গোপালগঞ্জে এখন কী ঘটে চলেছে তা দেশবাসী সঠিক জানে না। কতজন মারা গেছে, সে প্রশ্নও বড় নয়। নিহত হওয়ার ধরণটাই বড়। এনসিপি নামক অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলটি সেখানে সরকারি প্রোটোকলে জনসভা করার সুযোগ পেল কেন, সেটাও এখন আর প্রধান বিবেচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে নয়। এনসিপি নেতাদের পলায়নের দৃশ্য কারো জন্য হাসির খোরাক, কারো জন্য লজ্জার বিষয়—তাও এখন আর গুরুত্ব রাখছে না। বরং এনসিপি’র নেতাদের পলায়ন মূলত বর্তমান সরকারের অবস্থানের বাস্তবতা।
একটি মুমূর্ষু রোগী যেমন শেষ মুহূর্তে আইসিইউতে থাকে। এনসিপির জীবনবায়ু এখন আর্মার্ড ভেহিকেলের ডিকিতে। আর এটাই যখন ইউনুস সরকারের কিংস পার্টি—তাই গণিতের নিয়মে ইউনুস সরকারের অবস্থানও ঠিক একই স্থানে।
মুহাম্মদ ইউনুসের জনপ্রিয়তায় ধস নেমে গেছে অনেক আগেই, যা এই কলামেই কয়েক মাস আগে বিস্তারিত লিখেছি। এখন যে কিংস পার্টির মতো শুধু মাত্র আর্মার্ড কারের ডিকিতেই তা অবস্থান করছে, এ নিয়ে আর বিতর্ক নেই।
দেশের মানুষের কাঁচা বাজারে গিয়ে শুষ্ক মুখ, বন্ধ কলকারখানার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বেকার শ্রমিক, শিল্পপতির হাতে আগুনে পোড়া কারখানার ছাই, একের পর এক রপ্তানির পথ বন্ধ হওয়া, শিল্পপতিরা বেতন দেওয়ার জন্য ব্যাংক সহায়তা চেয়ে হতাশ হওয়া, পররাষ্ট্রনীতির নামে গোটা পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন, প্রতিদিন দেশের মানুষের জন্য কোনো না কোনো দেশের ভিসা পাওয়ার পথ কঠিন হওয়া, দেশের একমাত্র উল্লেখযোগ্য রপ্তানি পণ্য পোশাকসহ বাংলাদেশের অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ওপর আমেরিকার আগে আরোপিত ১৫ শতাংশের ওপর ট্রাম্প প্রশাসনের আরও ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ নিয়ে যোগ্যতার সঙ্গে ডিল করতে না পারা, এমনকি ব্যবসায়ীদের এই নেগোশিয়েশনে কোনো রূপ যোগ না করা—সর্বোপরি গত ঈদে ‘সবজির দাম কম’ এই স্লোগান বজায় রাখতে গিয়ে গ্রামের কৃষককে নিঃস্ব করার পরে—জীবনযাত্রা, ব্যবসা–বাণিজ্য, দেশের মর্যাদা রক্ষা—সব মিলে এই সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের কতটুকু আস্থা থাকে, তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না।
অন্যদিকে ইউনুস সরকার, তার প্রেস সেক্রেটারির ভাষায় ‘প্রেসার গ্রুপ’, সাধারণ মানুষের চোখে যা ‘মব’—তৈরি করেই প্রথম দিন থেকে দেশবাসীকে ভীত করে, আতঙ্কিত করে দেশ চালানোর যে নীতি নিয়েছে, তা একটি সাংবিধানিক সরকারের, বাংলাদেশের মতো একটি সুসংগঠিত দেশের প্রতিটি কাঠামোকে অনেকখানি অস্বীকার করে। মবের মাধ্যমে শুধু শহরে নয়, গ্রামে গ্রামে বাড়ি পুড়ানো, চাঁদাবাজি, মানুষকে পেটানো, সরকারি কর্মচারী বদলি ও চাকরিচ্যূত, আরও বড় স্থানে পদত্যাগ ঘটানো, পুলিশকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে ফেলা। আর এর ওপরে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং বাংলাদেশের প্রথম কোনো সরকারপ্রধানের তা অস্বীকার করা। যার প্রতীক হয়েছে মুরাদনগরের বস্ত্রহীনা ধর্ষিতা নারীর ছবি আর সর্বশেষ ছিনতাইকারী পথচারীর জামাকাপড়ও খুলে নিয়েছে। অর্থাৎ এই মুহূর্তে দেশের আরেকটি প্রতীক হচ্ছে নির্যাতিতা নারী ও অসহায় পুরুষের বস্ত্রহীন ছবি।
আর এর ওপরে রয়েছে সংস্কারের নামে সংবিধান নিয়ে নানান কথা। বাংলাদেশের মানুষ তার স্বাধীনতার মতো, তার সংবিধানকেও একই সম্মানের চোখে দেখে। দুটোই তাদের রক্ত দিয়ে, আব্রু দিয়ে অর্জিত। সংবিধানে কোনো সংশোধনী এনে যদি সংবিধানের মূল চরিত্রের কোনো অসঙ্গতি কোনো বিগত সরকার বা কোনো সরকার ঘটায়, সেজন্য সংবিধানের রক্ষক সুপ্রিম কোর্ট আছে। সুপ্রিম কোর্ট তার অধিকার ও দায়িত্ব বলে অসঙ্গতিটুকু বাতিল করে দেবে। এ অধিকার সংবিধানই তাদেরকে দিয়েছে। আর নতুন কোনো সংযোজন, বিয়োজন করতে হলে তা নির্বাচিত সংসদ করবে। রাজার ইচ্ছে হলো আর হাতি পাঠিয়ে শুঁড় দিয়ে কিছু লোক তুলে এনে সভাসদ বানিয়ে তাদেরকে সংবিধান থেকে গোটা দেশ সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হবে—এর যুক্তি কোথায়?
কারণ, যে কাজ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, সে কাজ ব্যক্তি বা অনির্বাচিত সরকার করবে কেন? যেমন ব্যক্তি হিসেবে আমি ‘প্রোপোরশনাল ভোট পদ্ধতি’ বাংলাদেশে কিছুটা সঠিক বলে মনে করি—কিন্তু পার্টি নেতৃত্ব যেখানে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, সেখানে এ কাজের জন্য অনেক পথ হাঁটতে হবে। ততদিনে হয়তো আরও ভালো পথ আসবে। অন্যদিকে ব্যক্তি হিসেবে আমার মনে হয়, জনসংখ্যা অনুযায়ী বাংলাদেশকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করা উচিত। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি ‘ইউনিটারি কান্ট্রি’; তার ওপর অষ্টম সংশোধনী একাংশের বাতিলের রায়ের পরে এ ধরনের চিন্তা নির্বাচিত সংসদ, বিচারবিভাগের মতামত নিয়ে ছাড়া একটি ব্যক্তিগত ধারণাপত্র মাত্র।
এ ধরনের ধারণা আমার নিজের কাছে যতই ভালো মনে হোক না কেন, জনগণের প্রতিনিধিত্বহীন রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে আমি যদি এগুলো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি, তাহলে তো লোকে আমার মস্তিষ্ক নিয়েই প্রশ্ন তুলবে!
তারপরেও দেশের প্রতি, স্বাধীনতার প্রতি অনুগত দলগুলো অনেকটা ধৈর্য ধরে ইউনুস সরকারের সংস্কারের নামে ‘এনজিও মোটিভেশন ক্লাসে’ যোগ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, গত ৫ আগস্টের পরে তারা সরকারপ্রধান ও তাঁর সহকর্মী নির্বাচনে ভুল করে বসেছেন। তারপরেও রাজনীতিবিদদের আমরা যতই দোষ দিই না কেন, তারা অনেক ধৈর্যশীল। প্রতিদিন একজন রাজনীতিককে সাধারণ মানুষের যত ছোটখাটো, এমনকি অপ্রাসঙ্গিক বিষয় শুনতে ও সমাধান করতে হয়—তা আমাদের মতো মানুষ হলে একদিনেই পাগল হয়ে যাবার কথা। তাই এই ধৈর্যশীল মানুষরা শুধুমাত্র দেশের স্বার্থে, একটি নির্বাচনের স্বার্থে ইউনুস সরকারের ‘এনজিও মোটিভেশন ক্লাসে’ যোগ দিচ্ছেন। কারণ, তারা দেখছেন, দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য থেকে শুরু করে বিদেশি বিনিয়োগ—সব যেভাবে গত প্রায় এক বছরে স্তব্ধ শুধু নয়, বিপরীত যাত্রা শুরু করেছে—এর জন্য দেশে একটি স্থিতিশীল সরকার দরকার। এবং যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন, এমন মানুষদের নিয়ে গঠিত সরকার দরকার। শান্তিপূর্ণভাবে সেটা সম্ভব হয় কিনা, একারণেই তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষায় অবর্তীর্ণ হওয়া।
কিন্তু দেশের সাধারণ মানুষ রাজনীতিবিদদের মতো কখনই অতটা ধৈর্যশীল নয়। তাছাড়া এই পূর্ববাংলা, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশ—পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত এলাকা—এই দেশকে দু’জন মানুষ খুব ভালোভাবে চিনতেন। একজন শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, অপরজন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুজনই বিভিন্নভাবে বারবার তাদের ভাষণে বলেছেন, এ দেশের মাটি বর্ষায় যেমন নরম হয়, চৈত্রে তেমনি কঠিন হয়। আবার দুজনেই বহুবার বলেছেন, এ দেশের যে মানুষরা বিকেলে মারামারি করার পরে রাতে নদীর ভাঙনে যখন তাদের সবকিছু নদীতে টেনে নিয়ে যায়, তখন ওই মানুষেরা সকাল থেকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সবার নতুন বাড়ি তৈরি করতে নেমে পড়ে। গত দিনের বিকেলটি তাদের স্মৃতিতেও থাকে না। তাই পূর্ববঙ্গের মানুষ, যারা পশ্চিমবঙ্গে গিয়েও বলে তাদের দুটো মাত্র সম্পদ আছে—একটি তাদের বাঙ্গাল ভাষা, অন্যটি ইস্টবেঙ্গল ক্লাব—এই পূর্ববঙ্গের মানুষকে পশ্চিমা এনজিও মোটিভেশন খাওয়ানো যাবে না কখনই।নদী পাড়ের এ জনগোষ্টি আলাদা চরিত্রের মানুষ। তাই দেখাই তো যাচ্ছে, জাতিসংঘের মহাসচিব এনে করিডোর ট্যাবলেট খাওয়ানো যাচ্ছে না, গাজার মতো মানবাধিকার অফিস ট্যাবলেট এখানে খাওয়ানো যাচ্ছে না।
রাজনীতিবিদরাও এইসব ট্যাবলেট দেখেও এতদিন চুপ করে ছিলেন—অনেকটা এ ভেবে যে দেশে এক বছর আগে অনেক কিছু ঘটে গেছে, আর নয়; স্থিতিশীলতা দরকার। কিন্তু সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট সন্তানেরা কী হিসেবে ১৬ জুলাই তাদের আইকন আবু সাঈদের কবর জিয়ারত করতে না গিয়ে গোপালগঞ্জ গিয়েছিল—সে মেটিকুলাস ডিজাইন নিয়ে এ দেশের মানুষ মনে হয় আর ভাবতে রাজি নয়—তারই প্রতীক গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষের শক্তি। এবং ঠিক তার পরের দিন ঢাকার রাজপথে যুবদলের মিছিলের স্লোগান—‘এ দেশ আমার বাপ দাদার, এ দেশ কোনো রাজাকারের নয়’।
বাস্তবে গোপালগঞ্জের বারুদে একটু আগুন দেওয়া হয়েছে—আর তার ফল যা, সেটা হয়ে গেছে—যার প্রতীক ‘ডিকির ভেতর’। সারাদেশের সাধারণ মানুষের বারুদে আগুন দিলে কী হবে, সেটাই গোপালগঞ্জ প্রকাশ করে দিয়েছে।
সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তাদের কাছে তথ্য ছিল, কিন্তু এতটা হবে সে তথ্য ছিল না। এর কারণ অতি সোজা—সরকার তথ্য খুঁজছে আওয়ামী লীগ সেখানে কী করতে পারে, তথ্য খুঁজেনি সাধারণ মানুষ কী করবে। গোপালগঞ্জের সাধারণ মানুষই সারাদেশের সাধারণ মানুষের প্রতীক।
তাই সাধারণ মানুষ ইউনুস সরকারের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে দিয়েছে। আর যে বার্তার মূলে রয়েছে—দেশকে স্থিতিশীলতায় নিতে পারে এবং দেশের পুলিশ বাহিনীসহ সবাইকে আস্থায় এনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে পারে—এমন সরকার শান্তিপূর্ণভাবে দ্রুত গঠন করতে হবে।
অনেকে মনে করতে পারেন, যখন গোপালগঞ্জ কারফিউ, নানান ধরনের নির্যাতনের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায়—তখন সেসব কথা না লিখে কেন, শুধু মানুষের রায় নিয়ে এ লেখা। গোপালগঞ্জে অত্যাচার হচ্ছে ঠিকই, মায়ের কোল খালি হচ্ছে—কিন্তু এর পরে কী—সেটা সেই ইংরেজের অত্যাচারের সময় রবীন্দ্রনাথই ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন—
“টুটল কত বিজয় তোরণ, লুটলো প্রাসাদ চূড়ো,
কত রাজার কত গারদ ধুলোয় হল গুঁড়ো।
আলিপুরের জেল খানাও মিলিয়ে যাবে যবে
তখনও এই বিশ্ব-দুলাল ফুলের সবুর সবে।
রঙিন কুর্তি, সঙিন মূর্তি রইবে না কিছুই,
তখনো এই বনের কোণে ফুটবে লাজুক জুঁই।”
ফুটনোট: আমি যদি এর পরে ফুটনোটে লিখি, পলি বিধৌত এই সবুজ বাংলায় চিরস্থায়ী কেবল জুঁই ফুলের সুবাস আর কিছু নয়, তাহলে গুরুদেবের কবিতাটাকে খুন করা হয়। তারপরেও এই ফুটনোটটুকু লিখলাম, আর পাঠকের কাছে অনুরোধ—এটুকু কেউ পড়বেন না।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World।