১০:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
স্বৈরাচারের কবলে যখনই দেশ, তখনই ফিরে আসে নূরুলদীন সন্ত্রাসবিরোধে দ্বৈত মানদণ্ড নেই: ব্রিকসের দৃঢ় ঘোষণায় পহালগাম হামলার তীব্র নিন্দা হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪১) প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) এর ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে মহামান্য রাষ্ট্রপতি ঢাকায় ৭৩ সালে বস্তিবাসী ছিলো ৮ শতাংশ এখন ৪০ শতাংশ হোলি আর্টিজান হামলায় নিহত ভারতীয় নাগরিক: সন্ত্রাসের আতঙ্ক ও ভারতের গণমাধ্যম লন্ডনের ‘এভিটা’-তে ব্যালকনি ছেড়ে জনতার গানে ডুবে গেলেন র‌্যাচেল জেগলার সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও হয়রানির প্রতিবাদে অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের যৌথ বিবৃতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে কী বলেন তার বংশধররা? জনগণকে বিভক্ত করলেই রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়

মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে কী বলেন তার বংশধররা?

মীর জাফরের ভগ্নপ্রায় প্রাসাদ

মুর্শিদাবাদ শহরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হাজার দুয়ারী আর ইমামবাড়া থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলে রাস্তার পাশেই একটা ভগ্নপ্রায় সিংহদরজা। লাল ইট বেরিয়ে এসেছে, কোথাও ভেঙ্গেও পড়েছে।

সিংহদরজাটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই কেমন যেন গা ছম ছম করে ওঠে – বিশেষ করে একটা পুরনো নীল রঙের বোর্ডে চোখ পড়লে মনে হয় যেন টাইম মেশিনে চেপে পিছিয়ে গিয়েছি ২৬৮ বছর আগে।

যেন দেখতে পাচ্ছি ১৭৫৭ সালের জুলাইয়ের এক বা দুই তারিখে এই সিংহদরজা দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক তরুণ, বিধ্বস্ত বন্দীকে। তার নানা উপাধি। কখনও সম্বোধন করা হয়, বা মাত্রই দিন আটেক আগেও হত, মনসুর-উল-মুলক্, কখনও বা হিবুত জং বলে।

তার পুরো নাম অবশ্য মীর সৈয়দ জাফর আলি খান মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। ছোট করে বললে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

আর যে সিংহদুয়ার দিয়ে বন্দী সিরাজউদ্দৌলাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লোকমুখে আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সেটির নাম ‘নিমকহারাম দেউরি’। কেন এরকম একটা নাম, সেটা আন্দাজ করা কঠিন হবে না যদি জানতে পারেন যে ওই প্রাসাদটি কার।

এটাই জাফরাবাদ প্রাসাদ – মীর জাফরের বাসস্থান।

মীর জাফর (বাঁয়ে), নিমকহারাম দেউরি (ডানে)

‘নিমকহারাম দেউরি’

পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে মীর জাফরের প্রাসাদকে স্থানীয় মানুষ নিমকহারাম দেউরি বলেই ডাকেন।

কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল এই প্রাসাদেই, আবার ভিন্ন মতও আছে। সেই মতটা হল গঙ্গার পশ্চিম তীরে সিরাজের প্রাসাদ – মনসুরগঞ্জ প্রাসাদেই বন্দি সিরাজকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং সেখানেই মীর জাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।

“সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার পরে তার শরীর টুকরো করে ফেলা হয় এবং হাতির পিঠে চাপিয়ে সেই দেহখন্ডগুলি মুর্শিদাবাদ শহরে ঘোরানো হয়েছি। মীর জাফরের বংশধরদের কাছ থেকেই আমি জেনেছি যে এখন যেখানে সরাইখানা এলাকা, সেখানে যখন ওই হাতিটি নিয়ে যায় সিপাহীরা, সেখানকার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।”

”একটা গণরোষ তৈরি হয়েছিল, যার মোকাবেলা করতে সাহস দেখান নি সিপাহীরা। দেহখণ্ড ভরা বস্তাটি তারা একটি কুয়োতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান। সেই থেকেই ওই এলাকাটি সিরজউদ্দৌলা বাজার বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন আর তার কোনও অস্তিত্ব নেই,” বলছিলেন লালবাগ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ফারুক আবদুল্লা।

আবার মীর জাফরের বংশধরদের অনেকে বিশ্বাস করেন পারিবারিক সূ্ত্রে পাওয়া আরেক কাহিনী – মীরণের নির্দেশে নয়, সিরাজকে গুলি করে হত্যা করেছিল দুই ব্রিটিশ সৈনিক।

মি. আবদুল্লার কথায়, “আমি এটাও ওই পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য মানুষদের কাছেই শুনেছি যে সিরাজকে বন্দি করার পরে সম্ভবত মীর জাফর ইংরেজদের চালটা ধরতে পেরেছিলেন এবং তিনিই মীরণকে পাঠিয়েছিলেন যাতে সিরাজ পালিয়ে যেতে পারেন। সেখানে পাহারায় ছিল দুই ব্রিটিশ সিপাহী। তারা এই পরিকল্পনাটা জেনে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে মেরে ফেলে সিরাজউদ্দৌলাকে।”

কেল্লা নিজামতের ঘন্টাঘর

মীর জাফরের বংশধরেরা কোথায়?

মীর জাফরের বংশধরেরা অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন মুর্শিদাবাদ সহ বিশ্বের নানা জায়গাতেই। মীর জাফরদের বংশধরদের এখনও নবাব, ছোটে নবাব বলে ডাকা হয়। লালবাগের কেল্লা নিজামতের ভেতরেও থাকেন ওই বংশের বেশ কয়েকজন।

ছোটে নবাব বলে পরিচিত সৈয়দ মুহাম্মদ রাজা আলি মির্জা বলছিলেন, “আমাদের ফ্যামিলির তিন হাজারের মতো সদস্য আছেন। অনেকে এখানেই থাকেন, কেউ ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা বাইরে চলে গেছেন। তবে তাদের সবার বাড়ি এখানে রয়েছে।”

মি. মির্জা আরও দাবি করছিলেন যে পাকিস্তানের চতুর্থ ও শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার আলি মির্জাও তাদেরই পরিবারের সদস্য এবং মীর জাফরের বংশধর। এই কেল্লা নিজামতেই তার জন্ম, পরে যুক্তরাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন ইস্কান্দার মির্জা।

মীর জাফরের তিন বংশধর : বাঁদিক থেকে – সৈয়দা তারাৎ বেগম, সৈয়দ মুহাম্মদ বাকের আলি মির্জা, ‘ছোটে নবাব’ সৈয়দ মুহাম্মদ রাজা আলি মির্জা

ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের বংশধর মীর জাফর

মীর জাফরের পূর্বপুরুষরা আরব থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়। মীর জাফরের বংশধরেরা দাবি করেন যে তারা ইমাম হাসান ও হোসাইনের উত্তরপুরুষ।

বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থেও মীর জাফরের বংশ পরিচয়ের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে যেমন আছে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের লেখা ‘মসনদ অফ মুর্শিদাবাদ’, তেমনই আছে বাংলায় সমকালীন মুসলমানদের নিয়ে লেখা খন্দকার ফজলে রাব্বির আকর গ্রন্থ ‘হাকিকত মুসলমান-ই-বেঙ্গালাহ’-ও। পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের বইটিতে তাদের বংশতালিকাও পাওয়া যায়।

ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলছিলেন, “মীর জাফর বাংলার মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর বকশী ছিলেন, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে পে মাস্টার জেনারেল বা প্রধান সেনাপতি। তার পরেই ছিলেন রায় দুর্লভরাম সোম। তিনি ছিলেন বিদেশি, আরব বিদেশি – নাজাফ থেকে এসেছিলেন।

“তিনি যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, তখন সাধারণ অশ্বারোহী ছিলেন। তারপরে ধীরে ধীরে তার পদোন্নতি হয় বিশেষ করে আলিবর্দি খাঁয়ের সময়ে। রায় দুর্লভ ছিলেন নিজামত দেওয়ান আর মীর জাফর ছিলেন বকশী। আলিবর্দি খাঁ এদের দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে তারা সিরাজের পক্ষে থাকবে যে কোনও যুদ্ধে,” জানাচ্ছিলেন রজতকান্ত রায়।

মীর জাফরের পরিবারের কবরস্থান

পলাশীর ‘বিশ্বাসঘাতক’

ভারতের, বিশেষ করে বাঙালীদের একটা বড় অংশ জেনে এসেছেন যে মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের জন্যই পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। তবে মীর জাফরের বংশধরেরা সেকথা বিশ্বাস করেন না।

তারই বংশধর, সৈয়দ মুহাম্মদ বাকের আলি মির্জার কথায়, “যুদ্ধটা হল কিসের জন্য – কে নির্দেশ দিয়েছিল! মীর জাফর ভাবলেন যে আমি প্রধান সেনাপতি, কিন্তু যুদ্ধের নির্দেশটা কে দিল!

“ট্রেচারি বলা হয় – কী ট্রেচারি করেছিলেন তিনি? যুদ্ধ হচ্ছে কিন্তু তিনি ভাগ নিলেন না – সেইজন্যই উনাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়। যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার জন্য যদি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়, সেটা তো মানা যায় না। আজ পর্যন্ত তো কেউ প্রমাণ করতে পারল না যে উনি গদ্দারি করেছেন,” বলছিলেন মীর জাফরের এই বংশধর।

এই দাবি যেমন অনেক ইতিহাসবিদ মানেন না, তেমনই সাধারণ মানুষের বড় অংশই মীর জাফরকে এখনও বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে করেন আর তা নিয়ে গত ২৬৮ বছর ধরেই নানা বিদ্রূপ শুনতে হয় তার বংশধরদের।

সৈয়দা তারাৎ বেগম, মীর জাফরের অষ্টম প্রজন্মের বংশধর সৈয়দা তারাৎ বেগম বলছিলেন, “মীর জাফরকে নিয়ে ইংরেজরা তো খেলা করল – একটা গোটা বংশকে নিয়ে খেলা করল। দেশের মানুষ সেটা বুঝতে না পেরে মীর জাফরকে একটা শিখণ্ডী খাড়া করে উনাকে বিশ্বাসঘাতক করে দিল।”

তার প্রশ্ন, “এখন কেন নতুন ভাবে আপনারা জানতে চাইছেন – যদি ট্রেইটার হয়ে থাকে, তাহলে ট্রেইটার। এখনও পর্যন্ত এই পরিবারের খারাপ কোনও কাজ হলে লোকে বলে মীর জাফরের বংশধর আর ভাল কিছু করলে বলে এটা মুর্শিদাবাদের লোক।”

মীর জাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়ে থাকে তিনি ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে, তবে সেই ব্রিটিশ বনিকরা কিন্তু তাকেও সরিয়ে দিয়েছিল মসনদে বসার বছর তিনেকের মধ্যেই।

তার জামাই মীর কাশিমকে নবাব বানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যদিও তিন বছর পরে আবারও মীর জাফরকে ফিরিয়ে আনা হয় বাংলার মসনদে।

জীবনের শেষ দিন – ১৭৬৫ সালের পাঁচই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মীর জাফরই ছিলেন বাংলার নবাব। প্রাসাদের সামনেই তাদের পারিবারিক কবরস্থানে শায়িত আছেন মীর জাফর।

বিবিসি নিউজ বাংলা

স্বৈরাচারের কবলে যখনই দেশ, তখনই ফিরে আসে নূরুলদীন

মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে কী বলেন তার বংশধররা?

০৭:১৭:২৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫

মুর্শিদাবাদ শহরের জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র হাজার দুয়ারী আর ইমামবাড়া থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলে রাস্তার পাশেই একটা ভগ্নপ্রায় সিংহদরজা। লাল ইট বেরিয়ে এসেছে, কোথাও ভেঙ্গেও পড়েছে।

সিংহদরজাটা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই কেমন যেন গা ছম ছম করে ওঠে – বিশেষ করে একটা পুরনো নীল রঙের বোর্ডে চোখ পড়লে মনে হয় যেন টাইম মেশিনে চেপে পিছিয়ে গিয়েছি ২৬৮ বছর আগে।

যেন দেখতে পাচ্ছি ১৭৫৭ সালের জুলাইয়ের এক বা দুই তারিখে এই সিংহদরজা দিয়ে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এক তরুণ, বিধ্বস্ত বন্দীকে। তার নানা উপাধি। কখনও সম্বোধন করা হয়, বা মাত্রই দিন আটেক আগেও হত, মনসুর-উল-মুলক্, কখনও বা হিবুত জং বলে।

তার পুরো নাম অবশ্য মীর সৈয়দ জাফর আলি খান মির্জা মুহাম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। ছোট করে বললে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা।

আর যে সিংহদুয়ার দিয়ে বন্দী সিরাজউদ্দৌলাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, লোকমুখে আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে সেটির নাম ‘নিমকহারাম দেউরি’। কেন এরকম একটা নাম, সেটা আন্দাজ করা কঠিন হবে না যদি জানতে পারেন যে ওই প্রাসাদটি কার।

এটাই জাফরাবাদ প্রাসাদ – মীর জাফরের বাসস্থান।

মীর জাফর (বাঁয়ে), নিমকহারাম দেউরি (ডানে)

‘নিমকহারাম দেউরি’

পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে মীর জাফরের প্রাসাদকে স্থানীয় মানুষ নিমকহারাম দেউরি বলেই ডাকেন।

কিছু ইতিহাসবিদ মনে করেন সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল এই প্রাসাদেই, আবার ভিন্ন মতও আছে। সেই মতটা হল গঙ্গার পশ্চিম তীরে সিরাজের প্রাসাদ – মনসুরগঞ্জ প্রাসাদেই বন্দি সিরাজকে নিয়ে আসা হয়েছিল এবং সেখানেই মীর জাফরের পুত্র মীরণের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয়।

“সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার পরে তার শরীর টুকরো করে ফেলা হয় এবং হাতির পিঠে চাপিয়ে সেই দেহখন্ডগুলি মুর্শিদাবাদ শহরে ঘোরানো হয়েছি। মীর জাফরের বংশধরদের কাছ থেকেই আমি জেনেছি যে এখন যেখানে সরাইখানা এলাকা, সেখানে যখন ওই হাতিটি নিয়ে যায় সিপাহীরা, সেখানকার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।”

”একটা গণরোষ তৈরি হয়েছিল, যার মোকাবেলা করতে সাহস দেখান নি সিপাহীরা। দেহখণ্ড ভরা বস্তাটি তারা একটি কুয়োতে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যান। সেই থেকেই ওই এলাকাটি সিরজউদ্দৌলা বাজার বলে পরিচিত ছিল। কিন্তু এখন আর তার কোনও অস্তিত্ব নেই,” বলছিলেন লালবাগ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক ফারুক আবদুল্লা।

আবার মীর জাফরের বংশধরদের অনেকে বিশ্বাস করেন পারিবারিক সূ্ত্রে পাওয়া আরেক কাহিনী – মীরণের নির্দেশে নয়, সিরাজকে গুলি করে হত্যা করেছিল দুই ব্রিটিশ সৈনিক।

মি. আবদুল্লার কথায়, “আমি এটাও ওই পরিবারের বয়োজেষ্ঠ্য মানুষদের কাছেই শুনেছি যে সিরাজকে বন্দি করার পরে সম্ভবত মীর জাফর ইংরেজদের চালটা ধরতে পেরেছিলেন এবং তিনিই মীরণকে পাঠিয়েছিলেন যাতে সিরাজ পালিয়ে যেতে পারেন। সেখানে পাহারায় ছিল দুই ব্রিটিশ সিপাহী। তারা এই পরিকল্পনাটা জেনে ফেলে এবং সঙ্গে সঙ্গেই গুলি করে মেরে ফেলে সিরাজউদ্দৌলাকে।”

কেল্লা নিজামতের ঘন্টাঘর

মীর জাফরের বংশধরেরা কোথায়?

মীর জাফরের বংশধরেরা অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন মুর্শিদাবাদ সহ বিশ্বের নানা জায়গাতেই। মীর জাফরদের বংশধরদের এখনও নবাব, ছোটে নবাব বলে ডাকা হয়। লালবাগের কেল্লা নিজামতের ভেতরেও থাকেন ওই বংশের বেশ কয়েকজন।

ছোটে নবাব বলে পরিচিত সৈয়দ মুহাম্মদ রাজা আলি মির্জা বলছিলেন, “আমাদের ফ্যামিলির তিন হাজারের মতো সদস্য আছেন। অনেকে এখানেই থাকেন, কেউ ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা বাইরে চলে গেছেন। তবে তাদের সবার বাড়ি এখানে রয়েছে।”

মি. মির্জা আরও দাবি করছিলেন যে পাকিস্তানের চতুর্থ ও শেষ গভর্নর জেনারেল এবং প্রথম প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার আলি মির্জাও তাদেরই পরিবারের সদস্য এবং মীর জাফরের বংশধর। এই কেল্লা নিজামতেই তার জন্ম, পরে যুক্তরাজ্যে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে যোগ দিয়েছিলেন ইস্কান্দার মির্জা।

মীর জাফরের তিন বংশধর : বাঁদিক থেকে – সৈয়দা তারাৎ বেগম, সৈয়দ মুহাম্মদ বাকের আলি মির্জা, ‘ছোটে নবাব’ সৈয়দ মুহাম্মদ রাজা আলি মির্জা

ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনের বংশধর মীর জাফর

মীর জাফরের পূর্বপুরুষরা আরব থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়। মীর জাফরের বংশধরেরা দাবি করেন যে তারা ইমাম হাসান ও হোসাইনের উত্তরপুরুষ।

বেশ কয়েকটি প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থেও মীর জাফরের বংশ পরিচয়ের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে যেমন আছে ১৯০৫ সালে প্রকাশিত পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের লেখা ‘মসনদ অফ মুর্শিদাবাদ’, তেমনই আছে বাংলায় সমকালীন মুসলমানদের নিয়ে লেখা খন্দকার ফজলে রাব্বির আকর গ্রন্থ ‘হাকিকত মুসলমান-ই-বেঙ্গালাহ’-ও। পূর্ণচন্দ্র মজুমদারের বইটিতে তাদের বংশতালিকাও পাওয়া যায়।

ইতিহাসবিদ রজতকান্ত রায় বলছিলেন, “মীর জাফর বাংলার মুঘল অশ্বারোহী বাহিনীর বকশী ছিলেন, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে পে মাস্টার জেনারেল বা প্রধান সেনাপতি। তার পরেই ছিলেন রায় দুর্লভরাম সোম। তিনি ছিলেন বিদেশি, আরব বিদেশি – নাজাফ থেকে এসেছিলেন।

“তিনি যখন সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, তখন সাধারণ অশ্বারোহী ছিলেন। তারপরে ধীরে ধীরে তার পদোন্নতি হয় বিশেষ করে আলিবর্দি খাঁয়ের সময়ে। রায় দুর্লভ ছিলেন নিজামত দেওয়ান আর মীর জাফর ছিলেন বকশী। আলিবর্দি খাঁ এদের দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে তারা সিরাজের পক্ষে থাকবে যে কোনও যুদ্ধে,” জানাচ্ছিলেন রজতকান্ত রায়।

মীর জাফরের পরিবারের কবরস্থান

পলাশীর ‘বিশ্বাসঘাতক’

ভারতের, বিশেষ করে বাঙালীদের একটা বড় অংশ জেনে এসেছেন যে মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের জন্যই পলাশীর যুদ্ধে ক্লাইভের বাহিনীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। তবে মীর জাফরের বংশধরেরা সেকথা বিশ্বাস করেন না।

তারই বংশধর, সৈয়দ মুহাম্মদ বাকের আলি মির্জার কথায়, “যুদ্ধটা হল কিসের জন্য – কে নির্দেশ দিয়েছিল! মীর জাফর ভাবলেন যে আমি প্রধান সেনাপতি, কিন্তু যুদ্ধের নির্দেশটা কে দিল!

“ট্রেচারি বলা হয় – কী ট্রেচারি করেছিলেন তিনি? যুদ্ধ হচ্ছে কিন্তু তিনি ভাগ নিলেন না – সেইজন্যই উনাকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়। যুদ্ধে অংশ না নেওয়ার জন্য যদি বিশ্বাসঘাতক হয়ে যায়, সেটা তো মানা যায় না। আজ পর্যন্ত তো কেউ প্রমাণ করতে পারল না যে উনি গদ্দারি করেছেন,” বলছিলেন মীর জাফরের এই বংশধর।

এই দাবি যেমন অনেক ইতিহাসবিদ মানেন না, তেমনই সাধারণ মানুষের বড় অংশই মীর জাফরকে এখনও বিশ্বাসঘাতক বলেই মনে করেন আর তা নিয়ে গত ২৬৮ বছর ধরেই নানা বিদ্রূপ শুনতে হয় তার বংশধরদের।

সৈয়দা তারাৎ বেগম, মীর জাফরের অষ্টম প্রজন্মের বংশধর সৈয়দা তারাৎ বেগম বলছিলেন, “মীর জাফরকে নিয়ে ইংরেজরা তো খেলা করল – একটা গোটা বংশকে নিয়ে খেলা করল। দেশের মানুষ সেটা বুঝতে না পেরে মীর জাফরকে একটা শিখণ্ডী খাড়া করে উনাকে বিশ্বাসঘাতক করে দিল।”

তার প্রশ্ন, “এখন কেন নতুন ভাবে আপনারা জানতে চাইছেন – যদি ট্রেইটার হয়ে থাকে, তাহলে ট্রেইটার। এখনও পর্যন্ত এই পরিবারের খারাপ কোনও কাজ হলে লোকে বলে মীর জাফরের বংশধর আর ভাল কিছু করলে বলে এটা মুর্শিদাবাদের লোক।”

মীর জাফরকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়ে থাকে তিনি ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিলেন বলে, তবে সেই ব্রিটিশ বনিকরা কিন্তু তাকেও সরিয়ে দিয়েছিল মসনদে বসার বছর তিনেকের মধ্যেই।

তার জামাই মীর কাশিমকে নবাব বানায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, যদিও তিন বছর পরে আবারও মীর জাফরকে ফিরিয়ে আনা হয় বাংলার মসনদে।

জীবনের শেষ দিন – ১৭৬৫ সালের পাঁচই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মীর জাফরই ছিলেন বাংলার নবাব। প্রাসাদের সামনেই তাদের পারিবারিক কবরস্থানে শায়িত আছেন মীর জাফর।

বিবিসি নিউজ বাংলা