০৮:২৯ অপরাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫
“ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি বেঙ্গালুরুর জেলে আইএস জঙ্গি ও সিরিয়াল ধর্ষকের মোবাইল ব্যবহার ফাঁস, তদন্তে নেমেছে কর্ণাটক সরকার পাকিস্তানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের অভূতপূর্ব পদোন্নতি — এখন দেশের প্রথম ‘চিফ অব ডিফেন্স ফোর্সেস’ বর্তমানের সব জাতীয় সংকটই সরকারের সাজানো নাটক: মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাংলাদেশের সঙ্গে টাকা ও ট্যারিফ বিরোধে আন্তর্জাতিক সালিশিতে আদানি পাওয়ার” ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে আধুনিক প্রশিক্ষণের ওপর জোর নতুন বেতন কমিশন গঠন করবে পরবর্তী সরকার: সালেহউদ্দিন আহমেদ নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর পাঁচ মামলায় জামিন প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবিতে সহানুভূতির আহ্বান জানালেন জামায়াত নেতা মিয়া গোলাম পারওয়ার বর্তমান ইন্টারিম সরকার আমলে আইএমএফ পরবর্তী কিস্তি ঋণ দেবে না

এখনও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’

স্বাধীনতার পর সদ্যোজাত বাংলাদেশের অস্পষ্ট উত্তেজনা ও বিভীষিকা অনেক শিল্পীকে নতুন ভাষা খুঁজে নিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭৬ সালে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ রচনার মাধ্যমে সেই শোক, ক্রোধ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে মঞ্চে তুলে ধরেন। বাংলা নাটকে এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের কাব্যনাট্যের সূচনা, যেখানে কবিতার ছন্দ ও নাটকের তীক্ষ্ণ বাস্তবতা হাত ধরাধরি করেছে।

কাহিনিসংক্ষেপ

সমগ্র নাটকটি এক রাতের গ্রামীণ পরিসরে—মাতবরের বৈঠকখানায়—ঘটে। গ্রামবাসীরা আশ্রয় ও আশ্বাসের খোঁজে মাতবরের কাছে জড়ো হয়; কিন্তু খুব শিগগিরই বোঝা যায়, মাতবর পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী। তার মেয়ে আগের রাতে সেনাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে; লজ্জা ও অসহায়ের কান্নায় সে বিষ খেয়ে মরতে চায়। অবশেষে গ্রামবাসীর ক্ষোভ জ্বলে ওঠে—মাতবর নিহত হন, আর দূর থেকে শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আসার “পায়ের আওয়াজ”। সংকুচিত সময়-পরিসরের ভেতরেই পুরো ১৯৭১-এর ট্র্যাজেডি ও জয়ের পূর্বাভাস কাব্যিক চাপের সঙ্গে গেঁথে দেন হক।

চরিত্রকোরাস ও নাট্যকৌশল

চারটি প্রকাশ্য একক চরিত্র—মাতবর, তার মেয়ে, পীরসাহেব ও পাইক—এর পাশাপাশি গ্রামবাসী ‘কোরাস’ চরিত্র হিসেবে উপস্থিত। গ্রিক নাটকের প্রাচীন রীতি অনুসরণে এই কোরাস কখনও প্রশ্ন করে, কখনও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান দেয়, আবার কখনও গণরোষের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে। এতে মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর গণআন্দোলনের দৈনন্দিন ভয়, আস্থা ও বিস্ফোরিত সাহস একজোট হয়ে মঞ্চে উঠে আসে(।

প্রতীকভাষাশৈলী ও রূপক

১) “পায়ের আওয়াজ”—একই সঙ্গে মুক্তির আগমনী ধ্বনি ও দখলদারদের বুটের শব্দ।
২) মাতবরের চরিত্র—রাজাকার শক্তির প্রতিচ্ছবি, আবার ধর্ষিত কন্যার অসহায় পিতার রূপ।
৩) কাব্যগদ্যের ছন্দ—উদ্দীপ্ত বক্তৃতা ও স্বগতোক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিগত আর সামাজিক হাহাকারকে মিলিয়ে দেয়।
হকের শব্দচয়ন কখনও গ্রামীণ, কখনও শাস্ত্র-ঋদ্ধ; ফলে মুক্তিযুদ্ধের অপরিমেয় কষ্ট ও অক্ষয় প্রত্যয়ের দ্বৈত সুর একসঙ্গে বাজে।

প্রথম মঞ্চায়ন ও নির্দেশনা

২৫ নভেম্বর ১৯৭৬-এ ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘থিয়েটার’ দলের প্রযোজনায় নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন ঘটে। নির্দেশনা দেন আবদুল্লাহ আল-মামুন; দর্শন-সংগীতে ছিলেন কেরামত মওলা, আলম খান প্রমুখ। পোস্টার এঁকেছিলেন নিতুন কুণ্ডু; মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার।

দীর্ঘ মঞ্চযাত্রা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

মঞ্চায়নের এক বর্ষের মাথায় নিয়মিত অভিনয়ে সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁয়ে ফেলে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’; ১৯৮১ সালে সিউলের তৃতীয় বিশ্ব নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পরিবেশনা হিসেবেও অংশ নেয়। ২০১৬-তে নাটকটির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৭৪-তম প্রদর্শনী হয় এবং এতে এখনও ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করে চলেছেন—বাংলাদেশি নাটকের দীর্ঘতম রেপার্টরি হিসেবে এর বিরল কৃতিত্ব স্বীকৃত।

সমালোচনা ও পাঠপ্রতিক্রিয়া

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী হতাশা, দালাল বনাম মুক্তিকামী মানুষের দ্বন্দ্ব, নারী-নিগ্রহের শোক ও গণবিদ্রোহের জাগরণ—সব কটি সূক্ষ্ণ সুর একসঙ্গে বাজাতে পারার জন্য সমালোচকেরা একে “স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি নাটকের বিবেক” আখ্যা দিয়েছেন। আবহসঙ্গীতের গণসঙ্গীতধর্মী ব্যবহার, আলো-আধারির দ্বন্দ্ব ও নিম্নমুখী মঞ্চরূপ বিস্মরণবয়ান তৈরি করে; দর্শকের চোখে মাতবর যখন ভাঙেন, তখন সহমর্মিতার সঙ্গে ঘৃণাও জাগে—এ দ্বৈত অনুভূতি নাটকটির নৈতিক জটিলতাকে আরও ভাস্বর করে তোলে(।

সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

রাজাকার ও দেশদ্রোহী সহযোগীদের বিচার-প্রক্রিয়া, যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রশ্ন আজও তীব্র। গ্রামীণ ক্ষমতার কাঠামোয় লুকিয়ে থাকা সহিংসতার রূপান্তর এখন শহর ও ডিজিটাল পরিসরেও দেখা যায়। সেই কারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কেবল মুক্তিযুদ্ধের দলিল নয়—এখনও নিপীড়কের বিরুদ্ধে সংহতির ডাক।

চার দশকেরও বেশি পেরিয়ে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চে উঠলেই দর্শক আজও শুনতে পান অদৃশ্য পায়ের শব্দ—মুক্তি, প্রতিরোধ আর ন্যায়ের অদৃশ্য পদধ্বনি। সৈয়দ শামসুল হকের এ কাব্যনাট্য শুধু অতীতের নয়, বর্তমানেরও কণ্ঠস্বর; এ নাটকের ধ্বনি থেমে যেতে পারে শুধু তখনই, যখন অন্যায়ের সকল আওয়াজ চিরতরে স্তব্ধ হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

“ওরা করলে, আমরা প্রস্তুত”: পাকিস্তানের পারমাণবিক পরীক্ষা ইস্যুতে রাজনাথ সিংয়ের হুঁশিয়ারি

এখনও ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’

০৫:০০:৩৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ জুলাই ২০২৫

স্বাধীনতার পর সদ্যোজাত বাংলাদেশের অস্পষ্ট উত্তেজনা ও বিভীষিকা অনেক শিল্পীকে নতুন ভাষা খুঁজে নিতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭৬ সালে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ রচনার মাধ্যমে সেই শোক, ক্রোধ ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে মঞ্চে তুলে ধরেন। বাংলা নাটকে এটিই ছিল মুক্তিযুদ্ধের কাব্যনাট্যের সূচনা, যেখানে কবিতার ছন্দ ও নাটকের তীক্ষ্ণ বাস্তবতা হাত ধরাধরি করেছে।

কাহিনিসংক্ষেপ

সমগ্র নাটকটি এক রাতের গ্রামীণ পরিসরে—মাতবরের বৈঠকখানায়—ঘটে। গ্রামবাসীরা আশ্রয় ও আশ্বাসের খোঁজে মাতবরের কাছে জড়ো হয়; কিন্তু খুব শিগগিরই বোঝা যায়, মাতবর পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী। তার মেয়ে আগের রাতে সেনাদের হাতে ধর্ষিত হয়েছে; লজ্জা ও অসহায়ের কান্নায় সে বিষ খেয়ে মরতে চায়। অবশেষে গ্রামবাসীর ক্ষোভ জ্বলে ওঠে—মাতবর নিহত হন, আর দূর থেকে শোনা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের এগিয়ে আসার “পায়ের আওয়াজ”। সংকুচিত সময়-পরিসরের ভেতরেই পুরো ১৯৭১-এর ট্র্যাজেডি ও জয়ের পূর্বাভাস কাব্যিক চাপের সঙ্গে গেঁথে দেন হক।

চরিত্রকোরাস ও নাট্যকৌশল

চারটি প্রকাশ্য একক চরিত্র—মাতবর, তার মেয়ে, পীরসাহেব ও পাইক—এর পাশাপাশি গ্রামবাসী ‘কোরাস’ চরিত্র হিসেবে উপস্থিত। গ্রিক নাটকের প্রাচীন রীতি অনুসরণে এই কোরাস কখনও প্রশ্ন করে, কখনও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান দেয়, আবার কখনও গণরোষের প্রতিমূর্তি হয়ে ওঠে। এতে মুক্তিযুদ্ধের বৃহত্তর গণআন্দোলনের দৈনন্দিন ভয়, আস্থা ও বিস্ফোরিত সাহস একজোট হয়ে মঞ্চে উঠে আসে(।

প্রতীকভাষাশৈলী ও রূপক

১) “পায়ের আওয়াজ”—একই সঙ্গে মুক্তির আগমনী ধ্বনি ও দখলদারদের বুটের শব্দ।
২) মাতবরের চরিত্র—রাজাকার শক্তির প্রতিচ্ছবি, আবার ধর্ষিত কন্যার অসহায় পিতার রূপ।
৩) কাব্যগদ্যের ছন্দ—উদ্দীপ্ত বক্তৃতা ও স্বগতোক্তির মাধ্যমে ব্যক্তিগত আর সামাজিক হাহাকারকে মিলিয়ে দেয়।
হকের শব্দচয়ন কখনও গ্রামীণ, কখনও শাস্ত্র-ঋদ্ধ; ফলে মুক্তিযুদ্ধের অপরিমেয় কষ্ট ও অক্ষয় প্রত্যয়ের দ্বৈত সুর একসঙ্গে বাজে।

প্রথম মঞ্চায়ন ও নির্দেশনা

২৫ নভেম্বর ১৯৭৬-এ ঢাকার মহিলা সমিতি মঞ্চে ‘থিয়েটার’ দলের প্রযোজনায় নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন ঘটে। নির্দেশনা দেন আবদুল্লাহ আল-মামুন; দর্শন-সংগীতে ছিলেন কেরামত মওলা, আলম খান প্রমুখ। পোস্টার এঁকেছিলেন নিতুন কুণ্ডু; মূল ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার।

দীর্ঘ মঞ্চযাত্রা ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

মঞ্চায়নের এক বর্ষের মাথায় নিয়মিত অভিনয়ে সুবর্ণজয়ন্তী ছুঁয়ে ফেলে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’; ১৯৮১ সালে সিউলের তৃতীয় বিশ্ব নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক পরিবেশনা হিসেবেও অংশ নেয়। ২০১৬-তে নাটকটির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৭৪-তম প্রদর্শনী হয় এবং এতে এখনও ফেরদৌসী মজুমদার অভিনয় করে চলেছেন—বাংলাদেশি নাটকের দীর্ঘতম রেপার্টরি হিসেবে এর বিরল কৃতিত্ব স্বীকৃত।

সমালোচনা ও পাঠপ্রতিক্রিয়া

মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী হতাশা, দালাল বনাম মুক্তিকামী মানুষের দ্বন্দ্ব, নারী-নিগ্রহের শোক ও গণবিদ্রোহের জাগরণ—সব কটি সূক্ষ্ণ সুর একসঙ্গে বাজাতে পারার জন্য সমালোচকেরা একে “স্বাধীনতার পর বাংলাদেশি নাটকের বিবেক” আখ্যা দিয়েছেন। আবহসঙ্গীতের গণসঙ্গীতধর্মী ব্যবহার, আলো-আধারির দ্বন্দ্ব ও নিম্নমুখী মঞ্চরূপ বিস্মরণবয়ান তৈরি করে; দর্শকের চোখে মাতবর যখন ভাঙেন, তখন সহমর্মিতার সঙ্গে ঘৃণাও জাগে—এ দ্বৈত অনুভূতি নাটকটির নৈতিক জটিলতাকে আরও ভাস্বর করে তোলে(।

সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

রাজাকার ও দেশদ্রোহী সহযোগীদের বিচার-প্রক্রিয়া, যুদ্ধাপরাধ, ধর্ষণ ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের প্রশ্ন আজও তীব্র। গ্রামীণ ক্ষমতার কাঠামোয় লুকিয়ে থাকা সহিংসতার রূপান্তর এখন শহর ও ডিজিটাল পরিসরেও দেখা যায়। সেই কারণে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ কেবল মুক্তিযুদ্ধের দলিল নয়—এখনও নিপীড়কের বিরুদ্ধে সংহতির ডাক।

চার দশকেরও বেশি পেরিয়ে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ মঞ্চে উঠলেই দর্শক আজও শুনতে পান অদৃশ্য পায়ের শব্দ—মুক্তি, প্রতিরোধ আর ন্যায়ের অদৃশ্য পদধ্বনি। সৈয়দ শামসুল হকের এ কাব্যনাট্য শুধু অতীতের নয়, বর্তমানেরও কণ্ঠস্বর; এ নাটকের ধ্বনি থেমে যেতে পারে শুধু তখনই, যখন অন্যায়ের সকল আওয়াজ চিরতরে স্তব্ধ হবে।