ফেনী নদী—বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তঘেঁষা এক প্রাচীন জলধারা—প্রায় দুই শত বছর ধরে শুধু ভৌগোলিক নয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সাহিত্যিক পরিচয়েরও প্রতীক। এর দুই তীরের জনপদে গড়ে উঠেছে কৃষি, ব্যবসা, নৌযোগাযোগ, সীমান্ত বাণিজ্য এবং লোকসংস্কৃতির স্বতন্ত্র রূপ।
নদীর জন্ম ও গতিপথ
ফেনী নদীর উৎস ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি এলাকা। সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে ফেনী জেলা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়। নদীর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বিভাগের বিস্তৃত অঞ্চলে। দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ কিলোমিটার হলেও এ স্বল্প দৈর্ঘ্যের নদী বহু প্রজন্মের জীবিকার মূল ভিত্তি।
দুই তীরের সভ্যতা ও জনপদ
ফেনী নদীর দুই তীরে গত দুই শত বছরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ কৃষিভিত্তিক জনপদ। উর্বর পলিমাটি ধান, পাট, সরিষা, শাক-সবজি ও নানা ফলমূলের চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান যুগ পর্যন্ত এ অঞ্চলের বাজারগুলো ছিল স্থানীয় ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র।
ফেনীর দুই তীরের গ্রামে মিশ্র সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট—নদী একদিকে ‘সীমানা’, অন্যদিকে ‘সংযোগ’; ভারতীয় ত্রিপুরার সঙ্গে বাঙালিদের চলাচল, বিয়েশাদি, মেলা-উৎসব সবই নদীপথে সম্পন্ন হতো।
নদীর জঙ্গল ও জীববৈচিত্র্য
এক সময় নদীর দুপাশে ছিল ঘন বনাঞ্চল; বাঁশ, বেত, শাল, গর্জন, কড়ইসহ নানা কাঠের গাছ জন্মাত। তীরবর্তী গ্রামবাসীরা বনের কাঠ, ফল ও ওষধি উদ্ভিদ দ্বারা জীবন-জীবিকা গড়ে তুলতো।
পানিতে ছিল মাছের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার—দেশীয় শিং, মাগুর, টেংরা, কৈ, পুঁটি, রুই, কাতলা ও বোয়াল। জালে-মৌজে মাছ শিকার হাজারো জেলের আশ্রয় ছিল। স্রোতধারার পরিবর্তনের সঙ্গে কিছু প্রজাতি হারিয়ে গেলেও নদী, খাল ও বিলগুলোতে এখনো কিছুই বেঁচে আছে।
বাণিজ্য ও নৌযোগাযোগ
উনিশ শতাব্দী ও বিশ শতকের প্রথমার্ধে ফেনী নদী ছিল পণ্য পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম। নৌকা ও বজরা চালানো হতো ধান, পাট, মাছ, নুন, বালি ও কাঠ—সবই যেত নদীবন্দর চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী বন্দরে।
পাকিস্তান আমলে নদীপথ বাণিজ্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। সীমান্ত পেরিয়ে ভারত-বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান-ভারতের) মধ্যে চাল, গুড়, কাপড়, মশলা, তামাকের ব্যবসা বৈধ ও অবৈধ দুই ধাপে পরিচালিত হতো।
স্বাধীনতার পর প্রথম দশকে নদীপথ বাণিজ্যের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম, তবে ধীরে ধীরে সড়ক ও রেলপথ বাণিজ্য দখল করে নেয়। নদীর শুকানো, চর পড়া, অবৈধ দখল ও দূষণ নদীর স্বাস্থ্য বিনষ্ট করেছে।
শহর ও বন্দরসংযোগ
ফেনী নদী ফেনী শহরকে সোনাগাজী, পরশুরাম, ফুলগাজী প্রভৃতি উপজেলার সঙ্গে জুড়েছে। খাল-উপখাল দিয়ে নৌকা চলাচল করে নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ও চট্টগ্রামের বাজার ও বন্দরে পণ্য পরিবহন করেছে।
পাকিস্তান যুগে নদী ও বাণিজ্য
পাকিস্তান আমলে নদীর তীরে ছিল কাস্টমস পোস্ট; বৈধ আমদানি-রফতানির পাশাপাশি ছোট নৌকায় সীমান্ত বাণিজ্যও চালু ছিল। গুড়, পাট ও চাল রফতানি হতো, আসত কাপড়, মশলা, মাটি ও কাঁচামাল—ত্রিপুরার সঙ্গে এই বাণিজ্য অঞ্চলের অর্থনীতির প্রাণ ছিল।
বাংলাদেশ যুগে নদীর ব্যবহার
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দুই দশকে সীমান্ত বাণিজ্যে নদীর গুরুত্ব থাকলেও বর্তমানে সড়ক-রেল বাণিজ্য নদীপথের স্থান দখল করেছে। নদীর নাব্যতা সংকুচিত, দূষণ বৃদ্ধি পেয়েছে, চর পদদৃশ্য বদলেছে।
নদী ও সংস্কৃতি
ফেনী নদী লোকসংস্কৃতিরও অঙ্গ। নদীর স্রোত নিয়ে গেয়েছেন মঙ্গলগান, পালাগান ও বাউল-ফকিররা:
“ও ফেনীর নদীর পানি রে ভাই,
আমার মন নাহি মানে রে…”
সাহিত্য ও ফেনী নদী
ফেনী নদী বহু কবি-লেখকের সৃষ্টি উপজীব্য—গ্রামজীবন, জেলেদের কষ্ট-দুঃখ, সীমান্তের জীবিকা। অমৃতলাল বাগচীসহ অনেকে ‘ফেনী নদীর তীরে’ নাম নিয়ে কবিতা ও গল্পসংকলন প্রকাশ করেছেন।
নদীর সংকট ও ভবিষ্যৎ
নদী আজ অবরুদ্ধ, দূষিত ও দখলে ক্ষতিগ্রস্ত। দুই দেশের মধ্যে পানি বণ্টন নিয়ে ২০১৫ সালে চুক্তি হয়েছে, তবে বাস্তবে নাব্যতা কমে গেছে। স্থানীয় জনগণ দাবি করছে পুনরুজ্জীবন—নাব্যতা ফিরিয়ে নৌযান ও মাছের সম্পদ উদ্ধার।
ফেনী নদী দুই শত বছরের ইতিহাস, সভ্যতা, বাণিজ্য ও সাহিত্য-সংস্কৃতির এক জীবন্ত দলিল। দু’দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সাংস্কৃতির সেতুবন্ধন হিসেবে এর গুরুত্ব আজও অপরিসীম। নদী শুকিয়েও, ফেনীর গল্প থেমে যায়নি।