হঠাৎ করেই ডিপসিক ব্যাটারি নির্মাতা সিএটিএল ও বৈদ্যুতিক যান উৎপাদনকারী বিওয়াইডি‑র সঙ্গে চীনের নতুন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছে।
পঞ্চাশের দশকের ‘স্পুটনিক মুহূর্তের’ সঙ্গে ডিপসিকের উদয়কে তুলনা করা হচ্ছে, যখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিবিদরা সোভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রত্যাশিত সাফল্যে তাদের আধিপত্যের ওপর চ্যালেঞ্জ দেখেছিলেন।
ঠিক তেমনই, কয়েক মাস আগে জানা গেল—হাংঝৌ ও বেইজিংয়ে কার্যালয় সম্পন্ন একটি কোয়ান্ট ফার্ম কম খরচে এমন এক এআই‑মডেল তৈরি করেছে, যার কর্মদক্ষতা আমেরিকান প্রতিদ্বন্দ্বীদের সমকক্ষ। খবরটি বিশ্বজুড়ে বিস্ময় ছড়ায়।
তবে বাজার‑মনোবিজ্ঞান এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর প্রভাব বিবেচনায় ডিপসিকের আবির্ভাব আরও বেশি উত্তেজক হতে পারে। উইচ্যাটের মতো উদ্ভাবনী অ্যাপ তৈরি করা এক জিনিস, আর অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হার্ডওয়্যারে ভর করে—তবে আরও বুদ্ধিমান সফটওয়্যার দিয়ে—একটি পুরো এআই‑মডেল গড়া সম্পূর্ণ ভিন্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।
হঠাৎ করেই ডিপসিক ব্যাটারি নির্মাতা সিএটিএল ও বৈদ্যুতিক যান প্রস্তুতকারী বিওয়াইডি‑র সঙ্গে চীনের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন শ্রেণিতে ঠাঁই পেয়েছে।
জেপিমরগ্যানের নিউইয়র্ক অফিসের গবেষণা প্রধান জয়েস চ্যাং বলেন, “চীনে এআই‑এর ক্ষেত্রে ডিপসিকের উত্থান একটি সন্ধিক্ষণ। কয়েক দশক ধরে গড়ে ওঠা প্রযুক্তি খাত (এআই, শিল্প‑রোবট, স্বয়ংক্রিয়তা) এখন ব্রেকআউট পর্যায়ে—প্রকৌশলী প্রতিভা ও সরকারি সহায়তায় প্রযুক্তিকে অবকাঠামো হিসেবে ধরে একটি বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়েছে।”
স্থানীয় এআই ও প্রকৃত অর্থনীতির সংযুক্তি যে রূপান্তরমূলক হবে, তা স্পষ্ট। ম্যানুফ্যাকচারিং‑এ এআই যুক্ত করলে ডিপসিক শিল্প রূপান্তর, স্মার্ট উৎপাদন, স্বয়ংচালিত গাড়ি ও রোবট ব্যবহারের গতি বাড়াতে পারে—যা উৎপাদনশীলতার নিম্নগতি ও রোবটিক্স ঘাটতি পুষিয়ে দেবে।
ডিপসিকের সহায়তায় যে এআই ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা সম্ভব, তা দেশের তিনটি সংকটজনক ‘ডি’—জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জ, ঋণ সংকোচন ও মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস—কিছুটা হলেও সামাল দিতে সহায়তা করতে পারে।
অবশ্য স্পষ্ট নয়, ডিপসিক একক ঘটনা নাকি বড় ডেটাবেস ও তুলনামূলক শিথিল নিয়ন্ত্রক পরিবেশের সুবিধা যেখানে, সেসব ক্ষেত্রেও নতুন সাফল্যের ইঙ্গিত দেয়। ডিপসিক প্রমাণ করেছে—বিপুল মূলধন সবসময় অপরিহার্য নয়; এ বাস্তবতা কি অন্য খাতেও প্রযোজ্য?
সে প্রশ্ন ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। আপাতত এই উচ্ছ্বাস চীনা শেয়ারবাজারকে চলতি বছর বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ পারফর্মারের কাতারে তুলেছে (১০ জুলাই পর্যন্ত এমএসসিআই ১৮.৫ শতাংশ বেড়েছে) এবং বিনিয়োগ‑আত্মবিশ্বাসে জোরালো সঞ্চার করেছে।
মার্চের শেষদিকে চায়না ডেভেলপমেন্ট ফোরামের আবহ ছিল মলিন—ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্ভাব্য শুল্ক ও কড়া নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায়। অথচ জুনের শেষ সপ্তাহে তিয়ানজিনের সামার ডাভোস ছিল প্রাণবন্ত; কারণ, আলিবাবা ও দিদির মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বছরের পর বছর টানাপোড়েনের পর বেইজিং প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের আরও আন্তরিকভাবে গ্রহণের ইঙ্গিত দেয়।
ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বাড়তে থাকা সময়ে মর্গান স্ট্যানলির প্রযুক্তি বিশ্লেষকেরা বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের এগিয়ে থাকা ব্যবধান সঙ্কীর্ণ হয়েছে। ডিপসিক মার্কিন এআই আধিপত্যের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে বৈশ্বিক বয়ান বদলে দিয়েছে। আগে জাপান হার্ডওয়্যারে শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করত, ভারত সফটওয়্যার ও আইটি‑সেবায় অগ্রণী ছিল। দুই ক্ষেত্রেই অদ্বিতীয় কৃতিত্ব কেবল আমেরিকারই ছিল। এখন চীনও একই দাবি করতে পারে।”
বিওয়াইডি ইয়াংওয়াং ইউ৯ বৈদ্যুতিক সুপারকারের উদাহরণ টেনে বলা যায়—চীন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমাতে মরিয়া।
ডিপসিক যখন আবির্ভূত হয়েছে, তখনই চীন বায়োটেক, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ও সেমিকন্ডাক্টরসহ নানা প্রযুক্তি ও গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করছে; একই সঙ্গে স্বয়ংচালিত যান, ব্যাটারি প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তিতেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
দ্বৈত‑ব্যবহারযোগ্য প্রযুক্তি—যেমন ড্রোন—ক্ষেত্রে চীন ইতিমধ্যে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা গড়ে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু উদ্যোগে সরকারি অর্থায়ন কমালেও, বেইজিং পরিষ্কার জ্বালানি কর্মসূচির অংশ হিসেবে পারমাণবিক ফিউশনে বড় সফলতার চেষ্টা করছে, যাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় বর্জ্য নিরাপদে ব্যবস্থাপনা করা যায়।
পরে ভাবলে, বিস্ময়টা হয়তো কম হওয়া উচিত ছিল। মর্গান স্ট্যানলির বিশ্লেষকেরা জানান—প্রচুর প্রতিভা, সস্তা জ্বালানি ও বিপুল ডেটার ওপর দাঁড়ানো মূল ভূখণ্ডের গভীর ইকোসিস্টেমের অংশ ডিপসিক। দেশে ৫৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে এআই‑সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ন রয়েছে এবং চীন এ ক্ষেত্রের পেটেন্টে বিশ্বসেরা। শীর্ষস্থানীয় গবেষকদের প্রায় ২৮ শতাংশই হেফেই ও ঝেংঝৌর দুটি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে কাজ করেন।
এই মানবসম্পদই অর্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ডিপসিকের পেছনে কেবল বেসরকারি পুঁজি আছে—এ নিয়ে চীনের বাইরে সন্দেহ ছিল; যদিও ডিপসিক‑সংশ্লিষ্ট কোয়ান্ট ফান্ডের স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা অন্তত দুই বছর ধরে সংস্থাটির অস্তিত্ব জানতেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন’ প্রযুক্তি জায়ান্ট এত দিন বাজারে দাপট দেখালেও বিকল্প প্রার্থীর অভাব ছিল। এখন সেই ছবিটা পাল্টাচ্ছে।
লেখকের পরিচিতি
হেনি সেন্ডার অ্যাপসারা অ্যাডভাইসারির প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা অংশীদার; এই কৌশলগত পরামর্শ সংস্থা আর্থিক খাতকে সেবা দেয়। এর আগে তিনি বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্ল্যাকরকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।