০১:৪০ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৬ জুলাই ২০২৫
শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা পাকিস্তানে সীমাহীন শ্রমিক শোষণ আলেকজান্দ্রিয়ার প্রাসাদে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক: ক্লিওপেট্রা ও সিজারের কথোপকথন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪৯) বাংলাদেশে ইভ টিজিং- নারী মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার সংকট এপি’র প্রতিবেদন: হাসিনা-বিরোধী বিদ্রোহের পরিণতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ মধুমতী নদী: দক্ষিনের যোগাযোগ পথ মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল ধ্বংস করা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর চিরসবুজ নায়িকা মৌসুমী: রূপালী পর্দার এক যুগের প্রতীক কাপ্তাই লেকের মাছের বৈচিত্র্য ও মাছ ধরার রীতি – পার্বত্য চট্টগ্রামের জলে জীবনের গল্প

বাংলার ফুটবলে চার মহারথী

  • Sarakhon Report
  • ০৬:৩৭:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫
  • 74

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবল এমন এক আবেগ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিহরিত করে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বছরগুলোতে ফুটবল ছিল শহরের অলিগলি থেকে গ্রামীণ মাঠ—সবখানে ‘এক নম্বর’ বিনোদন। উচ্ছ্বাসভরা সেই দিনগুলোর নায়ক ছিলেন চার ফুটবল-মহাতারকা: কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও মনেম মুন্না। তাঁদের পায়ের জাদু, ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্ব একসময় গোটা জাতিকে এক সুতোয় বেঁধেছিল, গড়ে দিয়েছিল ফুটবল সংস্কৃতির অমূল্য ভিত্তি। এই চার কিংবদন্তিকে নিয়েই আজকের এই বিশেষ আয়োজন।

কাজী সালাউদ্দিন—স্বপ্ন দেখানোর প্রথম পোস্টার বয়

১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি লিগে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের হাতে জাতীয় দল গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন—এটাই ছিল সালাউদ্দিনের প্রথম বড় সিদ্ধান্ত। ঢাকার ফুটবল লিগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আক্রমণভাগে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠে ‘সালাউদ্দিন-গলি-পাস’ নামের দুরন্ত কৌশল, যেটি রক্ষণভাগকে হিমশিম খাওয়াত।

  • আন্তর্জাতিক অবদান: ১৯৭৩ সালের মার্চে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচেই গোল করে ‘ম্যাচ জয়ী’ তকমা পান। ১৯৮০-এর এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে তাঁর গোল দুর্দান্ত নিয়মিত ফর্মের প্রমাণ।
  • ধীশক্তি ও নেতৃত্ব: খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ দিকে স্ট্রাইকার থেকে সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডে নেমে গিয়ে দলের তরুণদের জন্য বল সরবরাহ করতেন—প্রমাণ করে দিলেন, ফুটবল কেবল গতির নয়, মস্তিষ্কেরও খেলা।
  • পরবর্তী ভূমিকা: অবসরের পর কোচিং, ধারাভাষ্য আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দায়িত্ব নিয়ে কাঠামোগত সংস্কারে নেতৃত্ব দেন। তাঁর হাত ধরেই স্বাধীনতা কাপ, জায়ান্ট-কিলিং সুপার কাপের মতো জনপ্রিয় ঘরোয়া আসর নতুন করে প্রাণ পায়।

 আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু—বাঁ পায়ের জাদুকর

ময়মনসিংহের ছেলে চুন্নু ঢাকার মাঠে প্রথম আলো ছড়ান ১৯৭৫-এ। বাঁ প্রান্ত ধরে চোখধাঁধানো দৌড়, ঝড়ের গতি আর কার্ভিং ক্রসে দ্রুতই হন সমর্থকদের প্রিয়।

  • ঐতিহাসিক গোল: ১৯৭৮ এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট গোলটি আসে তাঁর পা থেকে। আবার ১৯৮৫ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম কোয়ালিফায়ার গোলও করেন তিনিই।

  • দলের মেরুদণ্ড: ক্লাব পর্যায়ে আবাহনীর বাইরে খেলেননি—এক ক্লাবের প্রতি এমন স্থায়ী আনুগত্য সে সময় বিরল উদাহরণ। সহজ পাস, নিখুঁত ক্রস আর ফ্রি-কিকে ছিল অজস্র গোলের অবদান।
  • কূটনৈতিক ফুটবল: মাঠের বাইরে ক্রীড়া সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক মঞ্চেও সক্রিয় চুন্নু ফুটবলারের মর্যাদা বৃদ্ধির আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।

 শেখ মোহাম্মদ আসলাম—গোলমেশিনের অন্য নাম

‘গোল যদি হয় সোনা, তাহলে আসলাম হচ্ছেন সোনার খনি’—এই জনপ্রিয় কথাটিই বলে দেয় তাঁর দাপট। ফরোয়ার্ড লাইনে বল পেলে ডি-বক্সে হানা তাঁর অভ্যাস ছিল। মাথা, ডান পা, বাঁ পা—সব দিক থেকেই সমান ভয়ঙ্কর।

  • মাঠের স্লোগান: ১৯৮৭-৯৩ পর্যন্ত পরপর সাত মৌসুম তিনি ছিলেন লিগের শীর্ষ গোলদাতা; এ সময়ে তাঁর গোলসংখ্যা ১৭০-এরও বেশি।

  • ক্লাব বিশ্বস্ততা: আবাহনীতে তাঁর সোনালি অধ্যায় তৈরি করলেও শেখ রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মোহামেডানেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।
  • টাইমিং-এর জাদু: তখন গোললাইন প্রযুক্তি বা ভিএআর ছিল না; পা বাড়িয়ে বল খোঁচা দেওয়াতে মিলিমিটারের হিসাব চাই। আসলাম ঠিক সেখানেই ছিলেন দারুণ পারদর্শী। তাঁর টাইমিং ও অবস্থানবোধ অনেক তরুণ স্ট্রাইকারের পাঠ্যবই।

 মনেম মুন্না—ডিফেন্সের রাজপুত্র

খুলনার ছেলে মুন্না মধ্যমাঠ থেকে উঠে এলেও জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন স্টপার-ব্যাক হিসেবে। বাম পায়ের দাপটে ট্যাকল, কভার ও লং পাসে ছিলেন অতুলনীয়। ম্যাচ পড়তে ও আক্রমণ তৈরি করতে তাঁর দৃষ্টি ছিল দূরদর্শী।

  • ক্লাব কিংবদন্তি: ১৯৮৩-৯৭—প্রায় দেড় দশক মুগ্ধ করেছেন আবাহনীর সমর্থকদের। তাঁর হাত ধরে ক্লাবটি তিনটি লিগ, দুটি ফেডারেশন কাপ আর একাধিক ফ্রেন্ডশিপ স্পোর্টস কাপ জেতে।

  • রেকর্ড ট্রান্সফার: ১৯৯১-এ বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল যখন তাঁর জন্য প্রায় ৪০ লাখ টাকার প্রস্তাব করেছিল, সেটাই উপমহাদেশে ফুটবলারদের আর্থিক সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দেয়।
  • জাতীয় সাফল্য: ১৯৮৯ সাফ গেমসে স্বর্ণপদক ও ১৯৯৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে উঠে আসা—দুটি মাইলফলকে তিনি ছিলেন দলের অভিভাবক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৯৭-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যু ফুটবল-ভক্ত বাংলাদেশকেও কাঁদিয়েছিল।

এক সুতোয় গাঁথা চার কাহিনি

বাংলাদেশের যে ফুটবল এখন ‘পেছিয়ে পড়েছে’ বলে আক্ষেপ শোনা যায়, তার মৌলিক সাফল্যের ছক কিন্তু একসময় এঁদের হাতেই তৈরি হয়েছিল। চারজনের জীবনবৃত্তান্তে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়—

এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাকটিক্স: সালাউদ্দিন-চুন্নু যুগে ৪-৩-৩ ফর্মেশন, আসলাম-মুন্না যুগে ৪-৪-২ সুবিধামতো বদল করত। এই অভিযোজন ক্ষমতা ভারতীয় ক্লাবগুলোর কাছেও দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল।

স্বদেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ: বিদেশি লিগে মোটা অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেশে থেকে জাতীয় দলকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন—আজও তরুণ ফুটবলারদের কাছে তা অনুপ্রেরণা।

মাঠের বাইরে অবদান: কেউ সংগঠক, কেউ কোচ; কেউ আবার ফুটবলারদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার—জাতীয় ফুটবলের পাটাতন মজবুত করেছেন মাঠের বাইরেও।

উত্তরাধিকার: আজকের প্রজন্ম কী শিখতে পারে?

  • টেকনিক্যাল স্কিল বনাম ফিটনেস: চার কিংবদন্তির যুগে পেশাদার ফিটনেস সাপোর্ট সিস্টেম প্রায় ছিলই না। তবু তাঁদের টেকনিক ওই সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আজকের ফুটবলাররা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তা পেলেও টেকনিক্যাল দিকটা অনুশীলনের মাধ্যমে ঝালানো জরুরি।
  • দলের জন্য ‘নিজেকে ছাড়া’: মুন্না হাঁটুতে ব্যথা নিয়েও ১৯৯৫ সাফ সেমিফাইনাল খেলেছিলেন—এটাই প্রমাণ করে, জাতীয় দলের জার্সি মানে শুধু বেতন বা গ্ল্যামার নয়, এক ধরনের শপথ।
  • দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: সালাউদ্দিনের বাফুফে প্রেসিডেন্সি বা চুন্নুর সংগঠনচর্চা প্রমাণ করেছে—ফুটবল উন্নয়নে ধারাবাহিকতা ও রোডম্যাপ অপরিহার্য।

চার মহাতারকার হাত ধরে যে ফুটবল-উন্মাদনা শুরু হয়েছিল, তা আজও চিলেকোঠা কিংবা পাড়ার মাঠে ক্রিকেটের পাশে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। তাঁদের কীর্তি প্রমাণ করে, দক্ষতা ও অধ্যবসায় থাকলে সীমিত সম্পদেও আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল গড়ে তোলা যায়। বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে হলে, নতুন প্রজন্মকে নিজের ভেতর থেকে আরেকজন সালাউদ্দিন, চুন্নু, আসলাম বা মুন্না খুঁজে বের করতে হবে—যাঁরা শুধু গোল, পাস কিংবা ট্যাকল করবেন না; বরং একটি জাতিকে আবারও স্বপ্ন দেখাবেন।

শিক্ষার্থী-শিক্ষকের প্রেমের গল্প নিয়ে বিতর্কে বন্ধ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-ড্রামা

বাংলার ফুটবলে চার মহারথী

০৬:৩৭:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবল এমন এক আবেগ, যা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিহরিত করে এসেছে। স্বাধীনতা-উত্তর বছরগুলোতে ফুটবল ছিল শহরের অলিগলি থেকে গ্রামীণ মাঠ—সবখানে ‘এক নম্বর’ বিনোদন। উচ্ছ্বাসভরা সেই দিনগুলোর নায়ক ছিলেন চার ফুটবল-মহাতারকা: কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও মনেম মুন্না। তাঁদের পায়ের জাদু, ব্যক্তিত্ব আর নেতৃত্ব একসময় গোটা জাতিকে এক সুতোয় বেঁধেছিল, গড়ে দিয়েছিল ফুটবল সংস্কৃতির অমূল্য ভিত্তি। এই চার কিংবদন্তিকে নিয়েই আজকের এই বিশেষ আয়োজন।

কাজী সালাউদ্দিন—স্বপ্ন দেখানোর প্রথম পোস্টার বয়

১৯৭৩ সালে পাকিস্তানি লিগে খেলার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের হাতে জাতীয় দল গড়ে তোলার দায়িত্ব নেন—এটাই ছিল সালাউদ্দিনের প্রথম বড় সিদ্ধান্ত। ঢাকার ফুটবল লিগে আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আক্রমণভাগে তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠে ‘সালাউদ্দিন-গলি-পাস’ নামের দুরন্ত কৌশল, যেটি রক্ষণভাগকে হিমশিম খাওয়াত।

  • আন্তর্জাতিক অবদান: ১৯৭৩ সালের মার্চে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম অফিসিয়াল ম্যাচেই গোল করে ‘ম্যাচ জয়ী’ তকমা পান। ১৯৮০-এর এশিয়ান কাপ বাছাইয়ে সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ার বিপক্ষে তাঁর গোল দুর্দান্ত নিয়মিত ফর্মের প্রমাণ।
  • ধীশক্তি ও নেতৃত্ব: খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ দিকে স্ট্রাইকার থেকে সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডে নেমে গিয়ে দলের তরুণদের জন্য বল সরবরাহ করতেন—প্রমাণ করে দিলেন, ফুটবল কেবল গতির নয়, মস্তিষ্কেরও খেলা।
  • পরবর্তী ভূমিকা: অবসরের পর কোচিং, ধারাভাষ্য আর বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দায়িত্ব নিয়ে কাঠামোগত সংস্কারে নেতৃত্ব দেন। তাঁর হাত ধরেই স্বাধীনতা কাপ, জায়ান্ট-কিলিং সুপার কাপের মতো জনপ্রিয় ঘরোয়া আসর নতুন করে প্রাণ পায়।

 আশরাফউদ্দিন আহমেদ চুন্নু—বাঁ পায়ের জাদুকর

ময়মনসিংহের ছেলে চুন্নু ঢাকার মাঠে প্রথম আলো ছড়ান ১৯৭৫-এ। বাঁ প্রান্ত ধরে চোখধাঁধানো দৌড়, ঝড়ের গতি আর কার্ভিং ক্রসে দ্রুতই হন সমর্থকদের প্রিয়।

  • ঐতিহাসিক গোল: ১৯৭৮ এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট গোলটি আসে তাঁর পা থেকে। আবার ১৯৮৫ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম কোয়ালিফায়ার গোলও করেন তিনিই।

  • দলের মেরুদণ্ড: ক্লাব পর্যায়ে আবাহনীর বাইরে খেলেননি—এক ক্লাবের প্রতি এমন স্থায়ী আনুগত্য সে সময় বিরল উদাহরণ। সহজ পাস, নিখুঁত ক্রস আর ফ্রি-কিকে ছিল অজস্র গোলের অবদান।
  • কূটনৈতিক ফুটবল: মাঠের বাইরে ক্রীড়া সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক মঞ্চেও সক্রিয় চুন্নু ফুটবলারের মর্যাদা বৃদ্ধির আন্দোলনে সোচ্চার ছিলেন।

 শেখ মোহাম্মদ আসলাম—গোলমেশিনের অন্য নাম

‘গোল যদি হয় সোনা, তাহলে আসলাম হচ্ছেন সোনার খনি’—এই জনপ্রিয় কথাটিই বলে দেয় তাঁর দাপট। ফরোয়ার্ড লাইনে বল পেলে ডি-বক্সে হানা তাঁর অভ্যাস ছিল। মাথা, ডান পা, বাঁ পা—সব দিক থেকেই সমান ভয়ঙ্কর।

  • মাঠের স্লোগান: ১৯৮৭-৯৩ পর্যন্ত পরপর সাত মৌসুম তিনি ছিলেন লিগের শীর্ষ গোলদাতা; এ সময়ে তাঁর গোলসংখ্যা ১৭০-এরও বেশি।

  • ক্লাব বিশ্বস্ততা: আবাহনীতে তাঁর সোনালি অধ্যায় তৈরি করলেও শেখ রাসেল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও মোহামেডানেও দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন।
  • টাইমিং-এর জাদু: তখন গোললাইন প্রযুক্তি বা ভিএআর ছিল না; পা বাড়িয়ে বল খোঁচা দেওয়াতে মিলিমিটারের হিসাব চাই। আসলাম ঠিক সেখানেই ছিলেন দারুণ পারদর্শী। তাঁর টাইমিং ও অবস্থানবোধ অনেক তরুণ স্ট্রাইকারের পাঠ্যবই।

 মনেম মুন্না—ডিফেন্সের রাজপুত্র

খুলনার ছেলে মুন্না মধ্যমাঠ থেকে উঠে এলেও জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছিলেন স্টপার-ব্যাক হিসেবে। বাম পায়ের দাপটে ট্যাকল, কভার ও লং পাসে ছিলেন অতুলনীয়। ম্যাচ পড়তে ও আক্রমণ তৈরি করতে তাঁর দৃষ্টি ছিল দূরদর্শী।

  • ক্লাব কিংবদন্তি: ১৯৮৩-৯৭—প্রায় দেড় দশক মুগ্ধ করেছেন আবাহনীর সমর্থকদের। তাঁর হাত ধরে ক্লাবটি তিনটি লিগ, দুটি ফেডারেশন কাপ আর একাধিক ফ্রেন্ডশিপ স্পোর্টস কাপ জেতে।

  • রেকর্ড ট্রান্সফার: ১৯৯১-এ বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল যখন তাঁর জন্য প্রায় ৪০ লাখ টাকার প্রস্তাব করেছিল, সেটাই উপমহাদেশে ফুটবলারদের আর্থিক সম্ভাবনার নতুন দরজা খুলে দেয়।
  • জাতীয় সাফল্য: ১৯৮৯ সাফ গেমসে স্বর্ণপদক ও ১৯৯৫ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে উঠে আসা—দুটি মাইলফলকে তিনি ছিলেন দলের অভিভাবক। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৯৭-এ মাত্র ৩২ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যু ফুটবল-ভক্ত বাংলাদেশকেও কাঁদিয়েছিল।

এক সুতোয় গাঁথা চার কাহিনি

বাংলাদেশের যে ফুটবল এখন ‘পেছিয়ে পড়েছে’ বলে আক্ষেপ শোনা যায়, তার মৌলিক সাফল্যের ছক কিন্তু একসময় এঁদের হাতেই তৈরি হয়েছিল। চারজনের জীবনবৃত্তান্তে কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়—

এক্সপেরিমেন্টাল ট্যাকটিক্স: সালাউদ্দিন-চুন্নু যুগে ৪-৩-৩ ফর্মেশন, আসলাম-মুন্না যুগে ৪-৪-২ সুবিধামতো বদল করত। এই অভিযোজন ক্ষমতা ভারতীয় ক্লাবগুলোর কাছেও দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছিল।

স্বদেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ: বিদেশি লিগে মোটা অঙ্কের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেশে থেকে জাতীয় দলকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন—আজও তরুণ ফুটবলারদের কাছে তা অনুপ্রেরণা।

মাঠের বাইরে অবদান: কেউ সংগঠক, কেউ কোচ; কেউ আবার ফুটবলারদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার—জাতীয় ফুটবলের পাটাতন মজবুত করেছেন মাঠের বাইরেও।

উত্তরাধিকার: আজকের প্রজন্ম কী শিখতে পারে?

  • টেকনিক্যাল স্কিল বনাম ফিটনেস: চার কিংবদন্তির যুগে পেশাদার ফিটনেস সাপোর্ট সিস্টেম প্রায় ছিলই না। তবু তাঁদের টেকনিক ওই সীমাবদ্ধতাকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। আজকের ফুটবলাররা আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তা পেলেও টেকনিক্যাল দিকটা অনুশীলনের মাধ্যমে ঝালানো জরুরি।
  • দলের জন্য ‘নিজেকে ছাড়া’: মুন্না হাঁটুতে ব্যথা নিয়েও ১৯৯৫ সাফ সেমিফাইনাল খেলেছিলেন—এটাই প্রমাণ করে, জাতীয় দলের জার্সি মানে শুধু বেতন বা গ্ল্যামার নয়, এক ধরনের শপথ।
  • দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা: সালাউদ্দিনের বাফুফে প্রেসিডেন্সি বা চুন্নুর সংগঠনচর্চা প্রমাণ করেছে—ফুটবল উন্নয়নে ধারাবাহিকতা ও রোডম্যাপ অপরিহার্য।

চার মহাতারকার হাত ধরে যে ফুটবল-উন্মাদনা শুরু হয়েছিল, তা আজও চিলেকোঠা কিংবা পাড়ার মাঠে ক্রিকেটের পাশে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। তাঁদের কীর্তি প্রমাণ করে, দক্ষতা ও অধ্যবসায় থাকলে সীমিত সম্পদেও আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল গড়ে তোলা যায়। বাংলাদেশের ফুটবলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী হতে হলে, নতুন প্রজন্মকে নিজের ভেতর থেকে আরেকজন সালাউদ্দিন, চুন্নু, আসলাম বা মুন্না খুঁজে বের করতে হবে—যাঁরা শুধু গোল, পাস কিংবা ট্যাকল করবেন না; বরং একটি জাতিকে আবারও স্বপ্ন দেখাবেন।