১১:৫৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫
বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও কেন চীনের রেয়ার আর্থ আধিপত্য অটুট জৈবজ্বালানি বিধিমালা ও ভূরাজনৈতিক ঝাঁকুনিতে পাম ওয়েল বাজার কৃষকের স্ত্রীর পরিচয়ের ঊর্ধ্বে: লিঙ্গভিত্তিক পরিসর উন্মোচন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে ব্যর্থতার অভিযোগ, আলোচকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন হিউএনচাঙ (পর্ব-১৪২) ট্রাম্পের শুল্ক চিঠি এশিয়াকে ১ আগস্টের মধ্যে চুক্তি করতে চাপ দিচ্ছে ট্রাম্পের নতুন শুল্কে এশীয় মুদ্রার অবনতি, শেয়ারবাজারে মৃদু পরিবর্তন সেনাপ্রধানের সাথে তুরস্কের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ এর মান্যবর সেক্রেটারি’র সৌজন্য সাক্ষাৎ হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ সংবিধানের কয়েকটি ধারা অবৈধ ঘোষণা ফেনী নদী: দুই শতাব্দীর ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য

ফেনী নদী: দুই শতাব্দীর ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য

ফেনী নদীবাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তঘেঁষা এক প্রাচীন জলধারাপ্রায় দুই শত বছর ধরে শুধু ভৌগোলিক নয়সাংস্কৃতিকঅর্থনৈতিক ও সাহিত্যিক পরিচয়েরও প্রতীক। এর দুই তীরের জনপদে গড়ে উঠেছে কৃষিব্যবসানৌযোগাযোগসীমান্ত বাণিজ্য এবং লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র রূপ।

নদীর জন্ম ও গতিপথ
ফেনী নদীর উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা। সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেনী জেলা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। নদীর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তৃত অঞ্চলে। দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার হলেও এ স্বল্প দৈর্ঘ্যের নদী বহু প্রজন্মের জীবিকার মূল ভিত্তি।

দুই তীরের সভ্যতা ও জনপদ
ফেনী নদীর দুই তীরে গত দুই শত বছরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক জনপদ। উর্বর পলিমাটি ধানপাটসরিষাশাক-সবজি ও নানা ফলমূলের চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান যুগ পর্যন্ত এ অঞ্চলের বাজারগুলো ছিল স্থানীয় ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।
ফেনীর দুই তীরের গ্রামে মিশ্র সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্টনদী একদিকে সীমানা’, অন্যদিকে সংযোগ’; ভারতীয় ত্রিপুরার সঙ্গে বাঙালিদের চলাচলবিয়েশাদিমেলা-উৎসব সবই নদীপথে সম্পন্ন হতো।

নদীর জঙ্গল ও জীববৈচিত্র্য
এক সময় নদীর দুপাশে ছিল ঘন বনাঞ্চলবাঁশবেতশালগর্জনকড়ইসহ নানা কাঠের গাছ জন্মাত। তীরবর্তী গ্রামবাসীরা বনের কাঠফল ও ওষধি উদ্ভিদ দ্বারা জীবন-জীবিকা গড়ে তুলতো।
পানিতে ছিল মাছের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারদেশীয় শিংমাগুরটেংরাকৈপুঁটিরুইকাতলা ও বোয়াল। জালে-মৌজে মাছ শিকার হাজারো জেলের আশ্রয় ছিল। স্রোতধারার পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু প্রজাতি হারিয়ে গেলেও নদীখাল ও বিলগুলোতে এখনো কিছুই বেঁচে আছে।

বাণিজ্য ও নৌযোগাযোগ
উনিশ শতাব্দী ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ফেনী নদী ছিল পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। নৌকা ও বজরা চালানো হতো ধানপাটমাছনুনবালি ও কাঠসবই যেত নদীবন্দর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী বন্দরে।
পাকিস্তান আমলে নদীপথ বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারত-বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-ভারতের) মধ্যে  চালগুড়কাপড়মশলাতামাকের ব্যবসা বৈধ ও অবৈধ দুই ধাপে পরিচালিত হতো।
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে নদীপথ বাণিজ্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীমতবে ধীরে ধীরে সড়ক ও রেলপথ বাণিজ্য দখল করে নেয়। নদীর শুকানোচর পড়াঅবৈধ দখল ও দূষণ নদীর স্বাস্থ্য বিনষ্ট করেছে।

শহর ও বন্দরসংযোগ
ফেনী নদী ফেনী শহরকে সোনাগাজীপরশুরামফুলগাজী প্রভৃতি উপজেলার সঙ্গে জুড়েছে। খাল-উপখাল দিয়ে নৌকা চলাচল করে নোয়াখালীলক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের বাজার ও বন্দরে পণ্য পরিবহন করেছে।

পাকিস্তান যুগে নদী ও বাণিজ্য
পাকিস্তান আমলে নদীর তীরে ছিল কাস্টমস পোস্টবৈধ আমদানি-রফতানির পাশাপাশি ছোট নৌকায় সীমান্ত বাণিজ্যও চালু ছিল। গুড়পাট ও চাল রফতানি হতোআসত কাপড়মশলামাটি ও কাঁচামালত্রিপুরার সঙ্গে এই বাণিজ্য অঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ ছিল।

বাংলাদেশ যুগে নদীর ব্যবহার
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে সীমান্ত বাণিজ্যে নদীর গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে সড়ক-রেল বাণিজ্য নদীপথের স্থান দখল করেছে। নদীর নাব্যতা সংকুচিতদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছেচর পদদৃশ্য বদলেছে।

নদী ও সংস্কৃতি
ফেনী নদী লোকসংস্কৃতিরও অঙ্গ। নদীর স্রোত নিয়ে গেয়েছেন মঙ্গলগানপালাগান ও বাউল-ফকিররা:
ও ফেনীর নদীর পানি রে ভাই,
আমার মন নাহি মানে রে…

সাহিত্য ও ফেনী নদী
ফেনী নদী বহু কবি-লেখকের সৃষ্টি উপজীব্যগ্রামজীবনজেলেদের কষ্ট-দুঃখসীমান্তের জীবিকা। অমৃতলাল বাগচীসহ অনেকে ফেনী নদীর তীরে’ নাম নিয়ে কবিতা ও গল্পসংকলন প্রকাশ করেছেন।

নদীর সংকট ও ভবিষ্যৎ
নদী আজ অবরুদ্ধদূষিত ও দখলে ক্ষতিগ্রস্ত। দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে ২০১৫ সালে চুক্তি হয়েছেতবে বাস্তবে নাব্যতা কমে গেছে। স্থানীয় জনগণ দাবি করছে পুনরুজ্জীবননাব্যতা ফিরিয়ে নৌযান ও মাছের সম্পদ উদ্ধার।

ফেনী নদী দুই শত বছরের ইতিহাসসভ্যতাবাণিজ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। দুদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সাংস্কৃতির সেতুবন্ধন হিসেবে এর গুরুত্ব আজও অপরিসীম। নদী শুকিয়েওফেনীর গল্প থেমে যায়নি।

বিশ্বব্যাপী প্রতিক্রিয়ার মধ্যেও কেন চীনের রেয়ার আর্থ আধিপত্য অটুট

ফেনী নদী: দুই শতাব্দীর ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য

০৭:০০:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৮ জুলাই ২০২৫

ফেনী নদীবাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তঘেঁষা এক প্রাচীন জলধারাপ্রায় দুই শত বছর ধরে শুধু ভৌগোলিক নয়সাংস্কৃতিকঅর্থনৈতিক ও সাহিত্যিক পরিচয়েরও প্রতীক। এর দুই তীরের জনপদে গড়ে উঠেছে কৃষিব্যবসানৌযোগাযোগসীমান্ত বাণিজ্য এবং লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র রূপ।

নদীর জন্ম ও গতিপথ
ফেনী নদীর উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা। সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেনী জেলা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। নদীর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তৃত অঞ্চলে। দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার হলেও এ স্বল্প দৈর্ঘ্যের নদী বহু প্রজন্মের জীবিকার মূল ভিত্তি।

দুই তীরের সভ্যতা ও জনপদ
ফেনী নদীর দুই তীরে গত দুই শত বছরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক জনপদ। উর্বর পলিমাটি ধানপাটসরিষাশাক-সবজি ও নানা ফলমূলের চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান যুগ পর্যন্ত এ অঞ্চলের বাজারগুলো ছিল স্থানীয় ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।
ফেনীর দুই তীরের গ্রামে মিশ্র সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্টনদী একদিকে সীমানা’, অন্যদিকে সংযোগ’; ভারতীয় ত্রিপুরার সঙ্গে বাঙালিদের চলাচলবিয়েশাদিমেলা-উৎসব সবই নদীপথে সম্পন্ন হতো।

নদীর জঙ্গল ও জীববৈচিত্র্য
এক সময় নদীর দুপাশে ছিল ঘন বনাঞ্চলবাঁশবেতশালগর্জনকড়ইসহ নানা কাঠের গাছ জন্মাত। তীরবর্তী গ্রামবাসীরা বনের কাঠফল ও ওষধি উদ্ভিদ দ্বারা জীবন-জীবিকা গড়ে তুলতো।
পানিতে ছিল মাছের সমৃদ্ধ ভাণ্ডারদেশীয় শিংমাগুরটেংরাকৈপুঁটিরুইকাতলা ও বোয়াল। জালে-মৌজে মাছ শিকার হাজারো জেলের আশ্রয় ছিল। স্রোতধারার পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু প্রজাতি হারিয়ে গেলেও নদীখাল ও বিলগুলোতে এখনো কিছুই বেঁচে আছে।

বাণিজ্য ও নৌযোগাযোগ
উনিশ শতাব্দী ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ফেনী নদী ছিল পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। নৌকা ও বজরা চালানো হতো ধানপাটমাছনুনবালি ও কাঠসবই যেত নদীবন্দর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী বন্দরে।
পাকিস্তান আমলে নদীপথ বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারত-বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-ভারতের) মধ্যে  চালগুড়কাপড়মশলাতামাকের ব্যবসা বৈধ ও অবৈধ দুই ধাপে পরিচালিত হতো।
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে নদীপথ বাণিজ্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীমতবে ধীরে ধীরে সড়ক ও রেলপথ বাণিজ্য দখল করে নেয়। নদীর শুকানোচর পড়াঅবৈধ দখল ও দূষণ নদীর স্বাস্থ্য বিনষ্ট করেছে।

শহর ও বন্দরসংযোগ
ফেনী নদী ফেনী শহরকে সোনাগাজীপরশুরামফুলগাজী প্রভৃতি উপজেলার সঙ্গে জুড়েছে। খাল-উপখাল দিয়ে নৌকা চলাচল করে নোয়াখালীলক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের বাজার ও বন্দরে পণ্য পরিবহন করেছে।

পাকিস্তান যুগে নদী ও বাণিজ্য
পাকিস্তান আমলে নদীর তীরে ছিল কাস্টমস পোস্টবৈধ আমদানি-রফতানির পাশাপাশি ছোট নৌকায় সীমান্ত বাণিজ্যও চালু ছিল। গুড়পাট ও চাল রফতানি হতোআসত কাপড়মশলামাটি ও কাঁচামালত্রিপুরার সঙ্গে এই বাণিজ্য অঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ ছিল।

বাংলাদেশ যুগে নদীর ব্যবহার
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে সীমান্ত বাণিজ্যে নদীর গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে সড়ক-রেল বাণিজ্য নদীপথের স্থান দখল করেছে। নদীর নাব্যতা সংকুচিতদূষণ বৃদ্ধি পেয়েছেচর পদদৃশ্য বদলেছে।

নদী ও সংস্কৃতি
ফেনী নদী লোকসংস্কৃতিরও অঙ্গ। নদীর স্রোত নিয়ে গেয়েছেন মঙ্গলগানপালাগান ও বাউল-ফকিররা:
ও ফেনীর নদীর পানি রে ভাই,
আমার মন নাহি মানে রে…

সাহিত্য ও ফেনী নদী
ফেনী নদী বহু কবি-লেখকের সৃষ্টি উপজীব্যগ্রামজীবনজেলেদের কষ্ট-দুঃখসীমান্তের জীবিকা। অমৃতলাল বাগচীসহ অনেকে ফেনী নদীর তীরে’ নাম নিয়ে কবিতা ও গল্পসংকলন প্রকাশ করেছেন।

নদীর সংকট ও ভবিষ্যৎ
নদী আজ অবরুদ্ধদূষিত ও দখলে ক্ষতিগ্রস্ত। দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে ২০১৫ সালে চুক্তি হয়েছেতবে বাস্তবে নাব্যতা কমে গেছে। স্থানীয় জনগণ দাবি করছে পুনরুজ্জীবননাব্যতা ফিরিয়ে নৌযান ও মাছের সম্পদ উদ্ধার।

ফেনী নদী দুই শত বছরের ইতিহাসসভ্যতাবাণিজ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। দুদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সাংস্কৃতির সেতুবন্ধন হিসেবে এর গুরুত্ব আজও অপরিসীম। নদী শুকিয়েওফেনীর গল্প থেমে যায়নি।