সারাংশ
- • করিমের গানে বারবার উঠে এসেছে সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবাদের বার্তা
- • সাম্প্রদায়িকতা রোধে এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে তাঁর দর্শনের আলোকে সমাজকে মানবতার পথে ফিরিয়ে আনা জরুরি
- • করিম যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন এবং শান্তি-সম্প্রীতির গান গাইতেন
শাহ আবদুল করিম—লোকসংগীতের এক কিংবদন্তি নাম। জন্মেছিলেন ১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার উজানধল গ্রামে। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার মাটির গভীর দর্শন আর সাম্যের গানের ফেরিওয়ালা। তাঁর গান বাংলার মানুষের হৃদয়ে স্পন্দিত হয়ে চলেছে, বিশেষত যারা বিশ্বাস করেন মানবতাই সকল ধর্মের মূল।
শাহ আবদুল করিমের দর্শন
শাহ আবদুল করিমের গানের মূল সুর ছিল সাম্য, মানবতা ও সম্প্রীতির বার্তা। সমাজের অসঙ্গতি, ধর্মীয় সংকীর্ণতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন তাঁর সুর ও কথায়। তাঁর জনপ্রিয় একটি গানে তিনি লিখেছেন:
“আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম,
গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান,
মিলিয়া বাউল গান আর মুর্শিদি গাইতাম।”
এ গানের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় তাঁর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আহ্বান। তিনি তাঁর গান ও চিন্তার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন যে, হিন্দু-মুসলিমের সম্প্রীতির ঐতিহ্য বাংলার মাটিতে বহু শতাব্দী ধরে। ধর্মের ভিন্নতা নয়, মানবতার মূল্যবোধই আসল।
তৎকালীন বাংলাদেশ ও বর্তমান বাস্তবতা
শাহ আবদুল করিম যে সময়ে জন্মেছিলেন, তখন অবিভক্ত বাংলা ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল উদাহরণ। যদিও ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে এবং দেশভাগের পরে ধর্মীয় বিভেদ তীব্রতর হয়, তবু গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সহজে ছিন্ন হয়নি। এই পরিবেশেই শাহ আবদুল করিম বেড়ে ওঠেন এবং তাঁর সৃষ্টিতে বারবার ফিরে এসেছে মানবতার অটুট বিশ্বাস।
কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবস্থা আগের মতো নেই। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ নানা সময় নির্যাতন, জমি দখল, পূজামণ্ডপে হামলা, এমনকি মিথ্যা গুজবের শিকার হয়ে সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছেন। শাহ আবদুল করিম বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এই অরাজকতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতেন। তাঁর দর্শনে কোনো ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং মানুষের পরিচয়ই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের বর্তমান অবস্থা
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছে। অনেক এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সংবিধান তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। জমি দখলের অভিযোগ, মন্দির ভাঙচুর ও সামাজিক বৈষম্যের ঘটনা বেড়েছে।
শাহ আবদুল করিম আজকের দিনে থাকলে তাঁর কণ্ঠ হতো আরও জোরালো। তিনি হয়তো আবারও লিখতেন, আবারও গাইতেন মানুষের সম্মিলিত পরিচয় ও শান্তির বার্তা। তাঁর দর্শনে ধর্ম নয়, মানবতার বন্ধনই শ্রেষ্ঠ।
প্রয়োজন মানবিক চেতনার পুনর্জাগরণ
শাহ আবদুল করিমের জীবন ও দর্শন আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ তাঁরই দেখানো মানবিক চেতনায় ফিরে আসা। বাংলা মাটিতে হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সম্প্রীতি নিশ্চিত করার জন্য শাহ আবদুল করিমের গান ও চিন্তা আজও পথ দেখায়।
শাহ আবদুল করিম বেঁচে আছেন তাঁর সৃষ্টিতে আর সেই সৃষ্টিই আমাদের সমাজের জন্য হতে পারে মানবতা ও সম্প্রীতির এক শক্তিশালী দিকনির্দেশক।