কেক আর গল্প—অ্যাবি জিমেনেজের জোড়া পরিচয়
মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের ম্যাপল গ্রোভে অবস্থিত নাদিয়া কেকস নামের বেকারিতে যখন অ্যাবি জিমেনেজ পৌঁছান, তখন তাঁকে ঘিরে শুরু হয় ভক্তদের উচ্ছ্বাস। কেউ বইয়ের স্বাক্ষর চান, কেউবা ছবি তুলতে চান। সাতটি সফল প্রেমের উপন্যাসের লেখিকা এবং তিনটি বেকারির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে জিমেনেজ এখন যুক্তরাষ্ট্রে এক পরিচিত মুখ।
তাঁর সাম্প্রতিক উপন্যাস ‘Say You’ll Remember Me’ ১ এপ্রিল প্রকাশের পরই বেস্টসেলারে পরিণত হয়েছে। এটি প্রকাশ উপলক্ষে তিনি আটটি শহর ঘুরেছেন, নানা ঘটনায় ভরা সেই সফরের মধ্যে ছিল টরন্টোর এক অনুষ্ঠানে ফায়ার অ্যালার্ম বাজতে শুরু করা এবং ‘অত্যন্ত আকর্ষণীয়’ দমকলকর্মীদের আগমন—যা পরে ভাইরাল হয়।
বেকার থেকে বেস্টসেলিং লেখিকা
অ্যাবি জিমেনেজের যাত্রা শুরু হয়েছিল একেবারে সাধারণ জীবন থেকে। তিনি ওয়াশিংটন ও লস অ্যাঞ্জেলেসের উত্তরে বড় হয়েছেন একক পিতার কাছে। কলেজে যেতে পারেননি, কারণ ১৬ বছর বয়স থেকেই জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ শুরু করতে হয়েছিল। ফাস্টফুড দোকান, রিটেইল শপ, সব জায়গাতেই কাজ করেছেন—ডেল টাকো থেকে নিউ ইয়র্ক অ্যান্ড কোম্পানির মতো জায়গা পর্যন্ত।
২০০৭ সালে যখন তিনি তৃতীয়বার গর্ভবতী, সেই সময় কর্মস্থলে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হন। তখন বাড়িতে বসে অর্থ আয়ের উপায় খুঁজতে গিয়ে শুরু করেন কেক তৈরির কাজ। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ‘নাদিয়া কেকস’—যা নিজের মেয়ে নাদিয়ার নামে নামকরণ করেন।
পারিবারিক সংগ্রাম ও উদ্যোগের শুরু
প্রথমে রান্নাঘরেই শুরু হয়েছিল কাজ। কেক বেকিং থেকে শুরু করে ক্লায়েন্টদের সঙ্গে মিটিং—সবই চলতো এক হাতে। এক সময় তাঁর সন্তান বিয়ের কেক নষ্ট করে ফেলেছিল, আরেকবার একজন গর্ভবতী নারী বাথরুমে আটকে পড়েছিলেন। এমন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই পারিবারিক সহায়তায় গড়ে ওঠে ব্যবসা। তবে সেটি সম্ভব হয়েছিল উচ্চ ঋণ এবং সবকিছু বাজি রাখার সাহসেই—একসময় তাদের ঋণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৪৩ হাজার ডলারে।
২০১১ সালে পরিবার নিয়ে তারা মিনেসোটায় চলে আসেন এবং খুলেন নতুন দোকান—ম্যাপল গ্রোভে প্রথম এবং পরে উডবুরিতে দ্বিতীয় আউটলেট। স্বামী চাকরি ছেড়ে বেকারির ব্যবস্থাপনায় যুক্ত হন এবং জিমেনেজ ধীরে ধীরে লেখালেখির দিকে ফিরে যান।
লেখিকার জগতে প্রবেশ
এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে ক্যাম্পিংয়ে মেয়েদের শোনানো একটি গল্প থেকেই শুরু হয় তাঁর লেখার জগতে যাত্রা। প্রথম বই এজেন্টদের দ্বারা ফিরিয়ে দেওয়া হলেও তিনি ‘ক্রিটিক সার্কেল’ নামের একটি অনলাইন লেখক গোষ্ঠীতে যুক্ত হয়ে লেখালেখির কৌশল আয়ত্ত করেন।
এরপর আসে ‘The Friend Zone’—২০১৯ সালে প্রকাশিত এই বই ছিল তাঁর প্রথম বেস্টসেলার। যদিও কিছু পাঠক বইয়ে বন্ধ্যাত্ব নিয়ে লেখার ধরনে আপত্তি তোলেন, এরপর থেকেই জিমেনেজ তাঁর বইয়ে ‘ট্রিগার ওয়ার্নিং’ যুক্ত করতে শুরু করেন।
বই ও বেকারির যুগল সাফল্য
গত ছয় বছরে তাঁর বইয়ের মুদ্রিত সংস্করণ বিক্রি হয়েছে ১৬ লাখ কপি এবং ই-বুক বিক্রি ১৫ লাখেরও বেশি। বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে কেকও তৈরি হয়—যেমন, ‘Say You’ll Remember Me’ বইয়ের সঙ্গে বিক্রি হয় নীল গুয়াভার কেক, গোলাপি চিজ ফ্রস্টিংয়ের ওপর ছোট লাল হৃদয় চিহ্নসহ।
প্রতিটি বই প্রকাশে ভক্তরা ভিড় করেন নাদিয়া কেকসে। দোকানের দীর্ঘ লাইনের ভেতরে অনেকে অপেক্ষা করেন শুধু বই হাতে পাওয়ার জন্য। বই প্রকাশের সময় এমন হিড়িক পড়ে যে, বই হাতে পেয়েই অনেকে বলে ওঠেন, “এখন পড়তে হবে, তাড়াতাড়ি দোকান থেকে বেরোই!”
ক্লান্তি, উপলব্ধি ও বিরতি
জিমেনেজ বলেন, “গত ৩০ বছরে একদিনও আমি কাজ না করে কাটাইনি।” এত শ্রম আর সাফল্যের মধ্যেও তিনি এক মুহূর্তের জন্য থেমে সন্তানদের দিকে তাকিয়ে ভাবেন—“ইশ! ওদের আরও বেশি সময় জড়িয়ে ধরতে পারতাম। এত ক্লান্ত ছিলাম, এমন অনেক বছর গেছে যেগুলো এখন আর মনে পড়ে না।”
এই ক্লান্তি থেকেই তিনি ঘোষণা দেন তিন মাসের বিশ্রামের, যাতে আবার নিজেকে খুঁজে নিতে পারেন।
তবে বই লেখা বা নাদিয়া কেকস—কোনো কিছুই ত্যাগ করছেন না তিনি। বরং, তিনি এই দুইটি ক্ষেত্রকে মিলিয়ে নিজের জীবনের গল্পই নতুন করে লিখছেন। শেষ কথায় তিনি বলেন, “যদি আমি ১৬ বছর বয়সের সেই নিজেকে একবার বলতে পারতাম—সব ঠিক হয়ে যাবে, তাহলে সেটাই হতো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্বাস।”