জিনের ভাষা শেখার যাত্রা
২০০০ সালে প্রথম মানব জিনোমের খসড়া উন্মোচিত হলে, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন বলেছিলেন, মানবজাতি তখন ‘‘ঈশ্বরের জীবনের ভাষা’’ শিখছে। তবে এটি অনেকটা তাড়াহুড়ো করে করা মূল্যায়ন ছিল। কারণ পুরো জিনোমের সিকোয়েন্স শেষ হতে লেগেছিল ২০২২ সাল পর্যন্ত।
বিজ্ঞানীরা ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করে এর লেখা পড়তে পারেন বা ক্রিসপার প্রযুক্তি দিয়ে সামান্য সম্পাদনা করতে পারেন। তবে আসলেই নতুন করে জিন লেখা খুব কঠিন কাজ।
সিনথেটিক হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের সূচনা
২৬ জুন চালু হওয়া ‘‘সিনথেটিক হিউম্যান জিনোম’’ (SynHG) নামের নতুন প্রকল্প এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে চায়। এটি আংশিকভাবে ওয়েলকাম চ্যারিটির অর্থায়নে এবং ব্রিটেনের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জেসন চিন এই প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁর মতে, মানুষের ক্রোমোজোম শূন্য থেকে বানানোর উপযোগী সরঞ্জাম তৈরি হলে বিজ্ঞানীরা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন কোন জিনের সিকোয়েন্স কীভাবে কোষের মধ্যে কাজ করে।
কৃত্রিম জিনের ইতিহাস ও অগ্রগতি
প্রথম কৃত্রিম জিন তৈরি হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে।
২০০৮, ২০১০ এবং ২০১৯ সালে ব্যাকটেরিয়া যেমন মাইকোপ্লাজমা জেনিটালিয়াম,মাইকোপ্লাজমা মাইকয়েডস এবং ইশেরিশিয়া কোলির জিনোম কৃত্রিমভাবে তৈরি হয়।
মানুষের কাছাকাছি জৈবিক গঠনবিশিষ্ট বেকারের ইস্টের জিনোম পুনর্গঠন ২০০৬ সাল থেকে চলেছে এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে এর সব ১৬টি ক্রোমোজোম তৈরি সম্পন্ন হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও ডিজাইন সহায়তা
এখন বড় এআই মডেলগুলো ক্রমবর্ধমান জিনোমিক ডেটা দিয়ে প্রশিক্ষিত হচ্ছে এবং নতুন ডিজাইন তৈরিতে সহায়তা করছে।
ফেব্রুয়ারিতে পালো অল্টোর আর্ক ইনস্টিটিউট Evo 2 নামের এআই মডেল প্রকাশ করে, যা ছোট ডিএনএ সিকোয়েন্সের ভিত্তিতে নতুন জিনোম ডিজাইন তৈরি করতে পারে।
২৫ জুন গুগল ডিপমাইন্ড AlphaGenome উন্মোচন করে, যা ছোট জিনগত পরিবর্তনের ফলে কোষের কার্যকারিতা কীভাবে বদলাবে তা অনুমান করতে পারে।
আর্ক ইনস্টিটিউটের হানি গুদারজি বলেন, এই দুটি মডেল একসাথে ব্যবহার করলে বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট কোষীয় কার্যকারিতা চালু করার মতো নতুন মানব ডিএনএ ডিজাইন করতে পারবেন।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এটি এক আকর্ষণীয় দৃষ্টিভঙ্গি। যদি সম্ভব হয়, বিজ্ঞানীরা জিনোমের যেকোনো পরিবর্তনের প্রভাব অনুমান ও পরীক্ষা করতে পারবেন।
জিনগত রোগ বা হৃদযন্ত্রের অসুস্থতা সারাতে স্বাস্থ্যকর বা প্রকৌশলীকৃত কোষের থেরাপি আরও নিরাপদ ও কার্যকর করা যাবে।
প্রতিস্থাপনের আগে কোষ, টিস্যু বা অঙ্গের ডিএনএ এমনভাবে ডিজাইন করা যাবে যাতে সেগুলো ভাইরাস প্রতিরোধী হয়।
বড় চ্যালেঞ্জ: স্কেল ও খরচ
ডিএনএ গঠিত হয় নিউক্লিওটাইড নামের বিল্ডিং-ব্লক দিয়ে।
বিজ্ঞানীরা একেকটি নিউক্লিওটাইড করে স্ট্র্যান্ড তৈরি করেন, তারপর সেগুলো জোড়া লাগান।
এতে ছোট টুকরো ঠিকঠাক তৈরি হয়, তবে বড় অংশ (যা ছোট অংশ মিলিয়ে হয়) অনেক বেশি কঠিন ও ব্যয়বহুল।
এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কৃত্রিম জিনোম ইস্টের, যা ১ কোটি ২০ লাখ বেস পেয়ার।
তুলনায় সবচেয়ে ছোট মানব ক্রোমোজোম ২১-এর দৈর্ঘ্য ৪ কোটি ৫০ লাখ বেস পেয়ার।
হার্ভার্ডের জীববিজ্ঞানী জর্জ চার্চ বলেন, পুরো মানব ক্রোমোজোম তৈরি করতে ২ কোটি ডলারের বেশি খরচ হতে পারে। তিনি আগে ই. কোলি ব্যাকটেরিয়ার জিনোম ভাইরাস প্রতিরোধী করেছেন এবং শূকরের জিনোম নিয়েও এমন কাজ করতে চান।
ড. চিনের হিসাবে অবশ্য খরচ অনেক কম, প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ডলার। তবে এতসব পরিকল্পনা সত্ত্বেও, নিয়মিতভাবে পুরো জিনোম তৈরি করা সম্ভব হবে কিনা স্পষ্ট নয়। কারণ ক্রিসপারসহ অন্যান্য জিন-সম্পাদনা পদ্ধতি হয়তো অনেক সস্তা ও নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসেবে দাঁড়াবে।
নৈতিক বিতর্ক
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবী ও বায়োএথিক্স বিশেষজ্ঞ হ্যাঙ্ক গ্রিলি বলেন, কৃত্রিম মানব ক্রোমোজোম স্বাভাবিকভাবে কাজ করে কিনা তা পরীক্ষা করতে শিশুদের শরীরে এটি প্রবেশ করাতে হবে—যা বেশিরভাগ দেশে অবৈধ।
ড. চিন স্পষ্ট করে বলেছেন, তাঁর এমন কোনো পরিকল্পনা নেই। বরং SynHG প্রকল্পে ‘‘Care-full Synthesis’’ নামের একটি উদ্যোগ থাকবে, যা মানব কৃত্রিম জিনোম গবেষণার নৈতিক দিকগুলো নিয়ে কাজ করবে।
একটি বৈপ্লবিক সাফল্যের সম্ভাবনা
পেট্রি ডিশে মানব ক্রোমোজোম তৈরি করাই হবে এক বিশাল সাফল্য।এটি প্রমাণ করবে, বিজ্ঞানীরা শুধু জীবনের ভাষা পড়তেই নয়, লিখতেও শিখছেন।