ফরিদা পারভীন বাংলাদেশের লালনগীতি চর্চার অন্যতম উজ্জ্বল নাম। অসাধারণ কণ্ঠ ও বাউল-দর্শনসম্পন্ন গায়কির জন্য তাঁকে ‘লালনগানের রানি’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যায়। তবে এই যাত্রা সহজে শুরু হয়নি। শৈশব থেকেই তিনি সঙ্গীতের সংস্পর্শে বড় হয়েছেন, পরিবারে ছিল গানের রেওয়াজ। তাঁর জীবনগাথা বাংলাদেশের লোকগানের ঐতিহ্যের এক অনন্য দলিল।
শৈশবে গান শেখা এবং পরিবারের প্রভাব
ফরিদা পারভীনের জন্ম নাটোর জেলায় হলেও বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়—লালনের আখড়ার পরিধিতে। পরিবারেরও সংগীতের চর্চা ছিল স্বাভাবিক অঙ্গ, ছোটবেলা থেকেই পরিবারের উৎসাহে গান শেখা শুরু করেন। তাঁর বাবা সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন এবং মেয়ে গায়িকা হিসেবে বেড়ে উঠুক—এটাই তিনি চেয়েছিলেন। পরিবারের অন্য সদস্যরাও নিয়মিত অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। পারিবারিক অনুষ্ঠানে গানগাওয়া ছিল ফরিদার প্রথম মঞ্চ।
প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও গুরুদের কাছ থেকে তালিম
পারিবারিক পরিবেশ ছাড়াও ফরিদা পারভীন আনুষ্ঠানিকভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিক্ষা নিয়েছেন। প্রথম গুরু ছিলেন উদয় ভট্টাচার্য, যিনি তাঁকে শুদ্ধ স্বর ও রাগ-রাগিণীর প্রাথমিক পাঠ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার খ্যাতনামা সঙ্গীতজ্ঞ সঞ্জীব দে-এর কাছে দীর্ঘসময় তালিম নিয়েছেন। লালনগীতি শেখার ক্ষেত্রে ফকির লালন শাহের আখড়ার গুরুদের সান্নিধ্য বিশেষত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, যা তাঁকে বাউল-গানের আধ্যাত্মিক দিক গভীরভাবে অনুধাবনের সুযোগ দিয়েছে।
পারিবারিক সঙ্গীত পরম্পরা ও অনুপ্রেরণা
ফরিদা পারভীনের পরিবার সাংস্কৃতিকভাবে সুসংগঠিত ছিল। পারিবারিক অনুষ্ঠানে ও উৎসবে গানগাওয়া সবসময় রেওয়াজ ছিল। বাবা-মা দুজনেই চেয়েছিলেন মেয়ে একজন শিল্পী হিসেবে সমুজ্জ্বল হোক। পরিবারের সহায়ক পরিবেশ ও শিক্ষকের শৃঙ্খলিত পাঠ—উভয়েই মিলিয়ে তাঁকে একজন প্রতিভাবান শিল্পীতে পরিণত করেছে।
কিশোরী বয়সে গান শেখার ইতিহাস
কিশোরী বয়সেই ফরিদা নজরুলগীতি ও আধুনিক গান শিখেছিলেন। তবে কুষ্টিয়ার আখড়ার প্রতি গভীর টান তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বাউলগানের জগতে নিয়ে গেছে। বাউলদের জীবনদর্শন, আখড়ার পরিবেশ ও লালনের দর্শন তাঁকে আকৃষ্ট করেছে এবং তা তাঁর জীবনের মূল দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দেশে ও বিদেশে কনসার্ট
বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া সহ প্রায় সব বড় শহরে লালনগীতি পরিবেশন করেছেন ফরিদা পারভীন। বিশেষ করে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আয়োজিত লালন উৎসবে নিয়মিত অংশগ্রহণ করেন। বিদেশেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ভারতসহ বহু দেশে তিনি লালনগীতি গেয়ে সারা বিশ্বের দর্শককে মুগ্ধ করেছেন।
বিটিভিতে আসার গল্প
ফরিদা পারভীনের টেলিভিশন যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) নজরুলগীতি ও লোকগানের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। শুরুর দিকে বিটিভির জন্য নজরুলগীতি গাইতেন তিনি। পরবর্তীতে লালনগীতি নিয়ে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব আসে, যেখানে লালনের গান পরিবেশন করে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৭০, ’৮০ ও ’৯০-এর দশকে বিটিভিতে তাঁর গাওয়া লালনগীতি অনুষ্ঠানটি দেশজুড়ে মানুষের মনে বিশেষ জায়গা করে নেয়।
ফরিদা পারভীন একজন কণ্ঠশিল্পীর অতীতে সীমাবদ্ধ নন—বাংলার বাউলদর্শনের জীবন্ত বাহক। পারিবারিক সঙ্গীত পরিচর্যা থেকে গুরুদের কঠিন তালিম, দেশের মানুষের অকুণ্ঠ ভালোবাসা এবং বিদেশের মঞ্চ জয়—সব মিলিয়ে তাঁর জীবন এক অনন্য শিল্পীর জীবনী। তাঁর কণ্ঠে বাউলগান শোনার মানেই এক গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা।