১০:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫

সেই সব দিনগুলো ও ফরিদা পারভীন

আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠান ঘিরে অনেক স্মৃতি গত কয়েকদিনে সামনে এসে ভিড় করছেলালন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনকে ঘিরে। তার অনেকগুলো অনুষ্ঠান হত উত্তরা (তখন উত্তরা এমন ঘিঞ্জি এলাকা হয়নি) আমাদের এক বন্ধুর স্বামীর বাসায়আর বেশির ভাগই গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়ধানমন্ডীর একটি গেস্টরুম কাম বাসা সহ নানান স্থানে।

এই সব অনুষ্ঠানে তপন রায় চৌধুরির প্রেসিডেন্সির বন্ধু সামাদভাইজিল্লুর রহমান সিদ্দিকী থেকে শুরু করে ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যও থাকতেন। আর শিল্পসাহিত্যিককবিসহ আমার মতো উটকো মানুষগুলো তো থাকতেই। একবার মনে পড়ে গুলশানে একটি বাচ্চা ছেলে গাড়ি চালাতে গিয়ে আমাদের রিকশায় ধাক্কা দেয়। পড়ে গিয়ে হাতে ফ্র্যাকচার হয়। বাসায় থেকে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নিতে হয়পাঁচ তলায় বাসালিফট ছিল না। দেখি অনিল দা ও বৌদিএম আর আখতার মুকুল ভাই ও রিমি কাছ থেকে খবর পেয়ে উপস্থিত। তারা বলেন, “হাতে আঘাত লেগেছেপা ঠিক আছেচলোরাতে অনেকেই গাইবেফরিদা পারভীনও গাইবে।” হাতে বেশ যন্ত্রণাতারপরেও তারা রেহাই দিতে চান না।

এমনই অনেক স্মৃতিযা মনে করলে একটা অনেক দীর্ঘ তরুণবেলাযুবকবেলা সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে যত দিন গেছেততই দেখেছি ফরিদা পারভীন যেন গানের শিল্পী থেকে ধীরে ধীরে এক বাউল সাধিকা হয়ে উঠছেন। গানগুলো গান থেকে অপার এক আরাধনায় রূপ নিচ্ছে।

সম্ভবত ১৯৯৬ কি ৯৭ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিক এসেছেন। সুনীল দা ও বৌদি উঠেছেন গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়অন্যরা হোটেলে ও অন্য অনেকের বাসায়। জয় গোস্বামী তখন তরুণসারাক্ষণ ত্রিদিব দস্তিদারের সঙ্গে।

গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই তখন সিদ্ধেশ্বরীর ৯ নম্বর ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার পাশেই ১৫ নম্বর বেইলি রোডে আমার যায়যায়দিন অফিস। গাজী ভাইয়ের একটা স্বভাব ছিলতিনি কোনো কিছু একা খেতে ভালোবাসতেন না  – নাআমাকে ও  ত্রিদিবকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন তাও আজো বুঝতে পারি না। সে কারণে প্রায় লাঞ্চের আগে বা ডিনারের আগে ফোন করতেনবা কখনও বেইলি রোডে এম আর আখতার মুকুল ভাইয়ের বুকশপে বসে মুকুল ভাইয়ের কর্মচারী রমজান বা কাউকে পাঠাতেনআমাকে ডাকার জন্যে।

সেদিন লাঞ্চের অনেক আগে তিনি ফোন করেন। হাতে কাজ ছিল নাসম্ভবত সোমবাররবিবার পত্রিকার পেস্টিং ও ছাপা শেষ হয়ে গেছেতাই সারাদিন কাজের চাপ কম। গাজী ভাইয়ের ফোন পেয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখিসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়বীথি গঙ্গোপাধ্যায়শামসুর রাহমানকাইয়ুম চৌধুরীকবি ফজল শাহাবুদ্দিনকবি বেলাল চৌধুরীশহীদ আখন্দকবি রফিক আজাদজয় গোস্বামীকবি সৈয়দ হায়দার ও আরও পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি সাহিত্যিক। গাজী ভাইয়ের স্ত্রীঅর্থাৎ আমাদের আশ্রয়স্থল বীথি ভাবী,  সে সময়ে পায়ে কীভাবে যেন আঘাত পেয়েছিলেনতাই পায়ের ব্যথা নিয়ে শুয়েছিলেন। তার রুমে গিয়ে দেখি ফরিদা পারভীন তার সঙ্গে গল্প করছেনপাশে ত্রিদিব দস্তিদার দাঁড়িয়ে।

সুনীল দা ও ফরিদা পারভীন পরসে মাছ ভাজা পছন্দ করতেন। একজন ফরিদপুরেরআর একজন নাটোরে জন্মলেও কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠাতাই পারসে মাছ তাদের অনেক পছন্দের। গাজী ভাইকে মাছটি প্রথম চিনিয়েছিলাম আমিপ্রথমদিন পছন্দ করেননি। পরে সুনীল দা ও কাইয়ুম স্যারের পছন্দের জোরে তিনিও পছন্দ করতে শুরু করেন। রসুইখানা থেকে শুধু পারসে মাছ ভাজা নয়আরও ফিশ ফিঙ্গারকাবাবসবজির ভাজিপদাঁকোড়াঅর্থাৎ পানীয়ের সঙ্গে যা যা যায় সবই আসছে

সেখানে গিয়েই শিল্পি কাইয়ুম চৌধুরীও পশ্চিমবঙ্গের এক ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবিতাদের সঙ্গে আমি বসি। কাইয়ুম স্যার আমাকে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দুজনের মাঝখানে বসার ব্যবস্থা করে দেন

ওই বাড়ির পাশেই ছিল সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। জয় গোস্বামী শুনেছিলে ওই মন্দিরের কালী খুব জাগ্রত। সে সেখানে যেতে চায়। তাকে মন্দিরে নিয়ে যাবার জন্য গাজী ভাই ত্রিদিব দস্তিদারকে খুঁজছেন। ত্রিদিব তখনো ফরিদা পারভীন ও ভাবীর সঙ্গে কথা বলছিলে। ফরিদা পারভীনকে শিল্পী হিসেবে ত্রিদিব কতটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার চোখে দেখতোতা বলা কঠিনফরিদা পারভীনও ত্রিদিবকে অনেক স্নেহ করতেন। কোনো অনুষ্ঠানে ফরিদা পারভীনকে পাওয়ার ক্ষেত্রে যদি তার শিডিউল টাইট থাকতোতখন ত্রিদিবকে বলা হতোত্রিদিব তার কাছে গেলে বা ফোন করলে তিনি ফেলতে পারতেন না।

ত্রিদিবকে পেতে দেরি দেখে কাইয়ুম স্যার বলেন, “স্বদেশনিয়ে যাও না জয়কে” গাজী ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। কাইয়ুম ভাইও হেসে দিলেন। ত্রিদিব কোথা থেকে লাফ দিয়ে এসে জয় গোস্বামীকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দিকে চলে গেলে

এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের কাজ শেষে নবনীতা দেবসেন ফিরে এসেছেন। তিনি সরাসরি ড্রয়িং রুমে না এসে গাজী ভাইয়ের বাসায় তাঁর জন্যে বরাদ্দ রুমে গেলেন। কাইয়ুম স্যার নবনীতা দিদির সঙ্গে কথা বলতে কিছুক্ষনের জন্যে উঠে যান। এদিকে ফরিদা পারভীনের গানের সহযোগীরাঅর্থাৎ যন্ত্রীরা এসে তাদের আসন ঠিক করছেন। ওই সময় ওই ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবি মৃদু স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের এখানে কোনো অসুবিধা হয় না?” নব্বইয়ের দশকেও আমাদের প্রজন্মযারা ঢাকা শহর ও সারাদেশের বিশেষ শ্রেণিতে বেড়ে উঠেছিকখনও বুঝিনি আজকের এই বাংলাদেশ হবেতাই প্রথমে তাঁর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি বুঝতে পারেনআমি প্রশ্ন বুঝিনিতখন আস্তে বলেন, “এখানে আপনাদের হিন্দুদের অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের কোনো অসুবিধা হয় না?” এর মধ্যে কাইয়ুম স্যার ফিরে এসে তার আসনে বসেনফরিদা পারভীনও তার আসন নেন।

ফরিদা পারভীন হারমোনিয়ামের প্রতি মাথা একটু নিচু করে গান শুরু করেন, “আমি অপার হয়ে….—সঙ্গে সঙ্গে সারা রুমে নীরবতা নেমে আসেওই ভদ্রলোকের হাতে থাকা পানীয়ের গ্লাসটি মুখের দিকে এগোয় না। একটার পর একটা গান কখন শেষ হয়ে যাচ্ছেকেউ বুঝতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে দেখিঅন্যরা মাঝে মাঝে পানীয় ও খাবার নিলেও ওই ভদ্রলোকের গ্লাস তাঁর হাতে স্থির ভাবে ধরা এতটাই স্থির যে গ্লাসের পানীয়ও নড়ছে না।

রফিক আজাদ ভাই মেঝেতে বসেছিলেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও অন্য এক জগতে চলে যান-  এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ফরিদাআমি তোর পা দুটো একটু স্পর্শ করব।” পাছে গানের আবহ নষ্ট হয়ভেবে বেলাল ভাই পাশের সোফা থেকে মাথা হেলিয়ে আস্তে আমাকে বলেন, “স্বদেশতুমি রফিককে বাইরে নিয়ে যাও।” রফিকভাইকে বীথি ভাবীর রুমে নিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বসতেই লাঞ্চের সময় হয়। ফরিদা পারভীন তার হারমোনিয়ামের সুর ও গান বন্ধ করেছেন ততক্ষণেতারপরও যেন সারা বাড়ি ঘিরে সেই গানের আবহ ঘুরছে। আমি ওই ভদ্রলোকের হাত ধরে বলি, “দাদাওটুকু শেষ করে ফেলুনএখনই লাঞ্চ নিতে হবে।” তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ও আবেগভরে বললেন, “স্বদেশআমি তোমাকে প্রশ্ন করার আগে বাংলাদেশকে বুঝতে পারিনি।

আজ ফরিদা পারভীন রোগশয্যায়বাংলাদেশও সুস্থ নয়সেও রোগশয্যায়। মানুষ অসুস্থ হলে ডাক্তার তাকে সুস্থ করে;  আজ চারপাশের অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবী থেকে- কেউ কেউ বদলে গেছেন তাই শুধু  লেখার মাধ্যমেই প্রার্থনা করছিফরিদা পারভীন সুস্থ হয়ে উঠুনকারণ সারা পৃথিবীতে তিনি লালনের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেনঅর্থাৎ সহজীয়া সংস্কৃতির বাংলাদেশযা প্রকৃত অর্থে পদ্মামেঘনাযমুনা বিধৌত বাংলাদেশের মূল চরিত্র

ফরিদা পারভীন ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেনকারণ চিকিৎসকদের প্রতি সকলের আস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যে রোগশয্যায়তাকে সুস্থ করার মতো নেতা তো চারপাশে আজ কেউ নেইযে অসুস্থতার দিকে যাচ্ছে দেশসেখানে কেউ নেইযে বলবে আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগর সকল দেশ।” লালনের সেই সহজিয়া বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ আজ কত দূরে চলে গেছেকত প্রজম্ম পরে তার হিসেব হবে- কে জানেতবুও এই বাংলাদেশ লালনের বাংলাদেশফরিদা পারভীনের কন্ঠে প্রকাশিত বাংলাদেশ- তাই এ বাংলাদেশের পদ্মার জলের ঢেউ এর ওপর বিশ্বাস হারায় না কেউ

লেখক: রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সম্পাদকসারাক্ষণ, The Present World

সেই সব দিনগুলো ও ফরিদা পারভীন

০৪:১৮:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ জুলাই ২০২৫

আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠান ঘিরে অনেক স্মৃতি গত কয়েকদিনে সামনে এসে ভিড় করছেলালন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনকে ঘিরে। তার অনেকগুলো অনুষ্ঠান হত উত্তরা (তখন উত্তরা এমন ঘিঞ্জি এলাকা হয়নি) আমাদের এক বন্ধুর স্বামীর বাসায়আর বেশির ভাগই গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়ধানমন্ডীর একটি গেস্টরুম কাম বাসা সহ নানান স্থানে।

এই সব অনুষ্ঠানে তপন রায় চৌধুরির প্রেসিডেন্সির বন্ধু সামাদভাইজিল্লুর রহমান সিদ্দিকী থেকে শুরু করে ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যও থাকতেন। আর শিল্পসাহিত্যিককবিসহ আমার মতো উটকো মানুষগুলো তো থাকতেই। একবার মনে পড়ে গুলশানে একটি বাচ্চা ছেলে গাড়ি চালাতে গিয়ে আমাদের রিকশায় ধাক্কা দেয়। পড়ে গিয়ে হাতে ফ্র্যাকচার হয়। বাসায় থেকে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নিতে হয়পাঁচ তলায় বাসালিফট ছিল না। দেখি অনিল দা ও বৌদিএম আর আখতার মুকুল ভাই ও রিমি কাছ থেকে খবর পেয়ে উপস্থিত। তারা বলেন, “হাতে আঘাত লেগেছেপা ঠিক আছেচলোরাতে অনেকেই গাইবেফরিদা পারভীনও গাইবে।” হাতে বেশ যন্ত্রণাতারপরেও তারা রেহাই দিতে চান না।

এমনই অনেক স্মৃতিযা মনে করলে একটা অনেক দীর্ঘ তরুণবেলাযুবকবেলা সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে যত দিন গেছেততই দেখেছি ফরিদা পারভীন যেন গানের শিল্পী থেকে ধীরে ধীরে এক বাউল সাধিকা হয়ে উঠছেন। গানগুলো গান থেকে অপার এক আরাধনায় রূপ নিচ্ছে।

সম্ভবত ১৯৯৬ কি ৯৭ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিক এসেছেন। সুনীল দা ও বৌদি উঠেছেন গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়অন্যরা হোটেলে ও অন্য অনেকের বাসায়। জয় গোস্বামী তখন তরুণসারাক্ষণ ত্রিদিব দস্তিদারের সঙ্গে।

গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই তখন সিদ্ধেশ্বরীর ৯ নম্বর ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার পাশেই ১৫ নম্বর বেইলি রোডে আমার যায়যায়দিন অফিস। গাজী ভাইয়ের একটা স্বভাব ছিলতিনি কোনো কিছু একা খেতে ভালোবাসতেন না  – নাআমাকে ও  ত্রিদিবকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন তাও আজো বুঝতে পারি না। সে কারণে প্রায় লাঞ্চের আগে বা ডিনারের আগে ফোন করতেনবা কখনও বেইলি রোডে এম আর আখতার মুকুল ভাইয়ের বুকশপে বসে মুকুল ভাইয়ের কর্মচারী রমজান বা কাউকে পাঠাতেনআমাকে ডাকার জন্যে।

সেদিন লাঞ্চের অনেক আগে তিনি ফোন করেন। হাতে কাজ ছিল নাসম্ভবত সোমবাররবিবার পত্রিকার পেস্টিং ও ছাপা শেষ হয়ে গেছেতাই সারাদিন কাজের চাপ কম। গাজী ভাইয়ের ফোন পেয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখিসুনীল গঙ্গোপাধ্যায়বীথি গঙ্গোপাধ্যায়শামসুর রাহমানকাইয়ুম চৌধুরীকবি ফজল শাহাবুদ্দিনকবি বেলাল চৌধুরীশহীদ আখন্দকবি রফিক আজাদজয় গোস্বামীকবি সৈয়দ হায়দার ও আরও পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি সাহিত্যিক। গাজী ভাইয়ের স্ত্রীঅর্থাৎ আমাদের আশ্রয়স্থল বীথি ভাবী,  সে সময়ে পায়ে কীভাবে যেন আঘাত পেয়েছিলেনতাই পায়ের ব্যথা নিয়ে শুয়েছিলেন। তার রুমে গিয়ে দেখি ফরিদা পারভীন তার সঙ্গে গল্প করছেনপাশে ত্রিদিব দস্তিদার দাঁড়িয়ে।

সুনীল দা ও ফরিদা পারভীন পরসে মাছ ভাজা পছন্দ করতেন। একজন ফরিদপুরেরআর একজন নাটোরে জন্মলেও কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠাতাই পারসে মাছ তাদের অনেক পছন্দের। গাজী ভাইকে মাছটি প্রথম চিনিয়েছিলাম আমিপ্রথমদিন পছন্দ করেননি। পরে সুনীল দা ও কাইয়ুম স্যারের পছন্দের জোরে তিনিও পছন্দ করতে শুরু করেন। রসুইখানা থেকে শুধু পারসে মাছ ভাজা নয়আরও ফিশ ফিঙ্গারকাবাবসবজির ভাজিপদাঁকোড়াঅর্থাৎ পানীয়ের সঙ্গে যা যা যায় সবই আসছে

সেখানে গিয়েই শিল্পি কাইয়ুম চৌধুরীও পশ্চিমবঙ্গের এক ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবিতাদের সঙ্গে আমি বসি। কাইয়ুম স্যার আমাকে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দুজনের মাঝখানে বসার ব্যবস্থা করে দেন

ওই বাড়ির পাশেই ছিল সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। জয় গোস্বামী শুনেছিলে ওই মন্দিরের কালী খুব জাগ্রত। সে সেখানে যেতে চায়। তাকে মন্দিরে নিয়ে যাবার জন্য গাজী ভাই ত্রিদিব দস্তিদারকে খুঁজছেন। ত্রিদিব তখনো ফরিদা পারভীন ও ভাবীর সঙ্গে কথা বলছিলে। ফরিদা পারভীনকে শিল্পী হিসেবে ত্রিদিব কতটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার চোখে দেখতোতা বলা কঠিনফরিদা পারভীনও ত্রিদিবকে অনেক স্নেহ করতেন। কোনো অনুষ্ঠানে ফরিদা পারভীনকে পাওয়ার ক্ষেত্রে যদি তার শিডিউল টাইট থাকতোতখন ত্রিদিবকে বলা হতোত্রিদিব তার কাছে গেলে বা ফোন করলে তিনি ফেলতে পারতেন না।

ত্রিদিবকে পেতে দেরি দেখে কাইয়ুম স্যার বলেন, “স্বদেশনিয়ে যাও না জয়কে” গাজী ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। কাইয়ুম ভাইও হেসে দিলেন। ত্রিদিব কোথা থেকে লাফ দিয়ে এসে জয় গোস্বামীকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দিকে চলে গেলে

এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের কাজ শেষে নবনীতা দেবসেন ফিরে এসেছেন। তিনি সরাসরি ড্রয়িং রুমে না এসে গাজী ভাইয়ের বাসায় তাঁর জন্যে বরাদ্দ রুমে গেলেন। কাইয়ুম স্যার নবনীতা দিদির সঙ্গে কথা বলতে কিছুক্ষনের জন্যে উঠে যান। এদিকে ফরিদা পারভীনের গানের সহযোগীরাঅর্থাৎ যন্ত্রীরা এসে তাদের আসন ঠিক করছেন। ওই সময় ওই ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবি মৃদু স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের এখানে কোনো অসুবিধা হয় না?” নব্বইয়ের দশকেও আমাদের প্রজন্মযারা ঢাকা শহর ও সারাদেশের বিশেষ শ্রেণিতে বেড়ে উঠেছিকখনও বুঝিনি আজকের এই বাংলাদেশ হবেতাই প্রথমে তাঁর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি বুঝতে পারেনআমি প্রশ্ন বুঝিনিতখন আস্তে বলেন, “এখানে আপনাদের হিন্দুদের অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের কোনো অসুবিধা হয় না?” এর মধ্যে কাইয়ুম স্যার ফিরে এসে তার আসনে বসেনফরিদা পারভীনও তার আসন নেন।

ফরিদা পারভীন হারমোনিয়ামের প্রতি মাথা একটু নিচু করে গান শুরু করেন, “আমি অপার হয়ে….—সঙ্গে সঙ্গে সারা রুমে নীরবতা নেমে আসেওই ভদ্রলোকের হাতে থাকা পানীয়ের গ্লাসটি মুখের দিকে এগোয় না। একটার পর একটা গান কখন শেষ হয়ে যাচ্ছেকেউ বুঝতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে দেখিঅন্যরা মাঝে মাঝে পানীয় ও খাবার নিলেও ওই ভদ্রলোকের গ্লাস তাঁর হাতে স্থির ভাবে ধরা এতটাই স্থির যে গ্লাসের পানীয়ও নড়ছে না।

রফিক আজাদ ভাই মেঝেতে বসেছিলেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও অন্য এক জগতে চলে যান-  এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ফরিদাআমি তোর পা দুটো একটু স্পর্শ করব।” পাছে গানের আবহ নষ্ট হয়ভেবে বেলাল ভাই পাশের সোফা থেকে মাথা হেলিয়ে আস্তে আমাকে বলেন, “স্বদেশতুমি রফিককে বাইরে নিয়ে যাও।” রফিকভাইকে বীথি ভাবীর রুমে নিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বসতেই লাঞ্চের সময় হয়। ফরিদা পারভীন তার হারমোনিয়ামের সুর ও গান বন্ধ করেছেন ততক্ষণেতারপরও যেন সারা বাড়ি ঘিরে সেই গানের আবহ ঘুরছে। আমি ওই ভদ্রলোকের হাত ধরে বলি, “দাদাওটুকু শেষ করে ফেলুনএখনই লাঞ্চ নিতে হবে।” তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ও আবেগভরে বললেন, “স্বদেশআমি তোমাকে প্রশ্ন করার আগে বাংলাদেশকে বুঝতে পারিনি।

আজ ফরিদা পারভীন রোগশয্যায়বাংলাদেশও সুস্থ নয়সেও রোগশয্যায়। মানুষ অসুস্থ হলে ডাক্তার তাকে সুস্থ করে;  আজ চারপাশের অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবী থেকে- কেউ কেউ বদলে গেছেন তাই শুধু  লেখার মাধ্যমেই প্রার্থনা করছিফরিদা পারভীন সুস্থ হয়ে উঠুনকারণ সারা পৃথিবীতে তিনি লালনের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেনঅর্থাৎ সহজীয়া সংস্কৃতির বাংলাদেশযা প্রকৃত অর্থে পদ্মামেঘনাযমুনা বিধৌত বাংলাদেশের মূল চরিত্র

ফরিদা পারভীন ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেনকারণ চিকিৎসকদের প্রতি সকলের আস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যে রোগশয্যায়তাকে সুস্থ করার মতো নেতা তো চারপাশে আজ কেউ নেইযে অসুস্থতার দিকে যাচ্ছে দেশসেখানে কেউ নেইযে বলবে আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগর সকল দেশ।” লালনের সেই সহজিয়া বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ আজ কত দূরে চলে গেছেকত প্রজম্ম পরে তার হিসেব হবে- কে জানেতবুও এই বাংলাদেশ লালনের বাংলাদেশফরিদা পারভীনের কন্ঠে প্রকাশিত বাংলাদেশ- তাই এ বাংলাদেশের পদ্মার জলের ঢেউ এর ওপর বিশ্বাস হারায় না কেউ

লেখক: রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সম্পাদকসারাক্ষণ, The Present World