বর্ষার জল ও জীবনের প্রত্যাবর্তন
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনজীবনে বর্ষাকাল কেবল একটি ঋতু নয়, এটি এক জীবন্ত সংস্কৃতি। আষাঢ়-শ্রাবণের বৃষ্টিপাত যখন মাঠ-ঘাট প্লাবিত করে, তখন শুকনো ধানের খেত, ফাটল ধরা মাটির আল আর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত খাল-বিল আবার জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই নতুন পানির স্রোতের সঙ্গে গ্রামে ফিরে আসে বহুপ্রতীক্ষিত প্রাণ—ছোট মাছ। শুধু পুষ্টির উৎস নয়, এই মাছগুলো গ্রামীণ জীবনের আবেগ, সংস্কৃতি ও টিকে থাকার প্রতীক।
নতুন পানির প্রথম অতিথিরা
জুনের মাঝামাঝি থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও হাওর এলাকায় নতুন পানি জমা হতে শুরু করে। এই পানির সঙ্গে সঙ্গে আসে নানা জাতের দেশি মাছ—পুঁটি, ট্যাংরা, চিংচি, কৈ, শিং, মাগুর, গজার, খলিশা, চান্দা, ফলি, বোয়াল, বাইন, বাতাসি—যাদের অনেকেই সারা বছর একবারও জালে ওঠে না।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো স্বাভাবিক প্রজননের মাধ্যমে ছোট ছোট জলাশয়ে বংশবিস্তার করে। নতুন পানির প্রবাহ সেই ডিম ও পোনাকে প্রবাহিত করে মাঠ-ঘাটে ছড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন পানির সাত-দশ দিনের মধ্যেই শুরু হয় মাছ ধরা।

মাছ ধরার উৎসব
সকালের প্রথম আলোয় গ্রামীণ প্রান্তরে শুরু হয় মাছ ধরার দৃশ্য। বালতির পাশে দাঁড়ানো শিশুরা মুখভর্তি হাসি নিয়ে জালে ধরা পুঁটি বা ট্যাংরাকে কৌতূহলের সঙ্গে দেখে। নারীরা ‘খুন্তি’, ‘বেলু’ বা হাতে তৈরি ‘কোঁচ’ দিয়ে ধানের গোড়ায় মাছ খোঁজে, ছেলেরা বাঁশের তৈরি ঢালা, তোপা বা বেহুন্দি নিয়ে নামে খাল-বিলে।
অনেক এলাকায় এটি পরিণত হয় ছোটখাটো উৎসবে। একসঙ্গে ২০-২৫ জন গ্রামবাসী মিলে ধানক্ষেতে ‘হাতা’ বা ‘হাঁড়া’ পদ্ধতিতে জাল পেতে মাছ ধরে। মাছ কম হলেও আনন্দ থাকে পূর্ণমাত্রায়।
পুষ্টির আধার ছোট মাছ
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিতে ছোট মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। গবেষণা বলছে, দেশি ছোট মাছ যেমন পুঁটি, মেনি, খলিশা, শিং, টেংরা—সবগুলোরই হাড়সহ খাওয়া যায় এবং এতে থাকে প্রচুর ক্যালসিয়াম, আয়রন, জিঙ্ক ও ভিটামিন-এ। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই মাছ অত্যন্ত উপকারী।
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১০০ গ্রাম ছোট মাছ দৈনিক ক্যালসিয়ামের প্রায় ৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। অথচ এই মাছই এখন দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।

বিলুপ্তির হুমকিতে দেশি মাছ
প্রাকৃতিক মাছের উৎসগুলো আজ নানা কারণে হুমকির মুখে। অপরিকল্পিত পুকুর খনন, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, জলাশয় ভরাট, অপরিকল্পিত সড়ক ও বাঁধ নির্মাণে খাল-বিলের সঙ্গে প্রধান নদীর সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেছে। ফলে প্রাকৃতিক প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে।
তাছাড়া, প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের ওপর চাহিদা বেশি হলেও জেনেটিকভাবে অপরিশুদ্ধ পোনা ছাড়ার কারণে প্রকৃত দেশি জাতগুলো বিলুপ্তির পথে। বিশেষ করে কৈ, শিং, মাগুর, টেংরা—এদের প্রকৃত প্রজাতি আজকাল খুঁজে পাওয়াই কঠিন।
নতুন প্রজন্ম ও হারিয়ে যাওয়া স্বাদ
বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই আর জানেই না কৈ মাছের মজাদার কালিজিরা ভুনা, পুঁটির টক ঝোল, শিং-মাগুরের ডালনা বা খলিশার ভাজা কেমন ছিল। শহুরে হোটেল-রেস্তোরাঁয় এসব মাছের দেখা মেলে না। এমনকি গ্রামের বাজারেও ছোট মাছ এখন ‘দুষ্প্রাপ্য’ তালিকায় চলে গেছে। যারা এখনও মাঝে মাঝে এসব মাছ খেতে পায়, তারা একে ভাগ্যের সৌভাগ্য হিসেবে গণ্য করে।
এই হারিয়ে যাওয়া স্বাদের পেছনে কারণ শুধু সরবরাহ নয়, গ্রামীণ জীবনের বদলও। আগের মতো শিশু-কিশোররা আর মাছ ধরায় অংশ নেয় না; তরুণ প্রজন্মও কৃষিকাজ ও জলজ জীববৈচিত্র্যে আগ্রহ হারাচ্ছে।

টিকিয়ে রাখার সম্ভাবনা ও উদ্যোগ
তবে আশার আলোও আছে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এখন দেশি মাছের সংরক্ষণে কাজ করছে। মৌসুমি জলাশয়গুলোতে নিয়ন্ত্রিতভাবে পোনা ছাড়া হচ্ছে, দেশি জাত ফিরিয়ে আনতে গবেষণা চলছে। কিছু এলাকায় বর্ষাকালীন মাঠকে মাছের প্রজননক্ষেত্র ঘোষণা করে ৩০-৪৫ দিনের জন্য মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যেন পোনাগুলো বড় হয়ে ওঠে।
গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, নওগাঁ, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলে বর্ষার পানিতে চাষযোগ্য মাছের পাইলট প্রকল্প চলেছে—যেখানে ধানক্ষেতেই দেশি মাছ চাষের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
বাঁচতে হলে ফিরিয়ে আনতে হবে প্রকৃতি
বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও ছোট মাছ একে অপরের পরিপূরক। প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য ছাড়া খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বর্ষাকালের এই নতুন পানির ঢল আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রকৃতি এখনও আমাদের কিছু ফিরিয়ে দিতে চায়—শুধু দরকার সচেতনতা, সংরক্ষণ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা।
ছোট মাছ শুধু খাদ্য নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও টিকে থাকার উপকরণ। এই বর্ষায় যখন আবার ধানখেত ভরে উঠবে পুঁটি-ট্যাংরার দাপটে, তখন আসুন আমরা শুধু খাবার জন্যে নয়, এসব মাছকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্বও নেব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















