এশিয়ার গেম চেঞ্জার নেতাদের অন্যতম সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান। তাঁর দেশে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী চাইনিজ, তারপরে মালয়েশীয় ও ভারতীয়, এছাড়া অন্যান্যও আছেন।
লি কুয়ানের নেতৃত্বে সিঙ্গাপুরের অগ্রযাত্রা যখন শুরু হয়, সেই সময় দেশের ভেতর ও বাইরের থেকে একটা চাপ বা প্রলোভন ছিল যেন তাঁর দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ চাইনিজদের প্রাধান্যের একটি দেশ হয়।
লি কুয়ান সেদিকে মোটেই মন দেননি। তিনি সবাইকে সিঙ্গাপুরের নাগরিক বা সিঙ্গাপুরিয়ান হিসেবে বেড়ে ওঠার পরিবেশ তৈরি করেন।
এ কাজে তিনি দ্রুত পা ফেলেননি – সময় নিয়েছিলেন, কিন্তু লক্ষ্যে স্থির ছিলেন। আর লক্ষ্যে স্থির থাকা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়েছিল কারণ ভবিষ্যত সম্পর্কে অঙ্ক করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।
যেমন তিনিই প্রথম আশিয়ানে বিভিন্নভাবে বলেন, “প্রথমে নূন্যতম ঐক্য”। ঠিক তেমনি তিনিই প্রথম পৃথিবীতে বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে না, কারণ তারা এক হওয়ার মতো সময় না দিয়ে, নিজেরা এক হবার আগেই অনেক কিছু এক করে ফেলেছে।”
এই যেমন আসিয়ান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে তিনি দূরদর্শীভাবে ভাবতেন – তার চেয়ে নিজ দেশের জন্য তাঁর ভবিষ্যত ভাবনা আরও গভীর ছিল, তাই তিনি কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ তৈরি করেননি। সবার জন্য দেশ তৈরি করেন।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল যে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, সেখানে সবার জন্যই দেশ তৈরির শতভাগ অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু দেশের প্রতিষ্ঠাতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লি কুয়ান হতে পারেননি।
স্বাধীনতার তিন বছর পরেই তিনি সংবিধানের অনুমোদনের বাইরে গিয়ে ইসলামিক দেশগুলোর সম্মেলন (ওআইসি)–এ যোগ দেন পাকিস্তানে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী যোগ না হওয়ার আগে, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ওআইসিতে যোগ দিতে পারত না। বঙ্গবন্ধুর ওই যোগদানের ফলে দেশটি মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ হওয়ার পথে পা বাড়াল। বা আরও বলা যায়, বাংলাদেশের ধারা নিজ অবস্থান থেকে সরে গেল। এজন্য বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানে ওআইসিতে যোগ দিলেন, এবং তারপর পাকিস্তানের নেতা ভুট্টো বাংলাদেশে আসার দিন পাকিস্তানপন্থীরা আওয়ামী লীগের কয়েকটি অফিস পুড়িয়ে দিল। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের একটি অংশ পাকিস্তানের পথে যাত্রা শুরু করল, যার মূল্য হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হলো।
আজকের এই বাংলাদেশের অনেকটা বীজ নিহিত আছে বঙ্গবন্ধুর লি কুয়ান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেটি না হওয়ায়। তাই ভবিষ্যতে যতই স্থিতিশীলতা আসুক, লি কুয়ানের সিঙ্গাপুর এর মতো সবার বাংলাদেশ হওয়া অনেক কঠিন পথ।
অনেকে বলতে পারেন, লি কুয়ান তো ঐ অর্থে গণতান্ত্রিক ছিলেন না। এ একটি দীর্ঘ আলোচনা, তবে এক লাইনে বলতে গেলে – পশ্চিমা গণতন্ত্র এশিয়ায় প্রতিস্থাপন করতে গেলে এশিয়ান সমাজ ও উন্নয়ন দুইটোকেই মাথায় রেখে গণতন্ত্রের সীমারেখা তৈরি করতে হবে।
এক্ষেত্রে লি কুয়ান সবচেয়ে বড় বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছিলেন: আইনের শাসনকে রাষ্ট্র ও সমাজে কার্যকর করা। এশিয়ান গণতন্ত্র কিন্তু বেশিরভাগই ভোটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, আইনের শাসনকে কুক্ষিগত করার দিকে ঝোঁক বেশি। তবে আইনের শাসনের দিকে ঝোঁকটা বেশি রাখছে যে এশীয় দেশগুলো তারা কেমন করছে সেটা ভবিষ্যত বলবে।