বাংলাদেশের অর্থনীতি এক দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে। এই দুষ্টচক্র তৈরি করেছে স্থায়ী মুল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থান সংকোচন, স্থবির মজুরি এবং নাজুক বেসকরারি বিনিয়োগ পরিস্থিতি মিলে। যা অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতি মাঝারি মাত্রার মন্দায় প্রবেশ করেছে।
আবার নিম্ন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ স্থায়ী মুল্যস্ফীতি মিলে তৈরি করেছে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিক প্রবৃদ্ধি গত বছরের ৪.২ শতাংশ থেকে কমে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে অন্যতম নিম্নস্তর।
বিপরীতে ২০২২ সালের মে মাস থেকে মুল্যস্পীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। ওই মাসে মুল্যস্ফীতি বেড়ে দাড়ায় ৭.৪২ শতাংশ। সেই থেকে গত প্রায় তিন বছর ধরে দেশে উচ্চ মুল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। দুই অংকের কোটা পেরিয়ে যদিও মুল্যস্ফীত এক অংকে নেমে এসেছে। কিন্তু প্রায় বছর ধরেই এটি নয় শতাংশের ঘরে অবস্থান করছে। মুল্যস্ফীতি উচ্চ স্তরে অবস্থানের মুল কারণ হচ্ছে জ্বালানি তেল ও মার্কিন ডলার ও খাদ্য পন্যের উচ্চ মুল্য।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্ন গতি এবং মূল্যস্ফীতির উচ্চ একক অংকে আটকে থাকার প্রেক্ষাপটে দেশের অর্থনীতি এমন এক দুঃসহ অবস্থায় পৌছেছে, অর্থনীতির ভাষায় যাকে ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলা হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্ট্যাগনেন্ট অবস্থা এবং উচ্চ ইনফ্লেশন মিলে এই স্ট্যাগফ্লেশন তৈরি করেছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি মাঝারি মানের মন্দার পাশাপাশি মাঝারি মানের স্ট্যাগফ্লেশনে পড়েছে। এতে মানুষের প্রকৃত আয় ক্ষয়ে যাচ্ছে, কর্মসংস্থান দুর্বল হচ্ছে এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাও হুমকির মুখে পড়ছে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ এখনো পূর্ণাঙ্গ মন্দায় না পড়লেও মাঝারি মাত্রার মন্দায় পড়েছে। আর স্ট্যাগফ্লেশন দেশের অর্থনীতিকে পূর্ণাঙ্গ মন্দার দিকে ধাবিত করছে।
স্ট্যাগফ্লেশনের সময় উচ্চ বেকারত্ব ও চাহিদার অভাব থাকা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি বাড়তি থাকে, অন্যদিকে মন্দার সময় চাহিদার অভাবের কারণে মূল্যস্ফীতি সাধারণত কমে আসে।
অন্তর্বতী সরকার মুল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সংকোচন মুলক মুদ্রানীতি গ্রহণ কেরছে। এতে বাজারে মুদ্রা সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে গেছে। বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থায় চলে এসেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে এই ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ইতিহাসের সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ২৯ শতাংশে। করোনার কঠিন সময়েও এ হার সাড়ে ৭ শতাংশের নিচে নামেনি।
অর্থাৎ অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, চরম সংকোচন মুলক অবস্থায়ও দেশের মুল্যস্ফীতি উচ্চস্তরেই আটকে আছে। যেন অর্থনীতির কোন সুত্রই এখানে কাজ করছে না। এতে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য কার্যক্রমে গভীর মন্দার সংকেত স্পষ্ট হয়েছে।
টেক্সটবুক স্ট্যাগফ্লেশন, অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি-উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে তুলনামূলকভাবে বিরল ঘটনা বলে মনে করছেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। তিনি বলছেন, বাংলাদেশের মতো দেশে স্ট্যাগফ্লেশন দেখা দেয় তখনই, যখন প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদি ধারার তুলনায় অনেক নিচে নেমে যায়, কিন্তু মূল্যস্ফীতি উচ্চই রয়ে যায়। সেই সংজ্ঞা অনুযায়ী, গত তিন থেকে চার বছর ধরে বাংলাদেশে স্ট্যাগফ্লেশনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাড়ে তিন থেকে চার শতাংশের মধ্যে নেমে এলেও মূল্যস্ফীতি এখনো উচ্চ এক অংকে আটকে আছে। এর পেছনে কাজ করছে প্রধানত মুদ্রার বিনিময় হার অবমূল্যায়ন এবং অব্যাহত খাদ্য মূল্যস্ফীতি।
ধীরগতির বেসরকারি বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে সীমিত করে ফেলছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির প্রায় ২৩-২৪ শতাংশে থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা আরও কমে ২২.৫ শতাংশে নেমেছে, যা উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার অনেক নিচে। অথচ বাংলাদেশের জন্য নূ্যূনতম বিনিয়োগ হার হওয়া উচিত জিডিপির প্রায় ৩০ শতাংশ। উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হতে হলে তা ৩৫ শতাংশের কাছাকাছি নিতে হবে। আর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পণা অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে হলে আগামী এক দশকজুড়ে ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে।
দেশের অর্থনীতর ওপর প্রায় তিন বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চাপ বজায় আছে। এই চাপ প্রথমে কোভিড মহামারির সময় সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের কারণে শুরু হয়। এরপর বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক অভিঘাত ও দেশের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার ফলে এটাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
আবার মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্ক থেকে কমে ৮.২৯ শতাংশে নেমে এলেও, মজুরি বাড়ার গতি প্রায় স্থবির থাকায় মানুষের প্রকৃত আয় ও ক্রয়সক্ষমতা কমে যাচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন মনে করছেন, ২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অর্থনীতিতে এটি আরেকটি ধাক্কা দিয়েছে। রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক বা বাহ্যিক-যেকোনো ধরনের অস্থিরতারই নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, স্থায়ী মূল্যস্ফীতি, দুর্বল বেসরকারি বিনিয়োগ এবং বাড়তে থাকা বৈষম্যের সমাধান না হলে বাংলাদেশ একটি ‘নিম্নমাত্রার অর্থনৈতিক সমতায়’ আটকে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
জাহিদ হোসেন মনে করেন, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য হলে-একা সেটিও যথেষ্ট নয়। সামষ্টিক স্থিতিশীলতার তিনটি মূল স্তম্ভ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈদেশিক ভারসাম্য রক্ষা এবং আর্থিক খাতের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার।
তবে অর্থনৈতিক ফলাফল শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পরিবেশের ওপরই নির্ভরশীল এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভেরিয়েবলগুলো “রাজনীতির মাটিতেই জন্মায়”। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এলেও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো আপনা-আপনি দূর হবে না। অনেকে মনে করছে, আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর হয়তো রাজনীতিতে এক ধরণের স্থিতিশীলতা চলে আসবে। আবার অনেকে মনে করছেন, শুধু নির্বাচন হলেই রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টাবে না। সেখানেও এক ধরণের অনিশ্চয়তা আছে। তবে সেই অনিশ্চয়তা বাদ দিলেও, অর্থনীতির সংকট এমনি এমনি কেটে যাবে না। এজন্য আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ না করে দেশের বাস্তব অবস্থা অনুধাবন করে বড় ধরণের উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক।
- আকিব রহমান 


















