বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য ও সমাজগবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর-বি সম্প্রতি একটি বিশদ গবেষণা প্রকাশ করেছে, যা ঢাকার নগরায়ণ ও সামাজিক পরিবর্তনের দিকগুলি স্পষ্ট করে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করলেও এখন সে সংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এ পরিবর্তন শুধু সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়; এটি ঢাকার সমাজ, সংস্কৃতি, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
পরিস্থিতির পরিবর্তনের ইতিহাস
১৯৭০-এর দশকে ঢাকা ছিল মাঝারি আকারের শহর, যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের বসবাস ছিল প্রাধান্য। গ্রাম থেকে অভিবাসন থাকলেও বস্তি সংখ্যা সীমিত ছিল এবং নগর পরিকল্পনাও মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী জনসংখ্যা বৃদ্ধি, গ্রামীণ দারিদ্র্য, কৃষির স্থবিরতা ও অসম ভৌগোলিক উন্নয়ন ঢাকায় অভিবাসন বাড়িয়েছে। সীমিত আবাসন ব্যবস্থাপনা এই চাপ নিস্তার দিতে না পেয়ে একের পর এক বস্তি গড়ে উঠেছে।
গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
আইসিডিডিআর-বি’র তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার বস্তিবাসীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে এবং বস্তিগুলো আরও ঘনবসতিপূর্ণ, অনিয়ন্ত্রিত ও সংকটময় হয়ে উঠেছে:
- অধিকাংশ বস্তিতে স্বাস্থ্যসম্মত পানি ও পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।
- শিক্ষার হার খুবই নিম্ন।
- শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেশি।
- অপরাধের হার তুলনামূলকভাবে উঁচু।
এসব বৈশিষ্ট্য ঢাকার অভ্যন্তরীণ সামাজিক ভারসাম্যকে দুর্বল করছে।
মধ্যবিত্তের বিদেশগামী প্রবণতা
ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের নতুন প্রজন্ম উন্নত শিক্ষা ও চাকরির সুযোগ খুঁজে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে যাচ্ছেন। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার অভাবে অনেকেই স্থায়ীভাবে প্রবাসে অবস্থিত হচ্ছেন। ফলে রাজধানীর শিক্ষিত, সংস্কৃতিমনা ও রুচিসম্পন্ন মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে।
মধ্যবিত্তের ভূমিকা ও শূন্যতা
বিশ্বের বড় শহরগুলোতে মধ্যবিত্তই শহরের রুচিশীল সংস্কৃতি ও সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখে। বইপড়া, শিল্পচর্চা, থিয়েটার, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত, নীতিবোধ ও নাগরিক আচরণ—এসবের মান নির্ভর করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর। তারা সামাজিক প্রতিষ্ঠান গঠন করে, আইনশৃঙ্খলা মেনে চলে এবং নাগরিক সেবা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু ঢাকায় যখন এই শ্রেণি সংকুচিত হচ্ছে, তখন সংস্কৃতিক পরিসরও সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
বস্তির সংস্কৃতির প্রভাব
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, বস্তি জীবন কঠিন ও রুক্ষ; দারিদ্র্য ও বঞ্চনা তাদের প্রতিদিনের সুর। অপর্যাপ্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা তাদের জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করে। অপরাধ, মাদক, দালালি, গোষ্ঠীগত সহিংসতা ও অবৈধ জমি দখল—এসব ঝুঁকি প্রবল। তারা প্রথাগত “সফিস্টিকেটেড” সংস্কৃতির বাইরে থেকে যায়, যা ঢাকার অভ্যন্তরীণ সাংস্কৃতিক বিভাজন ক্রমশ তীব্র করে তুলছে।
রাজধানীর রাজনীতিতে বস্তির প্রভাব
যখন কোনো শহরের ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে বাস করে, তখন এটি শুধু আবাসনের সমস্যা নয়, একটি বড় রাজনৈতিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। বস্তি ভোটব্যাংক হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক দলগুলো সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে চায়। দালালচক্র, সন্ত্রাসী ও অপরাধী গোষ্ঠীও বস্তি এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায়। এর ফলে নগর নীতিমালা ও সেবা বণ্টন দুর্বল হয়ে পড়ে, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা কমে এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়।
সম্ভাব্য সামাজিক বিপর্যয়
গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, এভাবে চলতে থাকলে রাজধানী ‘দুটি শহর’ খাঁড়ায় বিভক্ত হয়ে যাবে—একদিকে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত এলাকা, অন্যদিকে বিশাল বস্তি-নির্ভর অঞ্চল। সামাজিক সমন্বয়ের অভাব, বৈষম্য ও ক্ষোভের সঞ্চয় দাঙ্গা-সহিংসতা ও অপরাধের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেবে এবং নগর পরিকল্পনাকে অকার্যকর করে তুলবে। এমন অবস্থায় পুরো রাষ্ট্রকেই অস্থিতিশীল হওয়ার উচ্চ সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক বলেন,
“যদি রাজধানীর ৪০ শতাংশ মানুষ বস্তিতে থাকে এবং মধ্যবিত্ত স্থায়ীভাবে সংকুচিত হয়, তবে শহর কার্যত দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবে। আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির মান সবই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফলে ঢাকা আধুনিক হওয়ার পরও বিভক্ত, সহিংস ও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।”
সমাধানের প্রস্তাব
গবেষণায় কয়েকটি সমাধানমূলক সুপারিশ দেয়া হয়েছে:
সাশ্রয়ী ও পরিকল্পিত আবাসন প্রকল্প গ্রহণ।
বস্তি পুনর্বাসন ও উন্নয়ন কর্মসূচি শুরু।
বস্তিবাসীর জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি।
মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
নগর পরিকল্পনায় সামাজিক অন্তর্ভুক্তি বাধ্যতামূলক করা।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দায়িত্বশীল নীতিনির্ধারণ।
ঢাকা শুধুমাত্র দেশের রাজধানী নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রশাসন ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। ঢাকার সামাজিক কাঠামো যদি ভগ্নাঙ্গুরী হয়, তবে রাষ্ট্রও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আইসিডিডিআর-বি’র গবেষণা কোন অজুহাত নয়, বরং নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা: এখনই পরিকল্পিত নগরায়ণ, বস্তি উন্নয়ন ও মধ্যবিত্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে, নাহলে ঢাকার—এবং বাংলাদেশের—ভবিষ্যৎ বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।