লিন্ডসে ভন — অলিম্পিক স্বর্ণোদ্যোক্তা এবং ইতিহাসের এক কালের সেরা ডাউনহিল স্কিয়ার — অবসর জীবনে অস্বস্তিতে থাকা ও সার্জারি ঋণের পর ২০২৬ উইন্টার অলিম্পিকে ফেরার লক্ষ্য নিয়ে নতুনভাবে ফিরে এসেছেন। তার প্রত্যাবর্তন শুধুই ক্রীড়া রেকড ভাঙার প্রচেষ্টা নয়; এটা কষ্ট, পুনরুত্থান ও নিজের প্রতি বিশ্বাসের কাহিনি।
মধ্যম আঙুলে ট্যাটু: বার্তা এবং মনোভাব
সান ব্রহ্মাঞ্চলের রোদে ভন যখন মাঝ আঙুল উঁচিয়ে হাঁটছেন, সেটা প্রতিরোধের ভাষাও—নিজের সমালোচকদের উদ্দেশে একপ্রকার অস্বীকার ও আত্মবিশ্বাসের ইঙ্গিতও। ২০১৮ পিয়ংচ্যাং অলিম্পিকের আগে তিনি তার ডান হাতের মধ্যম আঙুলে গ্রীক ভাষায় believe শব্দের ট্যাটু করিয়েছিলেন — নিজের উপর বিশ্বাসের নোটিশ। তিনি বলেন, নিজে বিশ্বাসই সবসময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপি ছিল, আর এখন সেটা আরও বেশি সত্যি মনে হয়।
কীর্তি ও কেরিয়ার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
মিনেসোটার ছোট কোনো টিল থেকে শুরু করে ভন ২০টি বিশ্বকাপ ক্রিস্টাল গ্লোব জিতেছেন — যা একসময় সর্বোচ্চ পুরস্কারের সঙ্গে তাল মিলায়। ২০১০ ভ্যানকুভারে তিনি ডাউনহিলে স্বর্ণ জিতে প্রথম আমেরিকান মহিলা হিসেবে সেই কীর্তি স্থাপন করেছিলেন। মোট ৮২টি World Cup জয়ের রেকর্ড রেখে তিনি কয়েকবার শারীরিকভাবে বিধ্বস্ত হলেও কেরিয়ারের উচ্চ চূড়ায় থেকেছেন। বর্তমানে মিকায়েলা শিফ্রিনের ১০১ জয় বর্তমান রেকর্ড বলে গণ্য হচ্ছে, তবু ভনের অবদানের গুরুত্ব অপরিসীম।
বায়োনিক কাহিনি: সার্জারি ও দ্রুত পুনরুদ্ধার
দীর্ঘ ইনজুরি ও নানান অস্ত্রোপচারের পরে ভন ২০২৪ সালের বসন্তে আংশিক হাঁটু প্রতিস্থাপন করান—রোবট-সহায়িত পদ্ধতিতে টাইটানিয়াম ইমপ্লান্ট বসানো হলো। ডক্টররা প্রত্যাশা করেছিলেন যে পদ্ধতিটি দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করবে, কিন্তু যে গতিতে তিনি ফিরে এলেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত পর্যন্ত ছিল। এক মাসের মধ্যে তিনি আবার উচ্চ হিলের জুতো পরার মত স্বাধীনতা অনুভব করেন; প্রতিশ্রুতিশীল মুভমেন্ট, এক পা ঝাঁপ এবং টেনিস খেলার মতো কর্মকাণ্ডে ফিরে আসা—সব মিলিয়ে চিকিৎসকরা নিশ্চিত হয়ে ওঠেন যে তাঁর ইমপ্লান্ট বড় ব্রণের জোরও সহ্য করতে সক্ষম।

অবসরের পরে সমাধান খোঁজা: মানসিক পুনর্গঠন
২০১৯ সালে অবসরের পর ভন মানসিক শূন্যতা এবং অচেনা পরিচয়ের সমস্যার সম্মুখীন হন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, মদত লাগে এমন সময়ে থেরাপি ও কাজ-সংক্রান্ত নতুন কার্যক্রম তাকে আবার দাঁড় করায়। থেরাপিস্ট আর্মানডো গোনজালেজের সঙ্গে কাজ করে তিনি পুরনো সীমাবদ্ধ বিশ্বাসগুলোকে চিহ্নিত করে এদের মোকাবিলা করেন। চলচ্চিত্র নির্মাণ, স্মৃতিচারণ–মেমোয়ার লেখার পাশাপাশি তিনি দাতব্য কাজ ও ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়েন এবং জীবনের নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে পান।
পারিবারিক সংকট ও শক্তি
ভনের মা লিন্ডা ক্রোন দীর্ঘদিন শারীরিক সমস্যায় ভুগেছিলেন; ২০২১ সালে ALS–এর চিকিৎসা-নির্ণয় আসে এবং ২০২২ সালে তিনি মারা যান। মায়ের সংগ্রাম ও ধৈর্য ভনের জন্য অনুপ্রেরণার מקור ছিল—মা তাকে শিখিয়েছেন লড়ে ওঠা আর পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর সাহস। এই ব্যক্তিগত ক্ষতি সত্ত্বেও ভন মানসিকভাবে শক্ত থাকেন এবং এটিই তার প্রত্যাবর্তনের অন্যতম অনুৎসাহ।
শারীরিক বাস্তবতা: ক্লান্তি, ব্যথা ও সিদ্ধান্ত
অবসরের পরে ভন বুঝতে পারেন যে তার শরীর অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত: ACL ও MCL টিয়ার, শিনবোন ভাঙা, নয়টি হাঁটুর অস্ত্রোপচার—সব মিলিয়ে স্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। হাঁটতে কিদারে কুঁচকে যেতেন, সুতরাং দৈনন্দিন কাজও কঠিন হয়ে উঠছিল। সঠিক চিকিৎসা ও রোবট-সহায়িত আংশিক প্রতিস্থাপনই একমুঠো সমাধান হয়ে ওঠে।

ভয়ের মোকাবিলা ও মানসিক কসরত
নতুন করে স্কি প্রতিযোগিতায় ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় থেরাপি–সেশনেই ভন ও থেরাপিস্ট মিলে তার পুরনো দুর্ঘটনার ভিডিওগুলো পুনরায় দেখেন—ভয়কে জড়িয়ে ধরতে এবং তা থেকে মুক্তি পেতে। ভন নিজেই বলেন, তিনি ব্যথা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন—”হই হই করে কিছু মনে না করে এগিয়ে যাওয়া” ধরনের মনস্তত্ত্ব তার মধ্যে আছে। তিনি বলেন, তার উপভোগের কারণে এবং চ্যালেঞ্জের জন্যই তিনি ফেরতে চান—এটি জীবনের অর্থ খোঁজার ফল নয়।
প্রত্যাবর্তন: প্রশিক্ষণ, পারফরম্যান্স ও সমালোচনা
জুন ২০২৪ থেকে তিনি আরম্ভিক ট্রেনিং শুরু করেন—গ্লেসিয়ারে ভোরে উঠা, নিউ জিল্যান্ডে সুপার-জি অনুশীলন, এবং প্রশিক্ষক ও নতুন কোচ আ্যাক্সেল লুন্ড স্বিন্দালকে যুক্ত করা—সবই তাঁর প্রস্তুতির অংশ। করোনা-পরের বিশ্বকাপ–পর্বে ফিরতে গিয়ে সমালোচনা ও সন্দেহের মুখেও পড়েন; কয়েকজন সিনিয়র স্কিয়ার তাঁর সিদ্ধান্তকে উদ্বেগজনক বা অযৌক্তিক বলেও মন্তব্য করেন। এই নেতিবাচক কন্ঠগুলি ভনকে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজে লাগাতে জানেন—তিনি এগুলোকে মটিভেশন হিসেবে রূপান্তর করেন এবং নিজের মায়ের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে চান।
প্রতিযোগিতামূলক ফলাফল ও মনোবল
২০২৪–২০২৫ মৌসুমে কিছু হতাশাজনক ফলের পর সৌজন্যভাবে মার্চের ওয়ার্ল্ড কাপে সান ভ্যালি–তে দ্বিতীয়স্থান অর্জনের পর সেই মুহূর্তটি তাকে বড় অনুপ্রেরণা দেয়। টুরে তিনি শুরুতে তালিকায় পিছনের দলে ধরেন—কিছু ইভেন্টে ২০তম-র মতো ফল পেলেও পরবর্তী ইভেন্টগুলোতে তিনি ফিরে আসেন এবং টপ-থার্টিতে উঠার যোগ্যতা অর্জন করেন। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে এক কয়েকটি কুঁচকির পরে তিনি বুট বদলান, কৌশল পরিবর্তন করেন এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে আরও ভালো করার চেষ্টা করেন।

ব্যক্তিগত জীবন, সাফল্য ও আনন্দের মুহূর্ত
অবসরের পর ভন বিভিন্ন উদ্যোগে জড়িয়ে পড়েছেন—লোকেরা তাকে সেলিব্রিটি মহলে দেখলেও তিনি বলছেন তিনি সুনির্দিষ্টভাবে কেবল খ্যাতির জন্য এসব করে না; তিনি মানুষের গল্প জানতেই আগ্রহী। তিনি ফাউন্ডেশনের কাজ, বিনিয়োগ এবং অ্যাথেনা ক্যাপিটালের মতো মহিলাভিত্তিক ভেঞ্চারে জড়িত। ব্যক্তিজীবনে তিনি পরিবারের পরিকল্পনা নিয়েও ভাবছেন—ডিম ফ্রোজেন রেখেছেন, পেট-লাইফে সদ্য নতুন কুকুর নেয়া হয়েছে—এগুলো সবই তার জীবনের ভারসাম্য দেখায়। তিনি নিজের ৪০-য় দশকটি উপভোগ করছেন এবং বলছেন—এখন তার পর্যাপ্ত আনন্দ ও উদ্দেশ্য আছে।
অলিম্পিক লক্ষ্য: কোর্টিনা এবং সম্ভবনা
কোর্টিনা দ্যাম্পেজোতে ২০২৬ অলিম্পিকে ভন সম্ভাব্যভাবে ডাউনহিল, সুপার-জি ও কম্বাইন টিম ইভেন্টে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি মনে করেন তিনি প্রায়ই প্রত্যাশা ছাড়িয়ে কাজ করে ফেলেছেন—অলিম্পিক মেডাল জয় আগামী কীর্তি হবে, আর যদি তা ঘটে গলে তিনি ইতিহাসে আরও উচ্চতর অবস্থানে উঠবেন। অন্যদিকে তিনি বাস্তববাদীও—জয় না হোক, কিন্তু তিনি আত্মতৃপ্তি পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
লিন্ডসে ভনের প্রত্যাবর্তন কেবল ক্রীড়া কাহিনি নয়—এটি শরীর ও মনের লড়াই, আত্মবিশ্বাস, এবং পুনরুজ্জীবনের গল্প। তিনি নিজেকে ইতিমধ্যেই অনেকেই মোটেই ভাবেনা এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন; এবার তিনি কাঠামোবদ্ধভাবে ২০২৬–এ পুনরায় বড় অ্যাপিয়ার করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর কথায়, “আমি কোনো লংশট নই। আমি আবার খেলায় ফিরে এসেছি।” এবং যদি তিনি কোর্টিনা–এ স্টার্টিং গেটে দাঁড়ান, তাহলে সারা বিশ্ব তাকিয়ে থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















