আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে কম খরচে মামলা নিষ্পত্তি, মানবাধিকার নিশ্চিত ও মানুষকে মামলার অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে আইন মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তিনি বলেন, এজন্য সিপিসি এবং সিআরপিসি অধ্যাদেশ নিয়েও কাজ চলছে। শনিবার আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০ অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ নিয়ে বিভিন্ন অংশীজনের সাথে আলোচনা শেষে তিনি এ কথা বলেন।
আইন উপদেষ্টা অনুষ্টানে বলেন ,আইন মন্ত্রণালয় থেকে তিনটি সংস্কার নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। দ্রুত সময়ে অল্প খরচে মামলার নিষ্পত্তি করতে সিভিল প্রসিডিউর কোড সংশোধন করা; ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ডিজিটালাইজেশন করা এজন্য আমরা বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি ও তাদের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণের বিষয়ে চিন্তা করছি; মামলার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে আমরা আইনগত সহায়তা দেওয়া সংস্থাগুলোর আইন পরিবর্তন করতে যাচ্ছি, এতে করে বছরে দায়ের করা মামলা ৪০ শতাংশ কমে যাবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, মামলার প্রবহমান ও অস্বাভাবিক চাপ কমানোর জন্য আপস-মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এ লক্ষ্যে দ্রুত কাজ করছে আইন মন্ত্রণালয়। ‘ন্যায়বিচার নিশ্চিতে বিচারকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া সহ নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে ।’ মামলার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে আইনগত সহায়তা প্রদান আইনের সংশোধন করা হচ্ছে বলেও জানান আসিফ নজরুল। ছোট ছোট ও আপসযোগ্য মামলা আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে আপসে বাধ্যতামূলক করা হবে জানান আইন উপদেষ্টা।
এ সভায় উপস্থিত ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা। এছাড়া ঢাকা জেলার লিগ্যাল এইড অফিসার, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা জেলার আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা, ইউএনডিপি বাংলাদেশ, জিআইজেড বাংলাদেশ, আইএলও, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন, ব্লাস্ট, ব্র্যাক ও প্রশিকা’র প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ড. আসিফ নজরুল বলেন, আদালতে মামলার যে অস্বাভাবিক চাপ, তা শুধু বিচারিক কাঠামোকে নয়, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। নতুন মামলার চাপ কমানো সময়ের দাবি। এ চাপ কমাতে হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য মামলা দায়েরের পূর্বে আপস-মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক করা গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরো বলেন , তিনি বলেন, সরকারি আইনগত সহায়তা কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারিত, দক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারলে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মীমাংসিত মামলার সংখ্যা এক থেকে দুই লাখে নিয়ে আসা যাবে। এটি করা গেলে মামলা দায়েরের পরিমাণ ৪০ শতাংশ কমে যাবে। আইন উপদেষ্টা আরো বলেন , প্রথম থেকেই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা সংস্কার কার্যক্রমের ব্যাপারে তিনটি টার্গেট করেছি। এর প্রথমটি হচ্ছে, দ্রুত ও স্বল্পতম সময়ে ও অল্প খরচে মামলার নিষ্পত্তি করা। এই লক্ষ্যে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বর্পূর্ণ একটা পরিবর্তন করেছি, সেটি হলো- দেওয়ানি কার্যবিধির পরিবর্তন । সেইসঙ্গে ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধনের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছি। আশা করি, আগামী এক মাসের মধ্যে এটি আইন আকারে পাশ করতে পারব।আমাদের দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো-ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং এর জন্য আমরা ডিজিটালাইজেশনের কথা চিন্তা করছি। এ লক্ষ্যে আমাদের বিচারকদের উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণের কথা ও তাদের একাউন্টেবিলিটি বাড়ানোর কথা চিন্তা করছি। বিচারক বা আইন বিভাগে কর্মরতদের সবার সম্পদের বিবরণী আমরা সংগ্রহ করেছি, সেটা নিয়ে আমরা ভবিষ্যতে কাজ করব। সেইসঙ্গে আইনজীবীদের সাথে কাজ করে আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের তৃতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, মামলার অভিশাপ থেকে মানুষকে মুক্তি দেওয়া। এই লক্ষ্য পূরণ করতে আমরা আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার অধীনে সংশ্লিষ্ট যে আইনগুলো আছে, সেগুলো পরিবর্তন করতে যাচ্ছি।
আইনগত সহায়তা প্রদান আইন সংশোধন প্রসঙ্গে আইন উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থায় প্রথম সভায় তিনি জেনেছেন, প্রতিবছর গড়পড়তা দেশে ৫ লাখ মামলা হয়। সেখানে সরকারি আইনগত সহায়তার মাধ্যমে ৩৫ হাজার মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। আদালতের তুলনায় এখানে নিষ্পত্তিতে সময় কম লাগে এবং ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তুষ্ট থাকেন। এটা বড় সুযোগ। যদি আইনগত সহায়তা কর্মসূচিকে আরও সম্প্রসারণ, দক্ষ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমৃদ্ধ করতে পারলে মধ্যস্থতার মাধ্যমে মামলা নিষ্পত্তি এক থেকে দুই লাখে নেওয়া যাবে। এক লাখে অবশ্যই পারা যাবে। তাঁদের লক্ষ্য দুই লাখে নিয়ে যাওয়া। কেউ মধ্যস্থতায় সন্তুষ্ট না হলে মামলা করার সুযোগ থাকছেই বলে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন ‘মধ্যস্থতার জন্য আসাটা বাধ্যতামূলক করছি, মধ্যস্থতার রায় মেনে নেওয়াকে বাধ্যতামূলক করছি না। কাজেই কারও অধিকার কেড়ে নেওয়ার ব্যাপার এখানে থাকছে না।
সভায় জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার পক্ষ থেকে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ এর খসড়া উপস্থাপনা করা হয়। প্রস্তাবিত এ সংশোধনীতে আপসযোগ্য ও ছোট পারিবারিক, দেওয়ানি, ফৌজদারি ও চেকের মামলাগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে মামলাপূর্ব মধ্যস্থতা কার্যক্রমের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়। ফলে এধরনের মামলাগুলো আদালতে দায়ের করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে আবশ্যিকভাবে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আপসের চেষ্টা করতে হবে। এছাড়াও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসের সক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধি, অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ও বিশেষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবীদের বিশেষ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্যানেলভুক্তকরণ এবং এ আইনের মধ্যস্থতা-সেবাকে আরও ফলপ্রসূ, কার্যকর ও জনবান্ধব করার উদ্দেশ্যে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এবং আইনগত সহায়তা প্রদান (আইনি পরামর্শ ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি) বিধিমালা, ২০১৫-সহ সংশ্লিষ্ট বিধি-প্রবিধানমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধন আনার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।