এক সময়ের খরস্রোতা, প্রাণবন্ত বংশী নদী আজ মুমূর্ষু। নদীর পাড়ে দাঁড়ালে যে প্রাণচঞ্চল স্রোতের শব্দ একসময় কানে বাজতো, আজ সেখানে নিস্তব্ধতা। পানির রং ঘোলাটে, কালো, অনেক স্থানে দুর্গন্ধ ছড়ায়। নদীর বুক ভরাট হয়ে গেছে মাটি, বালু, বর্জ্য আর কলকারখানার বিষাক্ত দূষণে। নাব্যতা হারিয়ে অনেক স্থানে নদীটি শুকিয়ে গেছে সরু খালে। মাছের অভয়ারণ্য আজ প্রায় শূন্য। এক সময় এই নদী ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে আরিচা, মানিকগঞ্জ, সাভার, ধামরাই, নবীনগরসহ বৃহৎ অঞ্চলের বানিজ্যিক রুট। কিন্তু সে ইতিহাস এখন কেবলই স্মৃতি।
ইতিহাসের পাতায় বংশী নদী
বংশী নদীর জন্ম গারো পাহাড় থেকে আসা ছোট ছোট স্রোতধারা থেকে। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর একটি শাখা। সাভার, ধামরাই, মানিকগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটি ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিলিত হয়। প্রাচীনকালে বংশী নদী ছিল জনপদের জীবনধারার অংশ। নদীটি কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, যাতায়াত ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল।
মুঘল আমল, ব্রিটিশ শাসন, এমনকি পাকিস্তান আমলেও বংশী নদীর গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। ধানের গোলা, সুতার গুদাম, মাটির হাড়ি-কুপি, সোনার অলংকারের ব্যবসা, এমনকি ঢাকার বিখ্যাত মসলিন কাপড়ও এই নদীপথ দিয়ে যাতায়াত করত। ব্যবসায়ীরা বংশীকে ঘিরে গড়ে তুলেছিল সমৃদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র।
পঞ্চাশ বছর আগের বংশী: জীবন্ত স্বর্গ
আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে বংশী নদী ছিল এক দুর্দান্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। স্রোতস্বিনী নদীতে ঝলমলে পানির প্রবাহ, স্বচ্ছ নীলাভ জলরাশি, পাড়ে সবুজ গাছের সারি, পাখির কলকাকলি—সব মিলিয়ে এক মুগ্ধকর দৃশ্য।
তখন বংশীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল, চিতল, পাবদা, শোল, গজার, ট্যাংরা, কাচকি, পুঁটি, আইড়—কি পাওয়া যেত না? জেলেরা দিন-রাত জাল ফেলে মাছ ধরতো। প্রতিদিন ভোরবেলা স্থানীয় হাটে মাছের বাজার বসত। নদীর জল ছিল এতটাই নির্মল যে নদীতে স্নান করা, কাপড় ধোয়া কিংবা পান করার মতো স্বচ্ছতা বজায় ছিল।
বংশী ছিল বানিজ্যিক যোগাযোগের প্রাণ
ঢাকার সঙ্গে এই অঞ্চলের বানিজ্যিক যোগাযোগে বংশীর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। নৌকা, বজরা, পাথরবাহী বড় বড় কার্গো চলতো। ধান, চাল, সুতার তৈরি কাপড়, মাটির তৈজসপত্র, কাঁচা চামড়া, সুতার বল, কাঠসহ নানাবিধ পণ্য এই নদীপথ দিয়ে পরিবহণ করা হতো। ঢাকার নারায়ণগঞ্জ, শ্যামবাজার, সদরঘাটের সঙ্গে এই অঞ্চলের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল নিবিড়। তখন সড়ক যোগাযোগ ছিল দুর্বল। ফলে বংশী ছিল প্রধানতম ভরসা।
এছাড়াও সাভারের ইটভাটা, ধামরাইয়ের স্বর্ণকার পল্লী, সিংগাইরের কৃষিজ পণ্য সহজেই পৌঁছে যেত রাজধানীতে।
ধ্বংসের শুরু
১৯৮০’র দশক থেকে বংশীর অবনতি শুরু হয়। শিল্পায়নের প্রসার, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, নদী দখল, পলি জমে যাওয়া এবং নাব্যতা সংকটে পড়া—এসব মিলিয়ে ধীরে ধীরে নদীটি সংকুচিত হতে থাকে। সাভার ইপিজেড, আশুলিয়ার গার্মেন্টস, ধামরাইয়ের ছোট ছোট কারখানা, ট্যানারি বর্জ্য, পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য বংশীর সর্বনাশ ডেকে আনে। নদীর তীর দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বসতবাড়ি ও অবৈধ স্থাপনা।
বর্তমান সংকট: শ্বাসরুদ্ধ বংশী
বর্তমানে বর্ষা মৌসুম ছাড়া বাকি সময় বংশীর অনেক স্থানে হাঁটু পানি থাকে। অনেক জায়গায় সেটুকুও থাকে না। মাছ প্রজাতির বৈচিত্র্য প্রায় বিলুপ্ত। আগে যেখানে জেলেদের জাল টেনে তুলে কাতার করে মাছ সাজানো হতো, এখন সেখানে শূন্য জাল উঠে আসে। নদীর প্রাণবৈচিত্র্য আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ দখল, বিষাক্ত বর্জ্য, পলি পড়া এবং প্রশাসনিক উদাসীনতাই এর প্রধান কারণ। সাভার পরিবেশ উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের প্রধান বলেন, ‘‘বংশী এখন প্রায় মৃত। দ্রুত ও সুপরিকল্পিত উদ্যোগ না নিলে একদিন হয়তো মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাবে এই নদী।’’