বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ সুরমা নদী শুধু একটি নদী নয়—এটি দুই শত বছরেরও বেশি সময় ধরে সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীববৈচিত্র্যের ধারক ও বাহক। সুরমা নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে সিলেট অঞ্চলের বিস্তৃত জনপদ, ব্যবসা-বাণিজ্যের রুট, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং দুই দেশের মধ্যে রপ্তানি-আমদানির গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ।
সুরমা নদীর উৎপত্তি ও গতিপথের ইতিহাস
সুরমা নদীর উৎস ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারাক নদীতে। সেখান থেকে এটি বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট অঞ্চলের ভেতর দিয়ে বয়ে চলে। সুরমা-বারাক নদী ব্যবস্থা দুই শত বছরের বেশি সময় ধরে আসাম ও সিলেটের মধ্যে প্রাকৃতিক সংযোগ হিসেবে কাজ করেছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকে পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের আমল পর্যন্ত এ নদী সংযোগ রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও শহরের সাথে।
দুই তীরের জনপদ ও সভ্যতা
সুরমা নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক জনপদ—বিশেষ করে সিলেট শহর, জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, বিয়ানীবাজারসহ অসংখ্য গ্রামীণ জনপদ। নদীর পানি কৃষিকে উর্বর করেছে, ফলে দুই তীরে সবুজ ধানক্ষেত, সবজি ক্ষেত এবং বাগান বিস্তৃত। ব্রিটিশ আমলেই এই নদীপথ ব্যবহার করে চা, চাল, তুলা, কাঁচা পাট ও কাঠ পাঠানো হতো চট্টগ্রাম ও কলকাতায়। পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেও নদীপথে পণ্যপরিবহন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী সংলগ্ন হাটবাজার ও নদীবন্দরগুলো এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক চালিকা শক্তি হয়ে ওঠে।
নদী ও ব্যবসা-বাণিজ্য
সুরমা নদীর মাধ্যমে ঔপনিবেশিক যুগে চা, কাঠ, পাটসহ বহু কৃষি পণ্য নৌকায় ও স্টিমারে পরিবহন করা হতো। সিলেটের চা-বাগানের উৎপাদিত চা প্রথমে সুরমা নদীপথে আনা হতো সিলেট শহরে, সেখান থেকে বড় নৌযানে চট্টগ্রাম বন্দরে রপ্তানির জন্য পাঠানো হতো। পাকিস্তান আমলেও সুরমা নদীর বন্দরগুলো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের বৈধ-অবৈধ ব্যবসার গুরুত্বপূর্ণ রুট ছিল। এ নদীর তীরবর্তী সীমান্ত বাজারগুলো আজও বৈদেশিক পণ্য ও স্থানীয় কৃষিপণ্যের কেনাবেচায় গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তান ও বাংলাদেশের আমলে বন্দর ও নগর সংযোগ
পাকিস্তান আমলে সুরমা নদীর মাধ্যমে সিলেটের সাথে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামের নদীবন্দরগুলোর সংযোগ ছিল সরাসরি। নদীর জলযান ছিল সস্তা ও সহজলভ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা। স্বাধীনতার পরও সুরমা নদীর গুরুত্ব কমেনি। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্থল বন্দর খোলার আগে অনেক বৈদেশিক পণ্য আমদানি-রপ্তানি সীমান্ত নদীপথ দিয়ে হতো। বিশেষ করে জকিগঞ্জ সীমান্তে নদী হয়ে ওঠে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার।
বনজ ও জলজ সম্পদ
সুরমা নদীর দুই তীরে একসময় বিস্তৃত বনভূমি ছিল। নলখাগড়া, বাঁশ, শালগাছ, নিমগাছ প্রভৃতির প্রাকৃতিক বন নদী অঞ্চলে ছায়া দিত। নদীতে প্রচুর দেশীয় মাছ পাওয়া যেত—রুই, কাতলা, বোয়াল, শিং, মাগুর, পাবদা, কৈসহ নানা রকম মাছের প্রাচুর্য ছিল। বিশেষ করে বন্যা মৌসুমে নদী-উপনদীতে মিঠা পানির মাছের প্রজনন হতো। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রধান আমিষের উৎস ছিল এই নদীর মাছ।
সুরমা নদী ও সংস্কৃতি
সুরমা নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনে নদী শুধু অর্থনীতির নয়, সংস্কৃতিরও অংশ। সিলেটের বাউলগান, পল্লীগীতি, মরমী গান—সবখানেই সুরমার উল্লেখ আছে। হাছন রাজা, রাধারমন দত্তের গানে সুরমা নদীর ছবি আঁকা আছে। উদাহরণ হিসেবে হাছন রাজার একটি বিখ্যাত পঙ্ক্তি:
“সুরমা নদীর তীর বান্ধিয়া ঘর কইরে ভাই
ভাঙিয়া যায় গাঙের পানি, রে ভাই”
এ গান শুধু নদীর ভাঙন নয়, জীবনের অনিশ্চয়তারও রূপক। রাধারমন দত্তও নদী ও প্রকৃতিকে নিয়ে বহু গান রচনা করেছেন। সুরমা নদীর পাড়ে জন্মেছে নানা লোকগল্প, প্রবাদ, কথকতা।
সাহিত্য ও লোকসংস্কৃতি
সিলেটি সাহিত্য, কবিতা, গল্পে সুরমা নদী বারবার ফিরে আসে। স্থানীয় কবি ও লেখকরা নদীর রূপ, রুদ্রভাব, বন্যা ও ভাঙনকে উপজীব্য করেছেন। সিলেটি নাটক ও যাত্রাপালায় নদীর উপমা, নদীর পারের প্রেমকথা, নদীপথের ডাকাতি—সবই উঠে এসেছে। স্থানীয় ভাষায় রচিত সাহিত্য নদীর সাথে এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
দুই শত বছরের ইতিহাসে সুরমা নদীর গুরুত্ব পরিবর্তিত হলেও এখনো এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর দূষণ, ভরাট, অবৈধ দখল এবং পানি প্রবাহের হ্রাস আজ বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও কৃষি সেচ, নৌপথ, মাছের চাষ, বালু খনন ও সীমান্ত বাণিজ্যে নদী এখনও অপরিহার্য।
সুরমা নদী কেবল পানি বইয়ে নিয়ে যায় না, এটি বহন করে ইতিহাস, মানুষের জীবিকা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, গান-কবিতা এবং দু’শো বছরেরও বেশি সময়ের এক বৈচিত্র্যময় সভ্যতার গল্প। নদীর তীরবর্তী মানুষের জীবনে যেমন আনন্দ, তেমনি শোকেরও সঙ্গী সুরমা। এই নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা সভ্যতা, বনজ-জলজ সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি আমাদের উত্তরাধিকার—যা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।