০৩:৩০ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

কেন স্বৈরশাসকরা নাটককে ভয় পায়

নাটক—মঞ্চে বা পর্দায়—শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি মানুষের মনের গভীরতম প্রশ্নগুলোকে জাগিয়ে তোলে। তাই ইতিহাসজুড়ে দেখা গেছে, প্রায় সব স্বৈরশাসকই নাটক, থিয়েটার, চলচ্চিত্র, এমনকি টেলিভিশন ধারাবাহিকের ওপর নজরদারি করেছেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন অথবা সৃষ্টিশীল মানুষদের শাস্তি দিয়েছেন।

স্বৈরাচারী শাসকেরা সবসময় আতঙ্কে থাকেন যে নাটক মানুষের চিন্তাকে উসকে দেবে, বিদ্রোহকে ভাষা দেবে এবং শাসকের দুর্বলতাকে জনসমক্ষে উন্মোচন করবে। কেন নাটক এত ভয়ংকর হয়ে ওঠে শাসকের চোখে?

নাটক মানুষের কল্পনাশক্তিকে উসকে দেয়

স্বৈরশাসন টিকে থাকে নিয়ন্ত্রণ আর ভয়ের ওপরে। শাসক চায় মানুষ যেন প্রশ্ন না করে, যেন তারা শাসকের দেওয়া ভাষা, ব্যাখ্যা আর সত্যকে চোখ বুজে মেনে নেয়। কিন্তু নাটক মানুষকে নতুন জগৎ কল্পনা করতে শেখায়। দর্শক ভাবতে শেখে—“যদি অন্যরকম হতো?”, “কেন এটা হচ্ছে?”
এই কল্পনাশক্তিই হলো স্বাধীনতার বীজ। শাসকেরা জানে, একবার যদি মানুষ কল্পনা করে যে অন্য কোনো সমাজ বা শাসনব্যবস্থা সম্ভব, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যাবে।

নাটক লুকোনো সত্যকে প্রকাশ করে

যেকোনো ভালো নাটক মানুষের জীবনের সত্যকে উন্মোচন করে। সমাজের বৈষম্য, অবিচার, দুঃখ—সবকিছু নাটকে উঠে আসে। স্বৈরশাসকরা চায় এগুলো চাপা থাকুক; তারা চায় জনগণ শোনুক তাদের ঘোষিত সাফল্যের গল্প, উন্নয়নের প্রচার।
কিন্তু নাটক সেই পর্দা ছিঁড়ে ফেলে। সেটিই বলে, “দেখো, সত্যি কী হচ্ছে!” এই প্রকাশ শাসকের জন্য বিপজ্জনক।

নাটক সহানুভূতি জাগায়

দর্শক যখন মঞ্চে বা পর্দায় কারও কষ্ট দেখে, তারা সেই কষ্টকে নিজের মনে অনুভব করে। এই সহানুভূতি বিপ্লবের প্রথম ধাপ।
স্বৈরশাসকরা চায় মানুষেরা উদাসীন হোক, একে অপরের দুঃখে না কাঁদুক, অন্যায় দেখলেও মুখ ফিরিয়ে নিক। নাটক সেই দেয়াল ভেঙে দেয়।

নাটক ভাষার শক্তিকে কাজে লাগায়

স্বৈরাচারীরা ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে—সংবাদপত্র, টিভি, পাঠ্যবই—সবকিছুতেই শাসকের ভাষা প্রাধান্য পায়। নাটক সেই ভাষা বদলে দিতে পারে।
নাটকে শোষিত মানুষের ভাষা উঠে আসে; বিদ্রোহের ভাষা শোনা যায়। এতে শাসকের ভাষা ক্ষমতা হারায়।

 

নাটক জনগণকে একত্রিত করে

নাটক কখনো একা দেখা যায় না। এটি একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা—মঞ্চে, সিনেমা হলে, এমনকি টিভির পর্দায়ও পরিবার বা বন্ধুরা একসাথে দেখে।
মানুষ একসাথে কিছু দেখলে, একসাথে হাসে বা কাঁদে—সেই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে একতা আনে। এই ঐক্য শাসকের সবচেয়ে বড় শত্রু।

ইতিহাসে নাটকের ওপর নিপীড়ন

  • প্রাচীন গ্রীসে রাজনৈতিক বিতর্ক থামাতে নাট্যকারদের শাস্তি দেওয়া হতো।
    •সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিন বহু নাট্যকার ও পরিচালককে গুলিতে হত্যা করেছেন বা গুলাগে পাঠিয়েছেন।
    • বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে নাটক, সিনেমা, কবিতা সেন্সর করা হয়েছে।
    • আজও বহু দেশে থিয়েটার দলগুলোকে লাইসেন্স নিতে হয়, স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করাতে হয়।

তাই স্বৈরশাসকেরা নাটককে ভয় পায়

একটি স্বৈরশাসক জানে, জেল-জুলুম দিয়ে শরীর বন্দি করা যায়, মন নয়। নাটক সেই মনকে সাহসী ও জাগ্রত হতে শেখায়।
তাই যেখানে মানুষের কণ্ঠ রোধ করা হয়, সেখানেই নাটক সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে শাসকের জন্য।
নাটক মানুষের জন্য শুধু বিনোদন নয়—এটি মুক্তির হাতিয়ার।

কেন স্বৈরশাসকরা নাটককে ভয় পায়

১১:৩০:২৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৭ জুলাই ২০২৫

নাটক—মঞ্চে বা পর্দায়—শুধুমাত্র বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি মানুষের মনের গভীরতম প্রশ্নগুলোকে জাগিয়ে তোলে। তাই ইতিহাসজুড়ে দেখা গেছে, প্রায় সব স্বৈরশাসকই নাটক, থিয়েটার, চলচ্চিত্র, এমনকি টেলিভিশন ধারাবাহিকের ওপর নজরদারি করেছেন, নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন অথবা সৃষ্টিশীল মানুষদের শাস্তি দিয়েছেন।

স্বৈরাচারী শাসকেরা সবসময় আতঙ্কে থাকেন যে নাটক মানুষের চিন্তাকে উসকে দেবে, বিদ্রোহকে ভাষা দেবে এবং শাসকের দুর্বলতাকে জনসমক্ষে উন্মোচন করবে। কেন নাটক এত ভয়ংকর হয়ে ওঠে শাসকের চোখে?

নাটক মানুষের কল্পনাশক্তিকে উসকে দেয়

স্বৈরশাসন টিকে থাকে নিয়ন্ত্রণ আর ভয়ের ওপরে। শাসক চায় মানুষ যেন প্রশ্ন না করে, যেন তারা শাসকের দেওয়া ভাষা, ব্যাখ্যা আর সত্যকে চোখ বুজে মেনে নেয়। কিন্তু নাটক মানুষকে নতুন জগৎ কল্পনা করতে শেখায়। দর্শক ভাবতে শেখে—“যদি অন্যরকম হতো?”, “কেন এটা হচ্ছে?”
এই কল্পনাশক্তিই হলো স্বাধীনতার বীজ। শাসকেরা জানে, একবার যদি মানুষ কল্পনা করে যে অন্য কোনো সমাজ বা শাসনব্যবস্থা সম্ভব, তবে তাদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে যাবে।

নাটক লুকোনো সত্যকে প্রকাশ করে

যেকোনো ভালো নাটক মানুষের জীবনের সত্যকে উন্মোচন করে। সমাজের বৈষম্য, অবিচার, দুঃখ—সবকিছু নাটকে উঠে আসে। স্বৈরশাসকরা চায় এগুলো চাপা থাকুক; তারা চায় জনগণ শোনুক তাদের ঘোষিত সাফল্যের গল্প, উন্নয়নের প্রচার।
কিন্তু নাটক সেই পর্দা ছিঁড়ে ফেলে। সেটিই বলে, “দেখো, সত্যি কী হচ্ছে!” এই প্রকাশ শাসকের জন্য বিপজ্জনক।

নাটক সহানুভূতি জাগায়

দর্শক যখন মঞ্চে বা পর্দায় কারও কষ্ট দেখে, তারা সেই কষ্টকে নিজের মনে অনুভব করে। এই সহানুভূতি বিপ্লবের প্রথম ধাপ।
স্বৈরশাসকরা চায় মানুষেরা উদাসীন হোক, একে অপরের দুঃখে না কাঁদুক, অন্যায় দেখলেও মুখ ফিরিয়ে নিক। নাটক সেই দেয়াল ভেঙে দেয়।

নাটক ভাষার শক্তিকে কাজে লাগায়

স্বৈরাচারীরা ভাষা নিয়ন্ত্রণ করে—সংবাদপত্র, টিভি, পাঠ্যবই—সবকিছুতেই শাসকের ভাষা প্রাধান্য পায়। নাটক সেই ভাষা বদলে দিতে পারে।
নাটকে শোষিত মানুষের ভাষা উঠে আসে; বিদ্রোহের ভাষা শোনা যায়। এতে শাসকের ভাষা ক্ষমতা হারায়।

 

নাটক জনগণকে একত্রিত করে

নাটক কখনো একা দেখা যায় না। এটি একটি সামাজিক অভিজ্ঞতা—মঞ্চে, সিনেমা হলে, এমনকি টিভির পর্দায়ও পরিবার বা বন্ধুরা একসাথে দেখে।
মানুষ একসাথে কিছু দেখলে, একসাথে হাসে বা কাঁদে—সেই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে একতা আনে। এই ঐক্য শাসকের সবচেয়ে বড় শত্রু।

ইতিহাসে নাটকের ওপর নিপীড়ন

  • প্রাচীন গ্রীসে রাজনৈতিক বিতর্ক থামাতে নাট্যকারদের শাস্তি দেওয়া হতো।
    •সোভিয়েত ইউনিয়নে স্টালিন বহু নাট্যকার ও পরিচালককে গুলিতে হত্যা করেছেন বা গুলাগে পাঠিয়েছেন।
    • বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময়ে নাটক, সিনেমা, কবিতা সেন্সর করা হয়েছে।
    • আজও বহু দেশে থিয়েটার দলগুলোকে লাইসেন্স নিতে হয়, স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করাতে হয়।

তাই স্বৈরশাসকেরা নাটককে ভয় পায়

একটি স্বৈরশাসক জানে, জেল-জুলুম দিয়ে শরীর বন্দি করা যায়, মন নয়। নাটক সেই মনকে সাহসী ও জাগ্রত হতে শেখায়।
তাই যেখানে মানুষের কণ্ঠ রোধ করা হয়, সেখানেই নাটক সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে শাসকের জন্য।
নাটক মানুষের জন্য শুধু বিনোদন নয়—এটি মুক্তির হাতিয়ার।