০২:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
পাকিস্তানের নির্দেশেই শেখ হাসিনার রায়: শুভেন্দু মাগুরার মহম্মদপুরে গ্রামীণ ব্যাংক শাখায় অগ্নিসংযোগ গেম অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫: বড় সিক্যুয়েল আর সাহসী ইন্ডি গেমে ঠাসা মনোনয়নের তালিকা ম্যাচা জ্বরের আড়ালে সংকট: ভাইরাল সবুজ চায়ের ট্রেন্ডে টানাপোড়েন সরবরাহে শেষ সপ্তাহে ঢুকল বেলেমের কপ৩০, অর্থসহায়তা আর জ্বালানি ইস্যুতে গভীর অচলাবস্থা জাপানে নিজস্ব জেনারেটিভ এআই গড়ছে সাকানা: ১৩৫ মিলিয়ন ডলারের নতুন তহবিল মঙ্গলগ্রহের নিচে একসময় পানি প্রবাহিত হতো: নতুন গবেষণায় জীবনের সম্ভাবনায় বড় ইঙ্গিত আবু ধাবিতে টালাবাত অ্যাপে ড্রোনে খাবার ডেলিভারি শুরু বিবিসি কি ব্রিটেনে টিকে থাকতে পারবে? শেখ হাসিনার বিচার ‘গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ’—হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কড়া অভিযোগ

নবান্ন: বাংলার নতুন ফসলের গন্ধভরা উৎসব এখন স্মৃতির পাতায়

এক ফসল উৎসবের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া

বাংলার কৃষিজ সংস্কৃতির প্রাণ ছিল নবান্ন—নতুন ধানের গন্ধে ঘেরা সেই উৎসব, যেখানে ঘরে ঘরে রান্না হতো নয়া চালের ভাত, পিঠা, পায়েস। একসময় গ্রামের মানুষ অপেক্ষায় থাকত এই দিনে; জমির ধারের সোনালি ধান, উঠোনজুড়ে পোলাওর গন্ধ, আর প্রতিবেশী-আত্মীয়দের দাওয়াত যেন ছিল এক সামাজিক আনন্দের মহড়া।
কিন্তু আজ সেই দৃশ্য বাংলাদেশের বহু গ্রামেই বিরল হয়ে উঠছে। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।


ফসল আছে, উৎসব নেই

বাংলা হেমন্ত মাস শেষে যখন শীতের আমেজ নামতে শুরু করেছে, লালমনিরহাটের কৃষকরা ব্যস্ত আমন ধান কাটায়। মাঠজুড়ে এখনও সোনালি রঙের কার্পেট—নতুন ধানের ঘ্রাণও আগের মতোই।
কিন্তু নেই সেই উৎসবের ডাক। নেই নতুন চালের ভাত ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ। নেই দাওয়াতি মিলাদ, নেই পিঠার আয়োজন।

কালীগঞ্জের শিয়ালখাওয়া গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন,
“বাবা-চাচাদের মুখে শুনেছি কত আনন্দ হতো নবান্নে। মানুষ একে অপরের বাড়িতে গিয়ে নতুন ভাত খেত। এখন এসব আর দেখা যায় না।”


‘একসময় গরিব ছিলাম, কিন্তু আনন্দ ছিল বেশি’

অদিতমারীর ৭০ বছরের কৃষক শফিক মিয়া বলেন,
“৩০ বছর আগে আমাদের আয় কম ছিল, কিন্তু নবান্ন মানেই ছিল আনন্দের দিন। নতুন চাল দিয়ে পিঠা-পায়েস বানাতাম, প্রতিবেশীর বাসায় দিতাম। প্রথম ভাত মসজিদের ইমামকে দিয়ে দোয়া নিতাম।”

তার আক্ষেপ—“এখন আয়ের পথ বাড়লেও সুখ-আনন্দ কমে গেছে। তরুণরা তো নবান্ন মানেই কী, সেটাই জানে না।”

একই সুর কৃষক জমির আলীর কথায়—
“নতুন ধানের প্রথম ভাত ইমামকে দিতাম, সবাই মিলে খেতাম। এখন সেই রেওয়াজ নাই।”


রীতি-সংস্কৃতি বদলিয়ে যাচ্ছে সময়ের চাপে

দুহুলী এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদশা গোলাম রাব্বানী বলেন,
“আমাদের শৈশবে নবান্ন ছিল সামাজিক মিলনের দিন। দল বেঁধে বিভিন্ন বাড়িতে যেতাম, নতুন চালের খাবার খেতাম। আজকের শিশুরা কেবল নামটি জানে—আত্মা স্পর্শ করার মতো অভিজ্ঞতা নেই।”

বয়োজ্যেষ্ঠ সুলেহা বেগম বলেন,
“নতুন চাল রান্না করে দরজায় রাখতাম, মোল্লা সাহেবকে ডেকে মিলাদ করাতাম। এখন কেউ এসব করে না। সময় বদলেছে, সংস্কৃতিও বদলে গেছে।”


কেন হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন? — ঐতিহাসিক ও বর্তমান বাস্তবতার বিশ্লেষণ

১. কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তন

আগে কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে মৌসুমি ছিল—ধান কাটা ছিল বড় এক সামাজিক ঘটনা।
এখন সারা বছর চাষাবাদ, আধুনিক যন্ত্র, উন্নত জাতের ধান—ফলে ‘নতুন ধান’ আর বিশেষ কিছু মনে হয় না।

২. পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর ভাঙন

যৌথ পরিবার কমে গেছে। গ্রামেও বাড়ছে ব্যস্ততা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন।

৩. বাজারকেন্দ্রিক উৎসব সংস্কৃতি

নবান্ন ছিল ঘরোয়া; এখন উৎসব মানেই বাজারি আয়োজন।
এই পরিবর্তনে কৃষিজ উৎসবের জায়গা সংকুচিত।

৪. অভিবাসন ও নগরায়ণ

অনেক পরিবারের তরুণরা শহরে বা বিদেশে থাকায় গ্রামে উৎসব ধারাবাহিকতা হারাচ্ছে।


কিছু পরিবার এখনও ধরে রেখেছে রীতি

কালীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোজাকের নোমান বলেন,
“অনেক কৃষক এখনও নতুন চাল দিয়ে পিঠা, পুলি, পায়েশ বানিয়ে নবান্ন পালন করেন, তবে তা আগের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করে না।”
তিনি মনে করেন, সচেতন উদ্যোগ নিলে নবান্ন আবারও সামাজিক উৎসবে পরিণত হতে পারে।


বাংলার অন্যতম প্রাচীন উৎসব কি তবে বিলীন হতে চলেছে?

নবান্ন বাংলা কৃষিজীবনের অন্যতম পুরনো উৎসব। এতে ছিল ধর্মীয় আচার, সামাজিক মিলন, পরিবার-প্রতিবেশীর একাত্মতা ও প্রাপ্তির আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার শিক্ষা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—আজ নবান্ন আর বহু গ্রামের প্রধান উৎসব নয়; বরং অতীতের গল্প হয়ে উঠছে।
স্থানীয় মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন—এভাবে চলতে থাকলে একদিন নবান্ন শুধু বইয়ের পাতায় পড়ে থাকা ইতিহাসে রয়ে যাবে।


 পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন

নবান্ন শুধু খাওয়ার উৎসব নয়; এটি কৃষির প্রতি কৃতজ্ঞতার দিন, মাটি-মানুষের আবেগ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘নবান্ন সপ্তাহ’, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি নবান্ন, সাংস্কৃতিক আয়োজন, শিশুদের অংশগ্রহণ—এসব উদ্যোগ নিলে উৎসবটি আবারও ফিরে পেতে পারে তার হারানো প্রাণ।

নতুন ধানের গন্ধ এখনও বাংলার মাঠে ভাসে—এখন প্রয়োজন সেই গন্ধকে আবার মানুষের ঘরে ফিরিয়ে আনা।


#নবান্ন_উৎসব #গ্রামীণ_বাংলা #কৃষি_সংস্কৃতি #বাংলার_ঐতিহ্য #ফিচার_স্টোরি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট

জনপ্রিয় সংবাদ

পাকিস্তানের নির্দেশেই শেখ হাসিনার রায়: শুভেন্দু

নবান্ন: বাংলার নতুন ফসলের গন্ধভরা উৎসব এখন স্মৃতির পাতায়

১১:৫৭:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫

এক ফসল উৎসবের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া

বাংলার কৃষিজ সংস্কৃতির প্রাণ ছিল নবান্ন—নতুন ধানের গন্ধে ঘেরা সেই উৎসব, যেখানে ঘরে ঘরে রান্না হতো নয়া চালের ভাত, পিঠা, পায়েস। একসময় গ্রামের মানুষ অপেক্ষায় থাকত এই দিনে; জমির ধারের সোনালি ধান, উঠোনজুড়ে পোলাওর গন্ধ, আর প্রতিবেশী-আত্মীয়দের দাওয়াত যেন ছিল এক সামাজিক আনন্দের মহড়া।
কিন্তু আজ সেই দৃশ্য বাংলাদেশের বহু গ্রামেই বিরল হয়ে উঠছে। উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ।


ফসল আছে, উৎসব নেই

বাংলা হেমন্ত মাস শেষে যখন শীতের আমেজ নামতে শুরু করেছে, লালমনিরহাটের কৃষকরা ব্যস্ত আমন ধান কাটায়। মাঠজুড়ে এখনও সোনালি রঙের কার্পেট—নতুন ধানের ঘ্রাণও আগের মতোই।
কিন্তু নেই সেই উৎসবের ডাক। নেই নতুন চালের ভাত ভাগ করে খাওয়ার আনন্দ। নেই দাওয়াতি মিলাদ, নেই পিঠার আয়োজন।

কালীগঞ্জের শিয়ালখাওয়া গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম বলেন,
“বাবা-চাচাদের মুখে শুনেছি কত আনন্দ হতো নবান্নে। মানুষ একে অপরের বাড়িতে গিয়ে নতুন ভাত খেত। এখন এসব আর দেখা যায় না।”


‘একসময় গরিব ছিলাম, কিন্তু আনন্দ ছিল বেশি’

অদিতমারীর ৭০ বছরের কৃষক শফিক মিয়া বলেন,
“৩০ বছর আগে আমাদের আয় কম ছিল, কিন্তু নবান্ন মানেই ছিল আনন্দের দিন। নতুন চাল দিয়ে পিঠা-পায়েস বানাতাম, প্রতিবেশীর বাসায় দিতাম। প্রথম ভাত মসজিদের ইমামকে দিয়ে দোয়া নিতাম।”

তার আক্ষেপ—“এখন আয়ের পথ বাড়লেও সুখ-আনন্দ কমে গেছে। তরুণরা তো নবান্ন মানেই কী, সেটাই জানে না।”

একই সুর কৃষক জমির আলীর কথায়—
“নতুন ধানের প্রথম ভাত ইমামকে দিতাম, সবাই মিলে খেতাম। এখন সেই রেওয়াজ নাই।”


রীতি-সংস্কৃতি বদলিয়ে যাচ্ছে সময়ের চাপে

দুহুলী এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক বাদশা গোলাম রাব্বানী বলেন,
“আমাদের শৈশবে নবান্ন ছিল সামাজিক মিলনের দিন। দল বেঁধে বিভিন্ন বাড়িতে যেতাম, নতুন চালের খাবার খেতাম। আজকের শিশুরা কেবল নামটি জানে—আত্মা স্পর্শ করার মতো অভিজ্ঞতা নেই।”

বয়োজ্যেষ্ঠ সুলেহা বেগম বলেন,
“নতুন চাল রান্না করে দরজায় রাখতাম, মোল্লা সাহেবকে ডেকে মিলাদ করাতাম। এখন কেউ এসব করে না। সময় বদলেছে, সংস্কৃতিও বদলে গেছে।”


কেন হারিয়ে যাচ্ছে নবান্ন? — ঐতিহাসিক ও বর্তমান বাস্তবতার বিশ্লেষণ

১. কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তন

আগে কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে মৌসুমি ছিল—ধান কাটা ছিল বড় এক সামাজিক ঘটনা।
এখন সারা বছর চাষাবাদ, আধুনিক যন্ত্র, উন্নত জাতের ধান—ফলে ‘নতুন ধান’ আর বিশেষ কিছু মনে হয় না।

২. পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর ভাঙন

যৌথ পরিবার কমে গেছে। গ্রামেও বাড়ছে ব্যস্ততা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন।

৩. বাজারকেন্দ্রিক উৎসব সংস্কৃতি

নবান্ন ছিল ঘরোয়া; এখন উৎসব মানেই বাজারি আয়োজন।
এই পরিবর্তনে কৃষিজ উৎসবের জায়গা সংকুচিত।

৪. অভিবাসন ও নগরায়ণ

অনেক পরিবারের তরুণরা শহরে বা বিদেশে থাকায় গ্রামে উৎসব ধারাবাহিকতা হারাচ্ছে।


কিছু পরিবার এখনও ধরে রেখেছে রীতি

কালীগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোজাকের নোমান বলেন,
“অনেক কৃষক এখনও নতুন চাল দিয়ে পিঠা, পুলি, পায়েশ বানিয়ে নবান্ন পালন করেন, তবে তা আগের মতো আলোড়ন সৃষ্টি করে না।”
তিনি মনে করেন, সচেতন উদ্যোগ নিলে নবান্ন আবারও সামাজিক উৎসবে পরিণত হতে পারে।


বাংলার অন্যতম প্রাচীন উৎসব কি তবে বিলীন হতে চলেছে?

নবান্ন বাংলা কৃষিজীবনের অন্যতম পুরনো উৎসব। এতে ছিল ধর্মীয় আচার, সামাজিক মিলন, পরিবার-প্রতিবেশীর একাত্মতা ও প্রাপ্তির আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার শিক্ষা।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—আজ নবান্ন আর বহু গ্রামের প্রধান উৎসব নয়; বরং অতীতের গল্প হয়ে উঠছে।
স্থানীয় মানুষ, সাংস্কৃতিক কর্মী ও গবেষকেরা আশঙ্কা করছেন—এভাবে চলতে থাকলে একদিন নবান্ন শুধু বইয়ের পাতায় পড়ে থাকা ইতিহাসে রয়ে যাবে।


 পুনরুজ্জীবনের প্রয়োজন

নবান্ন শুধু খাওয়ার উৎসব নয়; এটি কৃষির প্রতি কৃতজ্ঞতার দিন, মাটি-মানুষের আবেগ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘নবান্ন সপ্তাহ’, ইউনিয়ন পর্যায়ে কমিউনিটি নবান্ন, সাংস্কৃতিক আয়োজন, শিশুদের অংশগ্রহণ—এসব উদ্যোগ নিলে উৎসবটি আবারও ফিরে পেতে পারে তার হারানো প্রাণ।

নতুন ধানের গন্ধ এখনও বাংলার মাঠে ভাসে—এখন প্রয়োজন সেই গন্ধকে আবার মানুষের ঘরে ফিরিয়ে আনা।


#নবান্ন_উৎসব #গ্রামীণ_বাংলা #কৃষি_সংস্কৃতি #বাংলার_ঐতিহ্য #ফিচার_স্টোরি #সারাক্ষণ_রিপোর্ট