শুরুর দিনগুলো
ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রহমতগঞ্জ মুসলিম ফ্রেন্ডস সোসাইটি (এমএফসি) ক্লাবের জন্ম ১৯৩৩ সালে পুরান ঢাকার রহমতগঞ্জ এলাকায়। মুসলিম যুবকদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে গঠিত এই সংগঠনটি পরবর্তীতে দেশের ফুটবল ইতিহাসে নিজেদের গৌরবময় পরিচয় গড়ে তোলে। ব্রিটিশ ভারতের সময়ে ক্লাবটি শুধু খেলাধুলার জন্য নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সচেতনতাও ছড়িয়ে দিতে কাজ করত।
স্বাধীনতা-পূর্ব ও পরবর্তী কালের সাফল্য
রহমতগঞ্জ ক্লাব ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ঢাকার স্থানীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে নিয়মিত অংশগ্রহণ করত। তারা কখনোই ধনী পৃষ্ঠপোষকের ছত্রছায়ায় থাকেনি, বরং স্থানীয় খেলোয়াড়, সমর্থক ও সংগঠকদের উপর নির্ভর করে শক্তি সঞ্চয় করেছিল। স্বাধীনতার পর রহমতগঞ্জ দ্রুত ঢাকার প্রথম বিভাগ ফুটবলে নিজেদের স্থান নিশ্চিত করে।
১৯৭৫ সালে ক্লাবটি প্রথমবারের মতো ঢাকা লিগে রানারআপ হয়ে চমক দেখায়। ওই সময়ে রহমতগঞ্জ ছিল এক ‘জায়ান্ট কিলার’—বড় বড় ক্লাব যেমন মোহামেডান, আবাহনী, ব্রাদার্স ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করত সাহসিকতার সঙ্গে।
ঢাকার ফুটবলে এক ব্যতিক্রমী চিহ্ন
রহমতগঞ্জ এমএফসি কখনোই প্রচারের আলোয় ছিল না। তারা কখনো বড় স্পন্সরের জন্যে লড়েনি, বরং নিজেরদের স্বল্প সম্পদ, ছোট মাঠ, ও পুরান ঢাকার আবেগ নিয়ে মাঠে নেমেছে। রহমতগঞ্জ ক্লাব প্রমাণ করেছে যে ফুটবল শুধুই অর্থ আর আধুনিক সুযোগ-সুবিধার খেলা নয়, বরং কমিটমেন্ট ও সংগ্রামেরও প্রতীক হতে পারে।
২০১৬ সালে রহমতগঞ্জ ক্লাব আবারো জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় আসে। তারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কাপ (বিপিএল ফেডারেশন কাপ) টুর্নামেন্টে রানারআপ হয়। ফাইনালে শেখ জামালের কাছে হেরে গেলেও তাদের ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ক্লাবের ঘরোয়া অবকাঠামো ও চ্যালেঞ্জ
রহমতগঞ্জ এমএফসি এখনও পর্যন্ত নিজস্ব আধুনিক ক্লাবহাউস বা প্রশিক্ষণ মাঠ তৈরি করতে পারেনি। তারা পুরান ঢাকার ছোট পরিসরের ভাড়া করা মাঠে অনুশীলন করে এবং ম্যাচের সময় কমলাপুর স্টেডিয়াম বা বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম ব্যবহার করে।
তবে ক্লাবটি আজও টিকে আছে মূলত একনিষ্ঠ সংগঠক, কোচ এবং স্থানীয় খেলোয়াড়দের ভরসায়। তারা সাধারণত ঢাকা মহানগরী ফুটবল লীগ ও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে অংশগ্রহণ করে, তবে তাদের পারফরম্যান্স ওঠানামা করে।
একঝাঁক সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়ের জন্ম
রহমতগঞ্জ ক্লাব থেকে অনেক প্রতিভাবান খেলোয়াড় উঠে এসেছেন যারা পরবর্তীতে জাতীয় দলে খেলেছেন বা বড় ক্লাবে সুযোগ পেয়েছেন। এই ক্লাব তরুণদের জন্য একটি ‘লঞ্চিং প্যাড’ হিসেবে কাজ করে। রাস্তাঘাটে খেলা ছেলেরা এই ক্লাবের মাধ্যমে পেশাদার ফুটবলে নিজেদের পরিচিত করে তুলেছে।
পুরান ঢাকার ফুটবল আবেগের প্রাণ
রহমতগঞ্জ শুধু একটি ক্লাব নয়, এটি পুরান ঢাকার মানুষের আবেগ। মোহামেডান বা আবাহনীর মতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু না হলেও, রহমতগঞ্জ ক্লাব নিয়ে স্থানীয়দের গর্বের শেষ নেই। প্রতি ম্যাচে মাঠে বসে থাকা পুরান ঢাকার দর্শকদের চিৎকার প্রমাণ করে—এই ক্লাব এখনও জীবিত, এখনও প্রাসঙ্গিক।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
বর্তমানে রহমতগঞ্জ এমএফসি অর্থনৈতিক সংকট, আধুনিক ব্যবস্থাপনার অভাব ও পৃষ্ঠপোষকতার সংকটে ভুগছে। তবে তরুণদের ফুটবলে আগ্রহ, সংগঠকদের অদম্য মনোবল এবং পুরান ঢাকার ভালোবাসা তাদের টিকিয়ে রেখেছে।
যদি সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ফুটবল অবকাঠামো উন্নয়ন করা যায়, তবে রহমতগঞ্জ ক্লাব আবারও জাতীয় পর্যায়ে আলো ছড়াতে পারে। তাদের গল্প শুধু ফুটবলের নয়, বরং সংগ্রাম ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক অনন্য উদাহরণ।
ঢাকার ফুটবল ইতিহাসের এক নীরব নায়ক রহমতগঞ্জ এমএফসি। ইতিহাসে তাদের স্থান হয়তো পৃষ্ঠার নিচের দিকে, কিন্তু চেতনার ভেতর তারা অন্যতম গর্ব। টাকার অভাব, সুযোগ-সুবিধার সীমাবদ্ধতা, এবং নামি-দামি ক্লাবের ভিড়ে হারিয়ে না গিয়ে, তারা টিকে আছে অদম্য ভালোবাসা ও লড়াইয়ের শক্তিতে।