রাজা আনন্দে রাজ্যের প্রধানকর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন আর প্রতিদিন গীতবাদ্য ভোজ ফুলফল নিবেদন ইত্যাদি খুব আদর যত্ন চলতে লাগল।
হর্ষবর্ধন
এর দু দিন পরে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মন (কুমার রাজা) শীলভদ্রের কাছে এই লিখে দূত পাঠালেন, ‘আপনার এ শিষ্য চীনদেশের ভিক্ষুপ্রবরকে দেখতে চায়। মহাশয় অনুগ্রহ করে তাঁকে পাঠান।’
এর কিছুদিন আগে এক ঘটনা ঘটেছিল, সেটা এখানে বলা দরকার। প্রজ্ঞাগুপ্ত নামক দক্ষিণভারতের এক রাজগুরু মহাযানের বিপক্ষে আর হীনযানের পক্ষে সাত শত শ্লোকে একখানা পুস্তক লিখেছিলেন। উড়িষ্যার হীনযানীরা সেইখানা মহারাজ হর্ষবর্ধনকে দিয়ে আস্ফালন করায়, মহারাজ বললেন, ‘একপক্ষের কথায় তো মীমাংসা হতে পারে না। একটা সভা আহ্বান করে দুই পক্ষেরই বিচার শোনা যাক।’-এই বলে তিনি নালন্দায় ধর্মগুরু সন্ধমপিটক শীলভদ্রের কাছে লিখে পাঠালেন যে, তিনি যেন অনুগ্রহ করে দুই যানেরই শাস্ত্রে অভিজ্ঞ চারজন মহাপণ্ডিতকে এই বিচারসভায় পাঠান। শীলভদ্র যে চারজন পণ্ডিত নির্বাচন করেছিলেন, হিউএনচাঙ ছিলেন তার মধ্যে একজন। কিন্তু মহারাজ অন্য কার্যে ব্যাপৃত থাকায় এই সভার অধিবেশন কিছুদিন স্থগিত ছিল।
এখন কুমাররাজের নিমন্ত্রণ এলে শীলভদ্র বললেন যে, এখন যদি হিউএনচাঙ কামরূপে যান, আর ইতিমধ্যে হর্ষবর্ধন যদি তাঁকে ডেকে পাঠান, তা হলে কী হবে? তাই তিনি কুমাররাজকে লিখলেন, চীনদেশের ভিক্ষু নিজ দেশে ফিরে যেতে চান, তিনি এখন কামরূপ যেতে পারবেন না। তাতে কামরূপরাজ আবার লিখলেন, অল্প কিছুদিন দেরিহলে কী ক্ষতি হবে? তাঁর দেশে ফিরবার কোনো বিঘ্ন হবে না। আমার। সনির্বন্ধ অনুরোধ, একবার আসতে অমত করবেন না।
এবারও শীলভদ্র অসম্মতি প্রকাশ করায় কুমাররাজা সক্রোধে আবার তৃতীয় আর একখানা চিঠি লিখে পাঠালেন- আপনার এ শিষ্য এতকাল সাংসারিক আনন্দই চেয়েছে, বৌদ্ধধর্ম শিক্ষা করে নি। এখন বিদেশী ভিক্ষুর কথা শুনে আশা করেছিলাম যে, ধর্মের বীজ আমার হৃদয়ে বপন হবে। আপনি, মহাশয়, আবার আমাকে নিরাশ করতে চাচ্ছেন। আপনি কি পৃথিবীর লোককে অন্ধকারে রাখতে চান? আমি আবার তাঁকে পাঠাতে লিখছি। এবারও যদি তিনি না আসেন, তা হলে আমার কুবুদ্ধিরই জয় হবে। প্রয়োজন হলে আমার সৈন্তদল আর হাতীগুলি নিয়ে গিয়ে নালন্দা সঙ্ঘারাম ধূলিসাৎ করে দেব। এ কথার ব্যত্যয় হবে না। গুরু, ভালো করে ভেবে দেখুন!
এ চিঠি পেয়ে শীলভদ্র হিউএনচাঙকে বললেন, এ রাজার বুদ্ধি কম। এর দেশে বুদ্ধের ধর্মও এর খুব ভক্তি হয়েছে। নিয়তি। অতএব আর তেমন প্রচার হয় নি। আপনার প্রতি দেখছি হয়তো এ সময়ে একে সম্বুদ্ধি দেওয়াই আপনার বিলম্ব না করে একবার যান। রাজার মন যদি খুলে দিতে পারেন, তা হলে প্রজাদেরও হয়তো ধর্মে মতি হতে পারে।
অতঃপর গুরুর কাছে বিদায় নিয়ে হিউএনচাঙ রাজদূতের সঙ্গে কামরূপে গেলেন। রাজা আনন্দে রাজ্যের প্রধানকর্মচারীদের সঙ্গে নিয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা করে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন আর প্রতিদিন গীতবাদ্য ভোজ ফুলফল নিবেদন ইত্যাদি খুব আদর যত্ন চলতে লাগল। অবশ্য ধর্ম-গুরুকে তিনি উপবাসাদি করতে অনুমতি দিলেন।
(চলবে)