সংকটে দুলছে ব্রিটিশ পাবলিক ব্রডকাস্টার
বিবিসি বহু দশক ধরে ব্রিটেনের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু সাম্প্রতিক ভুল, বিতর্ক আর পক্ষপাতের অভিযোগে সংস্থাটি এখন গভীর সংকটে। ২০২৭ সালে নতুন রয়্যাল চার্টার নবায়নের আগে বিবিসিকে তার ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখার লড়াই করতে হচ্ছে।
এক সপ্তাহের মধ্যে উৎসব থেকে সংকটে
মাসের প্রথম সপ্তাহটি বিবিসির জন্য ভালো হওয়ার কথা ছিল। ৬ নভেম্বর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘দ্য সেলিব্রিটি ট্রেইটর্স’-এর ফাইনাল সম্প্রচার হলো, যেটি দেখার জন্য লাখো দর্শক টিভির সামনে বসেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই বিবিসির ওপর নতুন করে বিতর্কের ঝড় নেমে আসে।
সপ্তাহের শুরুতেই টেলিগ্রাফ পত্রিকা একটি ফাঁস হওয়া মেমো প্রকাশ করে জানায়—একটি ভিডিওতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারির বক্তৃতা বিভ্রান্তিকরভাবে সম্পাদনা করা হয়েছিল। দ্রুতই বিষয়টি রাজনৈতিক ঝড় তোলে, এবং রবিবারের মধ্যেই বিবিসির ডিরেক্টর জেনারেল ও প্রধান সংবাদ সম্পাদক পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বিবিসির ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন
এই কেলেঙ্কারির মধ্যেই শুরু হচ্ছে বিবিসির ভবিষ্যৎ ভূমিকা ও অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা। ২০২৭ সালে রয়্যাল চার্টার নবায়ন হবে, আর ততদিনে সংস্থাকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সত্যিই পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে। নাহলে, দেশের অন্যতম প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বিবিসি অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে।

ব্রিটেনের ইতিহাসে বিবিসির স্থান
বিবিসিকে অনেকেই ভালোবেসে ডাকেন ‘আন্টি বিব’। আবার সমালোচকরা কখনও কখনও কটূক্তি করতেও ছাড়েন না। ২০-শ শতকজুড়ে এই সংস্থা ব্রিটিশ জীবনের বড় অংশ জুড়ে ছিল—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিলের ভাষণ, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের ১৯৫৩ সালের অভিষেক, বা কিং চার্লস তৃতীয়ের অভিষেক—সবই বিবিসি সম্প্রচার করেছে।
ডেভিড অ্যাটেনবরো তার ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছেন বিবিসির ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইউনিটে। আবার ‘দ্য গ্রেট ব্রিটিশ বেক অফ’, ‘গার্ডেনার্স’ ওয়ার্ল্ড’ এবং ‘স্ট্রিক্টলি কাম ড্যান্সিং’-এর মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানও দর্শকদের উপহার দিয়েছে এই সংস্থা।
কিন্তু আজকের বিভক্ত সমাজে, যেখানে ‘ব্রিটিশ পরিচয়’ নিজেই প্রশ্নবিদ্ধ, একটি সর্বজনীন ও নিরপেক্ষ ব্রডকাস্টারের জন্য জায়গা সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
সাম্প্রতিক ভুলের তালিকা দীর্ঘ
বিবিসির বেশ কিছু ভুল নিজের অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে।
মার্টিন বাশিরের সাজানো কৌশলে প্রিন্সেস ডায়ানার সাক্ষাৎকার—২৫ বছর পর প্রকাশ্যে এসে ডিরেক্টর জেনারেলকে ক্ষমা চাইতে হয়।
২০২৩ সালে সংবাদ পাঠক হিউ এডওয়ার্ডস শিশুদের অশ্লীল ছবি তৈরি করার অভিযোগে জড়িত হন।
গ্লাস্টনবারি উৎসব প্রচারে ‘Death to the IDF’ স্লোগান দেওয়া ব্যান্ডের দৃশ্য সরাতে না পারায় বিতর্ক হয়।
গাজার বিষয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র সরিয়ে নেওয়া হয় কারণ বর্ণনাকারী কিশোরীর বাবা হামাসের কর্মকর্তা বলে জানা যায়।
ট্রাম্পের বক্তব্য সম্পাদনার ‘বড় ভুল’
ফাঁস হওয়া দলিলে দেখা যায়—ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারির বক্তব্যের দুটি অংশ, যেগুলো ৫০ মিনিটের ব্যবধানে ছিল, সেগুলো পাশাপাশি জুড়ে দেওয়া হয়। এতে মনে হয় যেন তিনি সরাসরি ক্যাপিটল হামলা উসকে দিয়েছেন।
এই প্রকাশের পর ডানপন্থী মহলে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। তারা বিবিসিকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযুক্ত করে এবং অর্থায়ন বন্ধের দাবি তোলে। ট্রাম্পও ঘোষণা দেন, তিনি ১ বিলিয়ন (১০০০ মিলিয়ন) ডলারের মামলা করবেন।
বিবিসি ক্ষমা চাইলেও ক্ষতিপূরণের দাবি প্রত্যাখ্যান করে জানায়—মানহানির মতো কোনো ভিত্তি নেই।

বিতর্কের কেন্দ্রে বিবিসির অর্থায়ন
বিবিসির তহবিলের মূল উৎস হলো লাইসেন্স ফি—যা বছরে প্রায় ২৩০ ডলার। ব্রিটেনে যারা লাইভ টিভি দেখেন, তাদের সবার এই ফি দেওয়া বাধ্যতামূলক, বিবিসি দেখুন বা না দেখুন।
সমর্থকদের মতে এই ফি-ই বিবিসিকে সবার জন্য মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করতে সক্ষম করে। কিন্তু বিরোধীদের মতে, এটাই অন্যায়—কারণ নিশ্চয়তাপূর্ণ তহবিল পেয়ে বিবিসি বারবার ভুল করেও জবাবদিহি এড়িয়ে যায়।
আগামী দিনে আর্থিক চ্যালেঞ্জ বাড়ছে
টিকে থাকতে হলে বিবিসিকে হয়তো মিশ্র অর্থায়ন পদ্ধতিতে যেতে হবে। আয়ের ওপর ভিত্তি করে ভিন্নমাত্রার লাইসেন্স ফি, সেরা কনটেন্টের জন্য সাবস্ক্রিপশন, এবং বাণিজ্যিক আয়ে আরও জোর—এই পথগুলোই সামনে খুলে যেতে পারে।
ইতোমধ্যেই বিবিসি আন্তর্জাতিক বাজারে অনুষ্ঠান বিক্রি ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
বিশ্বাস পুনর্গঠন—বিবিসির সবচেয়ে জরুরি কাজ
ব্রিটেন এখন আগের মতো ‘আন্টি বিব’-কে কেন্দ্র করে এক জাতি হয়ে নেই। তবু একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন ব্রডকাস্টারের প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।
বিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্য বিবিসির উচিত ভুল ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা স্বচ্ছভাবে প্রকাশ করা, দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ উন্নত করা এবং নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনায় পেশাদারিত্ব ও জবাবদিহি বাড়ানো।
বছরের পর বছর বিবিসি পিছিয়ে পড়ছে। এই ক্ষয় যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তা ব্রিটেনের জন্যই এক বড় ক্ষতি হবে। গণতান্ত্রিক আলোচনার জন্য বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠান এখনো অপরিহার্য। তাই নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করে সংস্থাটিকে নতুন করে দাঁড় করানোর এখনই সময়।
#BBC #Britain #MediaCrisis #PublicBroadcasting #সারাক্ষণরিপোর্ট
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















