আশির দশকের শেষে ও নব্বইয়ের দশকে ঢাকার অনেক ঘরোয়া অনুষ্ঠান ঘিরে অনেক স্মৃতি গত কয়েকদিনে সামনে এসে ভিড় করছে—লালন সঙ্গীত সম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভীনকে ঘিরে। তাঁর অনেকগুলো অনুষ্ঠান হত উত্তরায় (তখন উত্তরা এমন ঘিঞ্জি এলাকা হয়নি) আমাদের এক বন্ধুর স্বামীর বাসায়, আর বেশির ভাগই গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়; ধানমন্ডীর একটি গেস্টরুম কাম বাসা সহ নানান স্থানে।
এই সব অনুষ্ঠানে তপন রায় চৌধুরির প্রেসিডেন্সির বন্ধু সামাদভাই, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী থেকে শুরু করে ত্রিপুরার সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্যও থাকতেন। আর শিল্পী, সাহিত্যিক, কবিসহ আমার মতো উটকো মানুষগুলো তো থাকতোই। একবার মনে পড়ে গুলশানে একটি বাচ্চা ছেলে গাড়ি চালাতে গিয়ে আমাদের রিকশায় ধাক্কা দেয়। পড়ে গিয়ে হাতে ফ্র্যাকচার হয়। বাসায় থেকে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নিতে হয়; পাঁচ তলায় বাসা, লিফট ছিল না। দেখি অনিল দা ও বৌদি, এম আর আখতার মুকুল ভাই ও রিমি’র কাছ থেকে খবর পেয়ে উপস্থিত। তারা বলেন, “হাতে আঘাত লেগেছে, পা ঠিক আছে, চলো—রাতে অনেকেই গাইবে, ফরিদা পারভীনও গাইবে।” হাতে বেশ যন্ত্রণা, তারপরেও তারা রেহাই দিতে চান না।
এমনই অনেক স্মৃতি—যা মনে করলে একটা অনেক দীর্ঘ তরুণবেলা, যুবকবেলা সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে যত দিন গেছে, ততই দেখেছি ফরিদা পারভীন যেন গানের শিল্পী থেকে ধীরে ধীরে এক বাউল সাধিকা হয়ে উঠছেন। গানগুলো গান থেকে অপার এক আরাধনায় রূপ নিচ্ছে।
সম্ভবত ১৯৯৬ কি ৯৭ সালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ বেশ কয়েকজন পশ্চিমবঙ্গের কবি সাহিত্যিক এসেছেন। সুনীল দা ও বৌদি উঠেছেন গাজী শাহাবুদ্দিন ভাইয়ের বাসায়, অন্যরা হোটেলে ও অন্য অনেকের বাসায়। জয় গোস্বামী তখন তরুণ, সারাক্ষণ ত্রিদিব দস্তিদারের সঙ্গে।
গাজী শাহাবুদ্দিন ভাই তখন সিদ্ধেশ্বরীর ৯ নম্বর ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার পাশেই ১৫ নম্বর বেইলি রোডে আমার যায়যায়দিন অফিস। গাজী ভাইয়ের একটা স্বভাব ছিল, তিনি কোনো কিছু একা খেতে ভালোবাসতেন না – না, আমাকে ও ত্রিদিবকে একটু বাড়তি স্নেহ করতেন তাও আজো বুঝতে পারি না। সে কারণে প্রায় লাঞ্চের আগে বা ডিনারের আগে ফোন করতেন, বা কখনও বেইলি রোডে এম আর আখতার মুকুল ভাইয়ের বুকশপে বসে মুকুল ভাইয়ের কর্মচারী রমজান বা কাউকে পাঠাতেন—আমাকে ডাকার জন্যে।
সেদিন লাঞ্চের অনেক আগে তিনি ফোন করেন। হাতে কাজ ছিল না; সম্ভবত সোমবার—রবিবার পত্রিকার পেস্টিং ও ছাপা শেষ হয়ে গেছে, তাই সারাদিন কাজের চাপ কম। গাজী ভাইয়ের ফোন পেয়ে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বীথি গঙ্গোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, কাইয়ুম চৌধুরী, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি বেলাল চৌধুরী, শহীদ আখন্দ, কবি রফিক আজাদ, জয় গোস্বামী, কবি সৈয়দ হায়দার ও আরও পশ্চিমবঙ্গের অনেক কবি সাহিত্যিক। গাজী ভাইয়ের স্ত্রী, অর্থাৎ আমাদের আশ্রয়স্থল বীথি ভাবী, সে সময়ে পায়ে কীভাবে যেন আঘাত পেয়েছিলেন, তাই পায়ের ব্যথা নিয়ে শুয়েছিলেন। তার রুমে গিয়ে দেখি ফরিদা পারভীন তাঁর সঙ্গে গল্প করছেন, পাশে ত্রিদিব দস্তিদার দাঁড়িয়ে।
সুনীল দা ও ফরিদা পারভীন পারসে মাছ ভাজা পছন্দ করতেন। একজন ফরিদপুরের, আর একজন নাটোরে জন্মালেও কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠা, তাই পারসে মাছ তাদের অনেক পছন্দের। গাজী ভাইকে মাছটি প্রথম চিনিয়েছিলাম আমি; প্রথমদিন পছন্দ করেননি। পরে সুনীল দা ও কাইয়ুম স্যারের পছন্দের জোরে তিনিও পছন্দ করতে শুরু করেন। রসুইখানা থেকে শুধু পারসে মাছ ভাজা নয়, আরও ফিশ ফিঙ্গার, কাবাব, সবজির ভাজিপদ, পাঁকোড়া—অর্থাৎ পানীয়ের সঙ্গে যা যা যায় সবই আসছে।
সেখানে গিয়েই শিল্পি কাইয়ুম চৌধুরী, ও পশ্চিমবঙ্গের এক ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবি, তাঁদের সঙ্গে আমি বসি। কাইয়ুম স্যার আমাকে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে দুজনের মাঝখানে বসার ব্যবস্থা করে দেন।
ওই বাড়ির পাশেই ছিল সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। জয় গোস্বামী শুনেছিলো ওই মন্দিরের কালী খুব জাগ্রত। সে সেখানে যেতে চায়। তাকে মন্দিরে নিয়ে যাবার জন্য গাজী ভাই ত্রিদিব দস্তিদারকে খুঁজছেন। ত্রিদিব তখনো ফরিদা পারভীন ও ভাবীর সঙ্গে কথা বলছিলো। ফরিদা পারভীনকে শিল্পী হিসেবে ত্রিদিব কতটা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার চোখে দেখতো, তা বলা কঠিন; ফরিদা পারভীনও ত্রিদিবকে অনেক স্নেহ করতেন। কোনো অনুষ্ঠানে ফরিদা পারভীনকে পাওয়ার ক্ষেত্রে যদি তাঁর শিডিউল টাইট থাকতো, তখন ত্রিদিবকে বলা হতো, ত্রিদিব তাঁর কাছে গেলে বা ফোন করলে তিনি ফেলতে পারতেন না।
ত্রিদিবকে পেতে দেরি দেখে কাইয়ুম স্যার বলেন, “স্বদেশ, নিয়ে যাও না জয়কে।” গাজী ভাইয়ের ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিল। কাইয়ুম ভাইও হেসে দিলেন। ত্রিদিব কোথা থেকে লাফ দিয়ে এসে জয় গোস্বামীকে নিয়ে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের দিকে চলে গেলো।
এর মধ্যে কিশোরগঞ্জের কাজ শেষে নবনীতা দেবসেন ফিরে এসেছেন। তিনি সরাসরি ড্রয়িং রুমে না এসে গাজী ভাইয়ের বাসায় তাঁর জন্যে বরাদ্দ রুমে গেলেন। কাইয়ুম স্যার নবনীতা দিদির সঙ্গে কথা বলতে কিছুক্ষনের জন্যে উঠে যান। এদিকে ফরিদা পারভীনের গানের সহযোগীরা, অর্থাৎ যন্ত্রীরা এসে তাদের আসন ঠিক করছেন। ওই সময় ওই ভদ্রলোক ডাক্তার ও কবি মৃদু স্বরে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের এখানে কোনো অসুবিধা হয় না?” নব্বইয়ের দশকেও আমাদের প্রজন্ম, যারা ঢাকা শহর ও সারাদেশের বিশেষ শ্রেণিতে বেড়ে উঠেছি, কখনও বুঝিনি আজকের এই বাংলাদেশ হবে—তাই প্রথমে তাঁর প্রশ্ন বুঝতে না পেরে আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি। তিনি বুঝতে পারেন, আমি প্রশ্ন বুঝিনি; তখন আস্তে বলেন, “এখানে আপনাদের হিন্দুদের অর্থাৎ সংখ্যালঘুদের কোনো অসুবিধা হয় না?” এর মধ্যে কাইয়ুম স্যার ফিরে এসে তাঁর আসনে বসেন, ফরিদা পারভীনও তাঁর আসন নেন।
ফরিদা পারভীন হারমোনিয়ামের প্রতি মাথা একটু নিচু করে গান শুরু করেন, “আমি অপার হয়ে….—সঙ্গে সঙ্গে সারা রুমে নীরবতা নেমে আসে; ওই ভদ্রলোকের হাতে থাকা পানীয়ের গ্লাসটি মুখের দিকে এগোয় না। একটার পর একটা গান কখন শেষ হয়ে যাচ্ছে, কেউ বুঝতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে দেখি, অন্যরা মাঝে মাঝে পানীয় ও খাবার নিলেও ওই ভদ্রলোকের গ্লাস তাঁর হাতে স্থির ভাবে ধরা —এতটাই স্থির যে গ্লাসের পানীয়ও নড়ছে না।
রফিক আজাদ ভাই মেঝেতে বসেছিলেন। গানের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও অন্য এক জগতে চলে যান- এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “ফরিদা, আমি তোর পা দুটো একটু স্পর্শ করব।” পাছে গানের আবহ নষ্ট হয়, ভেবে বেলাল ভাই পাশের সোফা থেকে মাথা হেলিয়ে আস্তে আমাকে বলেন, “স্বদেশ, তুমি রফিককে বাইরে নিয়ে যাও।” রফিকভাইকে বীথি ভাবীর রুমে নিয়ে গিয়ে ফিরে এসে বসতেই লাঞ্চের সময় হয়। ফরিদা পারভীন তাঁর হারমোনিয়ামের সুর ও গান বন্ধ করেছেন ততক্ষণে; তারপরও যেন সারা বাড়ি ঘিরে সেই গানের আবহ ঘুরছে। আমি ওই ভদ্রলোকের হাত ধরে বলি, “দাদা, ওটুকু শেষ করে ফেলুন—এখনই লাঞ্চ নিতে হবে।” তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন ও আবেগভরে বললেন, “স্বদেশ, আমি তোমাকে প্রশ্ন করার আগে বাংলাদেশকে বুঝতে পারিনি।”
আজ ফরিদা পারভীন রোগশয্যায়—বাংলাদেশও সুস্থ নয়, সেও রোগশয্যায়। মানুষ অসুস্থ হলে ডাক্তার তাকে সুস্থ করে; আজ চারপাশের অনেকেই চলে গেছেন পৃথিবী থেকে- কেউ কেউ বদলে গেছেন– তাই শুধু লেখার মাধ্যমেই প্রার্থনা করছি, ফরিদা পারভীন সুস্থ হয়ে উঠুন, কারণ সারা পৃথিবীতে তিনি লালনের বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন—অর্থাৎ সহজীয়া সংস্কৃতির বাংলাদেশ, যা প্রকৃত অর্থে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা বিধৌত বাংলাদেশের মূল চরিত্র।
ফরিদা পারভীন ঠিকই সুস্থ হয়ে উঠবেন; কারণ চিকিৎসকদের প্রতি সকলের আস্থা আছে। কিন্তু বাংলাদেশ যে রোগশয্যায়, তাকে সুস্থ করার মতো নেতা তো চারপাশে আজ কেউ নেই—যে অসুস্থতার দিকে যাচ্ছে দেশ, সেখানে কেউ নেই, যে বলবে “আমার জীবনে লভিয়া জীবন জাগরে সকল দেশ।” লালনের সেই সহজিয়া বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ আজ কত দূরে চলে গেছে, কত প্রজম্ম পরে তার হিসেব হবে- কে জানে! তবুও এই বাংলাদেশ লালনের বাংলাদেশ, ফরিদা পারভীনের কন্ঠে প্রকাশিত বাংলাদেশ- তাই এ বাংলাদেশের পদ্মার জলের ঢেউ এর ওপর বিশ্বাস হারায় না কেউ।
লেখক: রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World।