“Dollar is King”—এই ঘোষণা সম্প্রতি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুল্ক যুদ্ধের নতুন ধাপের সূচনা করে দেওয়া এই ঘোষণার পর থেকেই বৈশ্বিক অর্থনীতি কাঁপছে। এশিয়ার বহু দেশের মুদ্রা মার্কিন ডলারের বিপরীতে দ্রুত মূল্য হারাচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ডলারের দিকে ঝুঁকছেন।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা: কেন ভয় পাচ্ছে বিশ্ব
ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, বিদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক চাপিয়ে স্থানীয় উৎপাদন রক্ষা করা হবে। তবে এর অর্থ হচ্ছে—চীনা, ভারতীয়, দক্ষিণ কোরিয়ান, ভিয়েতনামি, এমনকি বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।
বিশ্ববাণিজ্যে এভাবে শুল্ক বেড়ে গেলে জটিলতা বাড়ে—যোগান শৃঙ্খল ভাঙে, দাম বাড়ে, এবং বৈশ্বিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীরা তখন ঝুঁকিপূর্ণ মুদ্রা ছেড়ে ডলারে দিকে ঝুঁকে পড়ে।
“Dollar is King” কেন?
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণার পর বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন—বিশ্বের অর্থনীতি ধীরে ধীরে বাণিজ্যযুদ্ধে ঢুকছে। এই অনিশ্চয়তায় ডলার সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ডলারের চাহিদা বেড়ে গেলে ডলার আরও শক্তিশালী হয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বা খাদ্যপণ্য কেনা হয় ডলারে—ডলার শক্তিশালী হলে সেই সব পণ্য অন্যান্য দেশের জন্য আরও ব্যয়বহুল হয়ে যায়।
এশিয়ার মুদ্রার ওপর তাৎক্ষণিক প্রভাব
জাপানি ইয়েন: বহু বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছেছে।
দক্ষিণ কোরিয়ান ওয়ন: একদিনেই ১ শতাংশের বেশি পড়ে গেছে।
ভারতীয় রুপি: নতুন রেকর্ড সর্বনিম্নে গেছে।
চীনা ইউয়ান: চীন সরকার হস্তক্ষেপ করেও পতন থামাতে পারছে না।
এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রিজার্ভ খরচ করে ডলার বাজারে ছেড়ে নিজেদের মুদ্রা রক্ষা করার চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশের টাকার বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় রিজার্ভ ক্রমেই কমে আসছে। জুন শেষে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমেছে আনুমানিক ১৯–২০ বিলিয়ন ডলারে, যা কয়েক বছর আগের ৪৮ বিলিয়নের বেশি রিজার্ভের চেয়ে অনেক কম।
বর্তমানে ইন্টারব্যাংক রেটে ডলার প্রায় ১১৬ টাকা। খোলা বাজার বা হুন্ডি রেটে এটি ১১৯–১২০ টাকাও ছুঁয়েছে।
টাকার ওপর শুল্ক যুদ্ধের পরোক্ষ আঘাত
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি সরাসরি বাংলাদেশের পণ্যের ওপর না হলেও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে:
চীনা রপ্তানিতে ধাক্কা লাগলে কাঁচামালের দাম, সরবরাহ শৃঙ্খল বিঘ্নিত হবে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য কমলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের চাহিদাও কমতে পারে।
বাংলাদেশ যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স পায় (মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া), সেসব দেশের অর্থনীতিও ডলারের দামে চাপে পড়বে—ফলাফল রেমিট্যান্স প্রবাহ শ্লথ হওয়ার ঝুঁকি।
জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যশস্য—সবই ডলারে কেনা হয়। ডলার যত শক্তিশালী হবে, তত বেশি টাকায় কিনতে হবে।
আগস্টের পর টাকার মান নিয়ে শঙ্কা
আগস্টের পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা চাহিদা আরও বাড়বে:
শিক্ষার্থীদের বিদেশে ফি পরিশোধের মৌসুম।
কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি চাহিদা বেড়ে যায়।
হজ/ওমরাহ মৌসুমে ডলারের চাহিদা বাড়ে।
জ্বালানির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে যদি বেড়ে যায়, সেটিও বাড়তি চাপ তৈরি করবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যদি রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি কমিয়ে দেয় বা বাজারকে আরও বেশি “ফ্লোট” করে, তাহলে আগস্টের পর টাকার মান ১২০–১২২ টাকার মধ্যে চলে যেতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন দুই রকম চাপে:
রিজার্ভ রক্ষা করতে হলে ডলার বিক্রি কমাতে হবে।
আবার টাকার মান ধরে রাখতে হলে রিজার্ভ খরচ করে ডলার বাজারে ছাড়তে হবে।
এ ছাড়া, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী রিজার্ভের স্বচ্ছতা বজায় রাখা, বড় বৈদেশিক ঋণ শোধ করা এবং বৈদেশিক বাণিজ্যে স্থিতিশীলতা আনাও জরুরি।
মুদ্রাস্ফীতি ও মানুষের জীবনে প্রভাব
ডলারের দাম বাড়লে দেশের ভোক্তা বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়বে:
আমদানি পণ্য যেমন ভোজ্যতেল, গম, চাল, চিনির দাম বাড়বে।
জ্বালানি (তেল, এলপি গ্যাস) দাম বাড়বে, যা পরিবহন ও বিদ্যুৎ খরচ বাড়িয়ে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি বাড়াবে।
কাঁচামাল আমদানি ব্যয়বহুল হলে শিল্প উৎপাদন খরচ বাড়বে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় বাড়বে—ডলারে ধার নিলেও শোধ করতে আরও বেশি টাকা লাগবে।
শিল্প ও রপ্তানিতে চাপ
তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রতিযোগিতা হারাতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর মুদ্রা আরও বেশি অবমূল্যায়িত হলে বাংলাদেশের পণ্য তুলনায় দামি হয়ে যাবে।
ঋণের সুদ বাড়তে পারে, যা ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করবে।
ব্যাংকগুলোতে ডলারের তারল্য সংকট থাকলে এলসি খোলা কঠিন হয়ে যাবে।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করণীয়
১. রেমিট্যান্স উৎসাহিত করতে হুন্ডি বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা, বৈধ চ্যানেলে প্রণোদনা আরও বাড়ানো।
২. রপ্তানি আয়ে বৈদেশিক মুদ্রা দ্রুত দেশে আনার নীতি সহজ করা।
৩. আমদানি খরচ কমাতে বিলাসী বা অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করা।
৪. অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করে বিদেশি ঋণ, বাণিজ্য সুবিধা ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করা।
৫. সুদের হার নীতি ও মুদ্রানীতি সমন্বিত করে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো।
৬. মধ্যমেয়াদি রিজার্ভ পুনর্গঠন পরিকল্পনা করা।
ট্রাম্পের শুল্ক ঘোষণা বিশ্ববাণিজ্যকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। “Dollar is King” কথার বাস্তবতা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন। আগস্টের পর বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে যে চাহিদা তৈরি হবে, তার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন।
অন্যথায় টাকার মানের অবমূল্যায়ন আরও বৃদ্ধি পাবে, যা মূল্যস্ফীতি, আমদানি ব্যয়, ঋণ শোধ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের জন্য এটাই সময় বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের।