সমরজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাব
গত দুই বছরে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল তাদের ইতিহাসের তুলনায় অনেক বেশি সামরিক প্রভাব বিস্তার করেছে। তবে এই সাফল্য ভবিষ্যতের জন্য নতুন ঝুঁকিও তৈরি করেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েল হামাসকে চূর্ণ করেছে এবং হিজবুল্লাহকেও দুর্বল করে দিয়েছে, যার ফলে তেহরানের আঞ্চলিক প্রভাব নেটওয়ার্কে বড় ধাক্কা লেগেছে।
মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে ইসরায়েল তাদের চিরশত্রু ইরানের ভয়াবহ ক্ষতি করেছে—যা আকারে ইসরায়েলের ৭৫ গুণ এবং জনসংখ্যায় ৯ গুণ বড়—এবং দীর্ঘদিনের লক্ষ্য পূরণ করে যুক্তরাষ্ট্রকেও সরাসরি যুদ্ধে যুক্ত করেছে।
ইসরায়েলি হামলায় একাধিক শীর্ষ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানী নিহত হয়েছে, তেহরানের বড় অংশের ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডার ধ্বংস হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১২ দিনের যুদ্ধে, যা শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে গিয়ে থেমেছে, ইসরায়েল পুরোপুরি ইরানের আকাশসীমা দখলে রেখেছিল।
এ সব ঘটনাই প্রমাণ করে, মাত্র এক কোটি মানুষের দেশটি এই অঞ্চলে তুলনাহীন সামরিক ও গোয়েন্দা ক্ষমতা অর্জন করেছে।
নতুন নিরাপত্তা নীতি ও সীমান্তের বাইরে অবস্থান
ইসরায়েল এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আগ্রাসী, নতুন নিরাপত্তা নীতির অংশ হিসেবে সিরিয়া ও লেবাননে সামরিক অবস্থান গড়ে তুলেছে। এর ব্যাখ্যায় তারা বলছে, ৭ অক্টোবরের মতো আরেকটি হামলা রুখতে এটা প্রয়োজন।
কিন্তু এই পদক্ষেপ আশপাশের দেশগুলোকে ইসরায়েলের প্রতি সতর্ক করে তুলেছে। একই সঙ্গে গাজায় যুদ্ধ পরিচালনার কারণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসরায়েল ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান হয়তো সময় নিচ্ছে বড় ধরনের প্রতিশোধের জন্য।
ক্ষমতার ভারসাম্য বদল, নৈতিক সমর্থন ক্ষয়
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা নীতি উপ-মন্ত্রী মিশেল ফ্লোর্নয় বলেছেন, হামাস ও হিজবুল্লাহকে দুর্বল করে দিয়ে ইসরায়েল আসলে আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য বদলে দিয়েছে।
তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে গাজায় বেসামরিক হতাহতের বিষয়টি ইসরায়েলের নৈতিক অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সমর্থন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
নেতানিয়াহুর অবস্থান শক্তিশালী হলেও আন্তর্জাতিক চাপ
ইসরায়েলের সামরিক সাফল্য প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করেছে। তিনি দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত এবং হামাস হামলার পর তার জনপ্রিয়তা নেমে গিয়েছিল।
এই সপ্তাহে নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ “বিশ্বের সেরা সামরিক শিক্ষায়” পড়ানো হবে এবং ইসরায়েল “বিশ্বের শীর্ষ শক্তির” কাতারে চলে গেছে।
তবে অধিকাংশ বিশ্লেষক এই মূল্যায়নকে অতিরঞ্জিত মনে করেন।
অবসরপ্রাপ্ত ইসরায়েলি জেনারেল আমোস গিলিয়াদ বলেছেন, “ইসরায়েল আঞ্চলিক সামরিক শক্তি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। তবে এটা কি বিশ্বশক্তি? আমি এভাবে বলতে চাই না। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী মূলত আত্মরক্ষার জন্য তৈরি।”
গাজার যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সমালোচনা
ইসরায়েল বিজয়ী হলেও অনেক দিক থেকে একা হয়ে গেছে। বিশ্বজুড়ে গাজার যুদ্ধ থামানোর দাবি জোরালো হচ্ছে।
৭ অক্টোবরের পর ইসরায়েলি হামলায় বহু হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং খাদ্য সংকট তৈরি হয়েছে, যা আরব বিশ্বসহ যুবসমাজকে ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।
আহত শিশুদের ছবি সারা পৃথিবীতে বিক্ষোভ ও নিন্দার জন্ম দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডার মতো মিত্ররাও সমালোচনা করেছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও জনমত বদলাতে শুরু করেছে। মার্চের এক গ্যালাপ জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৪৬% মার্কিনি ইসরায়েলকে সমর্থন করছেন—যা ২৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এই নীতি চরমপন্থীদের উসকে দিতে পারে এবং সৌদি আরবসহ অন্য আরব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টাকে জটিল করে তুলতে পারে।
অর্থনৈতিক চাপ ও সামাজিক বিভাজন
ইসরায়েলের এই দীর্ঘমেয়াদি লড়াই দেশটির অর্থনীতিকে ক্লান্ত করে তুলেছে। বিনিয়োগ কমেছে, প্রচুর রিজার্ভ সেনা ডাকায় শ্রমবাজারে সংকট তৈরি হয়েছে।
২০২৪ সালে ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় ৬৫% বেড়ে ৪৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এই ব্যয় মেটাতে ঋণ ও বাজেট ঘাটতি বেড়ে গেছে। ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আমির ইয়ারন বুধবার বলেছেন, দেশটির উচিত বেসামরিক ও সামরিক ব্যয় নিয়ে “পুনর্বিবেচনা করা।”
ইরানের পাল্টা হামলার আশঙ্কা
সব মিলিয়ে গাজার যুদ্ধ থেকে আসা বদনাম আর এই বিপুল ব্যয়ের কারণে ইসরায়েলের বিজয়কে মোটেই চূড়ান্ত বলা যাচ্ছে না।
ইরান আপাতত দুর্বল হলেও পাল্টা হামলার ক্ষমতা তাদের রয়েছে। তারা ইরাকের মিলিশিয়া বা ইয়েমেনের হুথি যোদ্ধাদের সঙ্গে কাজ করতে পারে, যারা এরই মধ্যে রেড সি অঞ্চলে জাহাজ চলাচল ব্যাহত করছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আসলে কতটা পিছিয়েছে, তা নিয়েও সন্দেহ আছে। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা ইরান আবারও শুরু করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ট ক্যাম্পবেল বলেছেন, “ইরানেরও একটি মত আছে। তারা কোনো একসময় প্রতিশোধ নিতেই পারে।”