রতিদিন লাখো শিশুকে নিরামিষ, গরম, পুষ্টিকর খাবার দেয়। শিক্ষাবিদেরা বলেন, এই খাবারই অনেক দরিদ্র পরিবারকে সন্তানকে কাজে না পাঠিয়ে স্কুলে পাঠাতে উৎসাহ দেয়—কারণ স্কুল মানেই পেটভরে ভাত। একই ধারণায় ঢাকার বস্তি ও ময়মনসিংহ-কুমিল্লার গ্রামের স্কুলগুলোর পাশে এসকনের রান্নাঘর তৈরি হয়েছে; সেখান থেকে সপ্তাহে ছয় দিন খিচুড়ি-সবজি-ডাল সরবরাহ হয়।
বই, ইউনিফর্ম ও ‘রোববার স্কুল’ থেকে উচ্চশিক্ষা—বিস্তৃত উদ্যোগ
- রোববার স্কুল ও কোচিং সেন্টার—স্বামীবাগ, চট্টগ্রাম ও সিলেটে প্রতি সপ্তাহে ধর্মীয়-নৈতিক পাঠের পাশাপাশি বাংলা-গণিতের আয়োজন।
- জাগ্রত ছাত্র সমাজ—এসকনের যুব শাখা স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে টিউশন ও কুইজ কর্মশালা চালায়।
- শ্রী চৈতন্য ইনস্টিটিউট ফর হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (সিলেট)—এই প্রতিষ্ঠান ভক্তি-ভাষা-শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন স্বল্পমেয়াদি ডিপ্লোমা দিয়ে দরিদ্র তরুণদের কর্মসংস্থান সক্ষমতা বাড়ায়।
- শিক্ষা-বৃত্তি ও বই বিতরণ—এসকন ভক্তরা বছরে দু’বার গীতার বাংলা অনুবাদ, স্কুল ব্যাগ, ইউনিফর্ম ও পরীক্ষার ফি সরবরাহ করে।

দুর্যোগেও পড়াশোনা থেমে নেই
২০২২-এর সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় সরকারি স্কুলগুলো যখন পানি তলিয়ে যায়, তখন এসকনের স্বেচ্ছাসেবকরা পাঁচটি আশ্রয়কেন্দ্রে রান্না ঘাট ‘মোবাইল কিচেন’ বসিয়ে দিনে গড়ে ১,০০০ প্লেট খাবার বিতরণ করেন। এর পাশে শিশুরা যাতে পড়াশোনা ভুলে না যায়, সে জন্য খাতা-কলম বিতরণ ও ‘ফ্লাড স্কুল’ চালু করা হয়।
কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়েও ‘মায়াপুর/বাংলাদেশ কোভিড রিলিফ’ তহবিল থেকে ৮ লক্ষ ডলারের বেশি সংগ্রহ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধ, অনলাইন ক্লাসের ডেটা কার্ড ও শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।
সাফল্যের গল্প: বস্তির রুবেল থেকে কলেজের রুবেল
ঢাকার কড়াইল বস্তির একসময়ের ফেরিওয়ালা-ছেলে রুবেল ( এখন ১৮) ২০১৭ সালে এসকনের ‘ফুড ফর লাইফ’ রান্নাঘরের খাবার পেয়ে নিয়মিত স্কুলে যেতে শুরু করে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে বৃত্তি পেলে সংগঠনটি তার বই-খাতা-ইউনিফর্মের খরচ তুলে নেয়। রুবেল এখন দারিদ্র্য বিমোচন প্রশিক্ষণ প্রকল্পে স্কলারশিপ পেয়ে সিটি কলেজে বাণিজ্য পড়ছে, একই সঙ্গে সপ্তাহান্তে ছোটদের গণিত পড়ায়—চক্রটা আরেক ধাপ সামনে এগিয়ে দিল।

চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের প্রচেষ্টা
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে এসকনের কিছু গুরুকুলায় শিশু-নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল; তবে বাংলাদেশ ইউনিট ২০১৯-এ ‘চাইল্ড প্রোটেকশন পলিসি’ প্রণয়ন করে সব শিক্ষাকেন্দ্রে ট্রেনিং ও মনিটরিং শুরু করেছে। অভিভাবকদের জন্য খোলা ফিডব্যাক ডেস্কও রাখা হয়েছে।
‘কোনো শিশু ক্ষুধার্ত থাকতে পারবে না’
১৯৭২-এ প্রতিষ্ঠাতা আচার্য শ্রীল প্রভুপাদ নির্দেশ দিয়েছিলেন, “মন্দিরের দশ মাইলের মধ্যে যেন কেউ অনাহারে না থাকে।” আজ সেটি রূপ নিয়েছে পুষ্টিকর খাবার, বই-খাতা, কোচিং আর মানবিক সহায়তার পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা-পরিকল্পনায়। সরকারী কর্মসূচির বাইরে বেসরকারি উদ্যোগ হিসেবে এসকনের এ ধারাবাহিক কাজ প্রমাণ করেছে—সঠিক পুষ্টি ও নৈতিক-মানবিক শিক্ষার সহাবস্থানই পারে দরিদ্র শিশুদের জীবনে আলো জ্বালাতে।
শিক্ষা-সহায়তার এই মডেল যদি সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রচেষ্টায় আরও সম্প্রসারিত হয়, তবে ‘শিক্ষা হোক সবার অধিকার, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থাকুক অতীত’—এ স্বপ্ন হয়তো আর দূরে থাকবে না।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















