০৮:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর নতুন বেতন কমিশন গঠন করবে পরবর্তী সরকার: সালেহউদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাঁচ মামলায় জামিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিতে সহানুভূতির আহ্বান জানালেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার বর্তমান ইন্টারিম সরকার আমলে আইএমএফ পরবর্তী কিস্তি ঋণ দেবে না সার্বিক কৃষি সরবরাহ নিশ্চিত করতে ইউরিয়া ও টিএসপি সার আমদানির অনুমোদন তীব্র ঢেউয়ে তেনেরিফেতে ৩ জনের মৃত্যু, উপকূলে সতর্কতা জারি

স্বৈরাচারের কবলে যখনই দেশ, তখনই ফিরে আসে নূরুলদীন

বাংলা নাট্যধারায় এমন ক’টি রচনা আছে, যেগুলো বারবার দর্শককে কাঁদায়-জাগায় এবং স্বৈরশাসনের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস জোগায়। সৈয়দ শামসুল হকের “নূরলদীনের সারাজীবন” সেই বিরল কাব্যনাট্য; যেখানে ইতিহাস, কবিতা ও রাজনীতি মিলেমিশে এক অনিবার্য মুক্তিসংগ্রামের আর্তনাদ হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক নূরলদীন থেকে মঞ্চের নূরলদীন

১৮ শতকের শেষভাগে রংপুর অঞ্চলের কৃষক-বিদ্রোহী নূরলদীন—ইংরেজ শাসক, নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, “জাগো বাহে কুনঠে সবাই”—হকের কলমে রূপ পেয়েছেন জনতার মুক্তির চিরকালীন প্রতীকে। এই কণ্ঠস্বর শুধু একটি বিক্ষুব্ধ সময় নয়; মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকেও স্পর্শ করে।

কবিতার ছন্দে প্রতিবাদ

রচনাটি শুদ্ধ ‘কাব্যনাট্য’—ছন্দ, অলংকার ও সংগীতের স্বর্গীয় মিশেলে গড়া। সংলাপ শোনা মাত্রই মনে হয় কবিতা উচ্চারিত হচ্ছে; তবু প্রতিটি পঙক্তি যেন কৃষকের কাস্তে-বঁটি হয়ে শোষকের বুকে গেঁথে যায়। সুর ও তাল হকেরই লেখা স্বাধীনতার গান, যেখানে “ডাক দেবেই”-এর প্রত্যয় দর্শকের বুকের ভেতর ঢেউ তোলে।

প্রথম মঞ্চায়ন ও মঞ্চের ভাষা

নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৮২ সালে, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ব্যানারে; নির্দেশনায় আলী যাকের, মঞ্চসজ্জায় শেখ মনসুরউদ্দিন আহমেদ। প্রথম প্রদর্শন থেকেই এর গীতিময় কাব্য ও মহাকাব্যিক রূপ-উচ্ছ্বাস দর্শক-সমালোচককে অভিভূত করে।

চরিত্রপুঞ্জ ও প্রতীকী জগত

নূরলদীন এখানে কেবল ঐতিহাসিক নায়ক নন—তিনি স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি। বিপরীতে জমিদার-ইংরেজ চরিত্রেরা শোষণযন্ত্রের একক ও সমষ্টিগত মুখ। কৃষক-জনতা মাটির ঘ্রাণ নিয়ে মঞ্চে উঠে আসে অবদমিত স্বপ্নের প্রতিনিধি হিসেবে, আর নারী-চরিত্রেরা রক্তে-মাটিতে বাঁধা বাংলার মায়ের অমর অবয়ব। প্রতিটি চরিত্র কাব্যময় উচ্চারণে শ্রেণি-সংঘাতের গভীর রাজনৈতিক অনুবাদ হাজির করে।

মুখ্য প্রতিপাদ্য

স্বৈরাচার-বিরোধিতা, নিপীড়িতের অধিকার, নেতা-জনতার সেতুবন্ধ এবং ‘পরাজয় সাময়িক—আদর্শ অমর’—এই চার স্তম্ভে দাঁড়ানো নাটকটি বারবার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিবাদ কখনও স্তব্ধ হয় না।

গানের আবহ ও দৃশ্যমান কবিতা

কে বি আল আজাদের আবহসংগীত, কাইয়ুম চৌধুরীর পোস্টার-শৈলী—সবকিছু মিলিয়ে “নূরলদীনের সারাজীবন” প্রতিটি দৃশ্যকে ধ্বনি-রং-আলোর সুষমা দেয়। যখন মঞ্চজুড়ে গান ওঠে—“জাগো বাহে কুনঠে সবাই”—তখন দর্শক কেবল দর্শক থাকে না; সে নিজেও আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে।

সমালোচকের দৃষ্টিতে

বিরতির আগের ‘কালের মানচিত্র’ এবং পরের ‘মনের মানচিত্র’—দুটি ভাগেই হক ইতিহাসকে তথ্য হিসেবে নয়, যন্ত্রণার জীবন্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখিয়েছেন। এ কারণেই নাটকটি আড়াই-ঘণ্টার মঞ্চায়নে কখনও দলিল, কখনও গীতিকবিতা, কখনও বা প্রতিবাদের মশাল—সব রূপেই গ্রহণযোগ্য।

সমকালীন পুনর্মঞ্চায়ন ও প্রাসঙ্গিকতা

স্বৈরাচারের মুখোমুখি যখনই দেশ, তখনই এই নাটক নতুন ব্যাখ্যায় মঞ্চে ফিরে আসে—সেলিম আল দীন থেকে সাম্প্রতিক তরুণ নির্দেশক—সবার হাতেই এর ভাষা নতুন জ্যোতি পায়। প্রতিবার দর্শক-শ্রোতা প্রশ্ন করেন, স্বাধীনতার ডাক কি আজও শেষ হয়েছে? উত্তর আসে মঞ্চ থেকেই—“ডাক দেবেই, মানুষ জাগবেই।”

“নূরলদীনের সারাজীবন” শুধু নাট্যপাঠ নয়, বাঙালির প্রতিবাদ-ইতিহাসের জীবন্ত নথি। অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে যেখানে-যেখানে কণ্ঠ উচ্চকিত হবে, সেখানে-সেখানেই নূরলদীনের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হবে—“জাগো বাহে কুনঠে সবাই!” যুগের পর যুগ, নেতা-জনতার অটুট বন্ধনে, এই কাব্যনাট্যই স্মরণ করিয়ে দেবে—স্বাধীন মানুষের সমাজ গড়ার লড়াই শেষ হয় না; মুক্তির স্বপ্ন বেঁচে থাকে বিদ্রোহের ছন্দে, ঐক্যের গানে।

জনপ্রিয় সংবাদ

পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’

স্বৈরাচারের কবলে যখনই দেশ, তখনই ফিরে আসে নূরুলদীন

১০:০০:৫৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫

বাংলা নাট্যধারায় এমন ক’টি রচনা আছে, যেগুলো বারবার দর্শককে কাঁদায়-জাগায় এবং স্বৈরশাসনের মুখোমুখি দাঁড়াতে সাহস জোগায়। সৈয়দ শামসুল হকের “নূরলদীনের সারাজীবন” সেই বিরল কাব্যনাট্য; যেখানে ইতিহাস, কবিতা ও রাজনীতি মিলেমিশে এক অনিবার্য মুক্তিসংগ্রামের আর্তনাদ হয়ে ওঠে।

ঐতিহাসিক নূরলদীন থেকে মঞ্চের নূরলদীন

১৮ শতকের শেষভাগে রংপুর অঞ্চলের কৃষক-বিদ্রোহী নূরলদীন—ইংরেজ শাসক, নীলকর ও জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, “জাগো বাহে কুনঠে সবাই”—হকের কলমে রূপ পেয়েছেন জনতার মুক্তির চিরকালীন প্রতীকে। এই কণ্ঠস্বর শুধু একটি বিক্ষুব্ধ সময় নয়; মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকেও স্পর্শ করে।

কবিতার ছন্দে প্রতিবাদ

রচনাটি শুদ্ধ ‘কাব্যনাট্য’—ছন্দ, অলংকার ও সংগীতের স্বর্গীয় মিশেলে গড়া। সংলাপ শোনা মাত্রই মনে হয় কবিতা উচ্চারিত হচ্ছে; তবু প্রতিটি পঙক্তি যেন কৃষকের কাস্তে-বঁটি হয়ে শোষকের বুকে গেঁথে যায়। সুর ও তাল হকেরই লেখা স্বাধীনতার গান, যেখানে “ডাক দেবেই”-এর প্রত্যয় দর্শকের বুকের ভেতর ঢেউ তোলে।

প্রথম মঞ্চায়ন ও মঞ্চের ভাষা

নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৮২ সালে, নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের ব্যানারে; নির্দেশনায় আলী যাকের, মঞ্চসজ্জায় শেখ মনসুরউদ্দিন আহমেদ। প্রথম প্রদর্শন থেকেই এর গীতিময় কাব্য ও মহাকাব্যিক রূপ-উচ্ছ্বাস দর্শক-সমালোচককে অভিভূত করে।

চরিত্রপুঞ্জ ও প্রতীকী জগত

নূরলদীন এখানে কেবল ঐতিহাসিক নায়ক নন—তিনি স্বাধীনতার প্রতিমূর্তি। বিপরীতে জমিদার-ইংরেজ চরিত্রেরা শোষণযন্ত্রের একক ও সমষ্টিগত মুখ। কৃষক-জনতা মাটির ঘ্রাণ নিয়ে মঞ্চে উঠে আসে অবদমিত স্বপ্নের প্রতিনিধি হিসেবে, আর নারী-চরিত্রেরা রক্তে-মাটিতে বাঁধা বাংলার মায়ের অমর অবয়ব। প্রতিটি চরিত্র কাব্যময় উচ্চারণে শ্রেণি-সংঘাতের গভীর রাজনৈতিক অনুবাদ হাজির করে।

মুখ্য প্রতিপাদ্য

স্বৈরাচার-বিরোধিতা, নিপীড়িতের অধিকার, নেতা-জনতার সেতুবন্ধ এবং ‘পরাজয় সাময়িক—আদর্শ অমর’—এই চার স্তম্ভে দাঁড়ানো নাটকটি বারবার মনে করিয়ে দেয়, প্রতিবাদ কখনও স্তব্ধ হয় না।

গানের আবহ ও দৃশ্যমান কবিতা

কে বি আল আজাদের আবহসংগীত, কাইয়ুম চৌধুরীর পোস্টার-শৈলী—সবকিছু মিলিয়ে “নূরলদীনের সারাজীবন” প্রতিটি দৃশ্যকে ধ্বনি-রং-আলোর সুষমা দেয়। যখন মঞ্চজুড়ে গান ওঠে—“জাগো বাহে কুনঠে সবাই”—তখন দর্শক কেবল দর্শক থাকে না; সে নিজেও আন্দোলনের সহযোদ্ধা হয়ে ওঠে।

সমালোচকের দৃষ্টিতে

বিরতির আগের ‘কালের মানচিত্র’ এবং পরের ‘মনের মানচিত্র’—দুটি ভাগেই হক ইতিহাসকে তথ্য হিসেবে নয়, যন্ত্রণার জীবন্ত অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখিয়েছেন। এ কারণেই নাটকটি আড়াই-ঘণ্টার মঞ্চায়নে কখনও দলিল, কখনও গীতিকবিতা, কখনও বা প্রতিবাদের মশাল—সব রূপেই গ্রহণযোগ্য।

সমকালীন পুনর্মঞ্চায়ন ও প্রাসঙ্গিকতা

স্বৈরাচারের মুখোমুখি যখনই দেশ, তখনই এই নাটক নতুন ব্যাখ্যায় মঞ্চে ফিরে আসে—সেলিম আল দীন থেকে সাম্প্রতিক তরুণ নির্দেশক—সবার হাতেই এর ভাষা নতুন জ্যোতি পায়। প্রতিবার দর্শক-শ্রোতা প্রশ্ন করেন, স্বাধীনতার ডাক কি আজও শেষ হয়েছে? উত্তর আসে মঞ্চ থেকেই—“ডাক দেবেই, মানুষ জাগবেই।”

“নূরলদীনের সারাজীবন” শুধু নাট্যপাঠ নয়, বাঙালির প্রতিবাদ-ইতিহাসের জীবন্ত নথি। অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে যেখানে-যেখানে কণ্ঠ উচ্চকিত হবে, সেখানে-সেখানেই নূরলদীনের বজ্রকণ্ঠ ধ্বনিত হবে—“জাগো বাহে কুনঠে সবাই!” যুগের পর যুগ, নেতা-জনতার অটুট বন্ধনে, এই কাব্যনাট্যই স্মরণ করিয়ে দেবে—স্বাধীন মানুষের সমাজ গড়ার লড়াই শেষ হয় না; মুক্তির স্বপ্ন বেঁচে থাকে বিদ্রোহের ছন্দে, ঐক্যের গানে।