জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের এক বছর পর এসে অনেক কিছু বদলে গেছে, আবার অনেক কিছু বদলায়নি। ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ছাত্র-তরুণদের জাগরণ যেন এক নতুন রাজনৈতিক ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম, রাষ্ট্রব্যবস্থার বদ্ধ জলাশয়ে একটি পাথর নিক্ষিপ্ত হয়েছে—প্রচলিত সমাজ ও রাজনীতির বৃত্তচ্যুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তৈরি হয়েছে নতুন প্রত্যাশা ও দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু আজ এক বছর পর এসে যখন দৈনিক প্রথম আলোতে দেওয়া আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মোঃ নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার পড়ি, তখন মনে কিছুটা বিষণ্নতা মিশে যায় আশার রঙে। যেমন হওয়ার কথা ছিল, তেমন হয়নি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। তবে হতাশ হওয়ার সময় এখনো আসেনি। পরিবর্তনের পথ কণ্টকাকীর্ণ হলেও তা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আত্মবিশ্লেষণ, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি যৌথ দিকরেখা।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না পুনঃস্থাপন?
নাহিদ ইসলামের কথায় আমরা স্পষ্ট শুনতে পাই, রাজনৈতিক সংস্কারের যে আশাভরা প্রত্যয় নিয়ে তরুণেরা রাজপথে নেমেছিল, সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি আমরা। তিনি বলেন, “শেখ হাসিনার পতনের পর সবাই এক জায়গায় থাকেনি।” এ কথাটি নিছক একটি মন্তব্য নয়, এটি একটি রাজনৈতিক সত্য এবং আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অন্তর্গত অসংহত এক বাস্তবতা। প্রথাগত রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনের শুরুর দিকে মুখে মুখে এক হয়ে উঠলেও, সময় গড়াতেই নিজেদের দলগত হিসাব-নিকাশ বড় করে দেখতে শুরু করেছে। বিশেষত বিএনপিকে নিয়ে নাহিদ ইসলামের সমালোচনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
তিনি বলেন, “বিএনপি বা যেকোনো দল যদি পুরনো বন্দোবস্ত রক্ষা করতে চায় বা আওয়ামী লীগের জায়গায় পুনঃস্থাপিত হতে চায়, তাহলে অবশ্যই তাকে নতুন আওয়ামী লীগ হিসেবে দেখা হবে।” এই বক্তব্যের গভীরতা অনুধাবন করতে গেলে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হয়—আমাদের রাজনীতি কি কেবল ক্ষমতার হাতবদলের খেলা? যদি তাই হয়, তাহলে সেই খেলার নিয়ম ও দর্শকদের প্রত্যাশা পুরোনোভাবেই চলবে এবং তখন আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্য—রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তন—আধা-সম্পন্ন স্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।
দল নয়, দর্শন হোক ভিত্তি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রবণতা দেখা গেছে—এ নয় তো ও। অর্থাৎ, একদলকে সরিয়ে আরেকদলের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু এই দ্বিমেরু রাজনৈতিক বাস্তবতা আমাদের কোথাও নিয়ে যায়নি, শুধু নাম পাল্টে একই চিত্রনাট্য আবৃত্তি করে চলেছে। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে আমরা এই বৃত্তচক্র ভাঙার আহ্বান দেখতে পাই। তার ভাষ্য অনুসারে, দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে আমাদের দরকার রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, অনেক সময় দেখা গেছে—একই দুর্নীতিগ্রস্ত নীতিনির্ধারক, ক্ষমতা-লোভী রাজনীতিবিদ কিংবা প্রশাসনিক অদক্ষতা এক দিক থেকে অন্য দিকে শুধু সরিয়ে নেওয়া হয়, কিন্তু নতুন কোনো কাঠামো তৈরি হয় না।
অর্থাৎ, আমাদের “ক্ষমতায় কে যাবে” এই প্রশ্নের চেয়ে বড় হওয়া দরকার “কেন যাবে” এবং “যে যাবে সে কী দেবে” এই প্রশ্নগুলো। এ জায়গা থেকেই রাজনৈতিক পরিবর্তনের চেয়ে রাজনৈতিক রূপান্তরের দাবি জোরালো হওয়া উচিত।
‘মব’ সন্ত্রাস ও আন্দোলনের কাঠামোগত দুর্বলতা
নাহিদ ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে ‘মব সন্ত্রাস’ নিয়ে কিছুটা নমনীয়তা দেখিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠতে পারে। এটি স্পষ্টভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আন্দোলনের সময় সংঘটিত কিছু সহিংস ঘটনা, যেমন প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, সাংবাদিক নিপীড়ন কিংবা রাস্তাবন্ধ, অনেক ক্ষেত্রেই আন্দোলনের নৈতিক উচ্চতা নষ্ট করেছে। এটি শুধু সরকারের বিরুদ্ধে জনসমর্থন হ্রাস করেনি, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যেও আন্দোলন নিয়ে দ্বিধা তৈরি করেছে।
তবে এই সহিংসতার প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলার আগে আমাদের ভাবতে হবে—এই সহিংসতা কি একটি সংগঠিত মতবাদ ছিল, না কি রাষ্ট্রীয় দমননীতির প্রতিক্রিয়া? ইতিহাস বলে, দমন আর প্রতিরোধের মাঝখানে যদি আদর্শ না থাকে, তাহলে তা ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। নাহিদ ইসলাম যদি মব সন্ত্রাসকে আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নেন, তবে তা আন্দোলনের আদর্শিক ভিত্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। কিন্তু যদি তিনি বোঝাতে চান—রাষ্ট্র যখন শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের সব পথ রুদ্ধ করে, তখন কিছু বিশৃঙ্খলা অনিবার্য হয়ে পড়ে—তাহলে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে বোঝার দরকার আছে।
এখানেই আন্দোলনের নেতৃত্বের জন্য আত্মসমালোচনার জায়গা রয়েছে। একটি আদর্শিক আন্দোলনের নেতৃত্ব কখনোই নিজেকে জন-অসন্তোষের আবেগে হারিয়ে ফেলতে পারে না। তারা হতে পারে স্রোতের সংগঠক, কিন্তু কখনোই উত্তাল জোয়ারের অনিয়ন্ত্রিত অংশ নয়।
ড. ইউনূস, অন্তর্বর্তী সরকার ও ঘোষণা-শূন্যতা
নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকারে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে—ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা নিয়ে হতাশা। তার মতে, জুলাইয়ে ঘোষণা না দেওয়া একটি বড় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি করেছে। একটি সম্ভাব্য রাজনৈতিক মধ্যপথ, একটি ন্যায্য অন্তর্বর্তী সময়সীমার ঘোষণা কিংবা একটি যৌথ নির্বাচনী রোডম্যাপ—এই সবকিছুর অনুপস্থিতি আন্দোলনের পরবর্তী গতিকে জটিল করে তুলেছে।
আমরা জানি, অতীতেও এ দেশে অন্তর্বর্তীকালীন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সময় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, যেমন বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ কিংবা ফখরুদ্দীন আহমদের মতো ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ড. ইউনূস তেমন একটি সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যখন তিনি প্রত্যাশিত সময়ের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক রূপরেখা দিতে ব্যর্থ হন, তখন নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হয় এবং অস্পষ্টতা ছড়ায়।
তবে তার ব্যর্থতা পুরোপুরি ব্যক্তিগত নয়। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সীমাবদ্ধতা, বিচার বিভাগের দ্বিধাগ্রস্ত ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক মহলের দ্বৈত নীতি সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবাই এক হবে না, কিন্তু বিভাজন অনিষ্টকর না হোক
নাহিদ ইসলাম এও মনে করিয়ে দিয়েছেন—সবাই এক মতের হবে না। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কিন্তু মতপার্থক্য যখন অনিষ্টকর হয়ে ওঠে, তখন তা গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। “মত”কে “শত্রুতা”য় রূপ দেওয়া এবং মতানৈক্যকে অবিশ্বাসে পরিণত করা—এই চর্চা এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। রাষ্ট্রের সংস্কারে একক পথে আসা কঠিন। বরং বহুমতের একটি সম্মিলিত রূপরেখাই আমাদের ভবিষ্যতের পথ দেখাতে পারে। এর জন্য দরকার আন্তঃদলীয় সংলাপ এবং মতানৈক্যকে সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করার রাজনৈতিক পরিপক্বতা।
আমরা দেখেছি—ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, এমনকি সাম্প্রতিক চিলি ও কলম্বিয়াতেও সমাজে ব্যাপক রাজনৈতিক বিভাজন থাকলেও তারা কোনো একসময় ন্যূনতম জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে অগ্রসর হতে পেরেছে। আমাদেরও দরকার এমন একটি কাঠামো, যেখানে দ্বিমত থাকবে, বিতর্ক থাকবে, কিন্তু সহিংসতা বা দমননীতি থাকবে না।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে প্রাধান্য দিতে হবে
সবশেষে, এই পুরো আন্দোলনের অন্যতম ভিত্তি ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক—সব খাতে বৈষম্য শুধু ন্যায়বিচারকেই ধ্বংস করে না, তা রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার প্রধান অন্তরায়ও। নাহিদ ইসলামের বক্তব্যে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে আসেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমাদের ভবিষ্যতের রাজনীতি যেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে অগ্রাধিকার দেয়।
এর মানে হচ্ছে:
• শিক্ষায় শহর-গ্রাম বৈষম্য দূর করতে হবে।
• শ্রমবাজারে দরিদ্র তরুণদের প্রবেশাধিকার বাড়াতে হবে।
• রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
• পাহাড়ি, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকার পুনঃনিশ্চিত করতে হবে।
এই দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া আমরা পুরনো খোলসে নতুন রং মেখে সামনে এগোতে পারব না।
আশাবাদের নতুন নকশা
নাহিদ ইসলামের হতাশা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সেই হতাশার মধ্য থেকেও আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সম্ভাবনার রেখা। এই এক বছরে যদি আমরা বুঝে থাকি—শুধু পতন নয়, প্রয়োজন পরিবর্তন; শুধু প্রতিরোধ নয়, প্রয়োজন প্রস্তাব; শুধু প্রত্যাখ্যান নয়, প্রয়োজন পুনর্গঠন—তাহলে এই আন্দোলন ব্যর্থ নয়, বরং নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরির সূচনা।
আন্দোলন শেষ হয়ে যায়নি, তা রূপান্তরিত হয়েছে। একে ধরে রাখতে হলে এখনই দরকার—
• স্বচ্ছ নেতৃত্ব
• নৈতিক স্পষ্টতা
• সহনশীল আলোচনার সংস্কৃতি
• এবং সুনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ রূপরেখা
জুলাই-আগস্ট আমাদের একটি পথে নিয়ে গিয়েছিল। এখন প্রয়োজন সেই পথের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা তৈরি করা। এর জন্য সব পক্ষকে নিয়ে আবার বসতে হবে, খোলামেলা আলোচনা করতে হবে এবং অবশ্যই মনে রাখতে হবে—পরিবর্তন ধীরে আসে, কিন্তু তার ভিত্তি ঠিকভাবে গড়া না হলে, তা ধসে পড়তেও বেশি সময় লাগে না।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।