বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের প্রাচীন ও সমৃদ্ধ নদ-নদীর মধ্যে দড়াটানা নদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাগেরহাট জেলার এই নদীটি শুধু একটি জলপথ নয়—দুই শতাধিক বছরের ইতিহাস জুড়ে এটি এক অনন্য সভ্যতার, ব্যবসা-বাণিজ্যের, বনজীবনের ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে আছে।
প্রাচীন ইতিহাস ও নদীর জন্ম
দড়াটানা নদীর উৎপত্তি কচা নদীর একটি শাখা হিসেবে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে নদীর প্রবাহ কিছুটা কৃত্রিম খনন এবং প্রাকৃতিক খালের সম্প্রসারণের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সুবিধার জন্য গড়ে তোলা হয়। ১৮০০-এর দশকের প্রথম ভাগেই এই নদীপথ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ এটি মোংলা বন্দর ও সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশকে বাগেরহাট শহরের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।
নদীর নামকরণ নিয়েও জনশ্রুতি আছে। এককালে দুই দিক দিয়ে দুটি শাখা এসে মিলে যেত বলে স্থানীয়রা একে দো-রত্না বা দুই রত্নের মিলন বলে ডাকত। কিছু ইতিহাসবিদের মতে, ‘রত্না’ বলতে নদীর উর্বরতা বা মাছের প্রাচুর্য বোঝানো হত।
দুই তীরের বনজ জীবন
দড়াটানা নদীর দুই পাড় জুড়ে শুরুর দিকে ছিল গভীর বন, যা সুন্দরবনের উপকূলীয় বনের সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচিত হতো। গেওয়া, গরান, সুন্দরী প্রজাতির গাছ থাকত। বনজ প্রাণীর মধ্যে হরিণ, শেয়াল, বনবিড়াল, বাদুড় এবং বিভিন্ন প্রজাতির সাপ পাওয়া যেত।
এখনও নদীর কিছু অংশের দুই পাড়ে আংশিক বনভূমি আছে। এখানে পাখিদের মধ্যে বক, পানকৌড়ি, মাছরাঙা, জলমুরগি প্রভৃতি দেখা যায়। বিশেষ করে শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের ভিড় হয়।
দুই তীরের নগরী ও জনপদ
দড়াটানা নদীর দুই পাড়ে ছড়িয়ে আছে বাগেরহাট শহর, রামপাল, ফকিরহাটের কিছু অংশ। ঔপনিবেশিক আমলে নদীর দুই পাড়ে গড়ে ওঠে ছোট ছোট বাজার। নদীপথে পণ্য আনা-নেওয়ার সুবিধার কারণে হাটবাজারগুলো বিকশিত হয়। কলাপাতা, সুপারি, মাছ, ধান, নোনা-লবণ, কাঠ ও মাটির পণ্য আসত-যেত এই নদী বেয়ে।
বাগেরহাট শহর মূলত নদীর পশ্চিম তীরে বিস্তৃত হলেও পূর্ব পাড়েও বসতি গড়ে উঠেছিল। এই দুই পাড়কে নৌকা ও ছোট ফেরি দিয়ে যুক্ত করা হত।
নদীর মাছ ও জলজ সম্পদ
দড়াটানা নদী মিঠা ও লবণাক্ত পানির সংমিশ্রণের কারণে মাছের আকারে ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ। নদীতে আইল, ট্যাংরা, পারশে, শোল, গজার, পুঁটি, বেলে, চিংড়ি পাওয়া যেত। বর্ষায় নদী ফুলে গেলে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হত। বড় নৌকা ও ছইনৌকা নিয়ে জেলে দল নদীতে নামত।
এখনও কিছু অংশে মাছ ধরা হয়, তবে দূষণ, নাব্যতা কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত আহরণের কারণে মাছের প্রাচুর্য অনেক কমেছে।
ব্যবসা-বাণিজ্যের যোগাযোগ
ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ-পরবর্তী আমলে দড়াটানা নদী ছিল প্রধান বাণিজ্যিক রুট। মোংলা বন্দর, সুন্দরবন উপকূল, খুলনা শহর—সব কিছুর সঙ্গে বাগেরহাটের যোগাযোগ হত এই নদীপথে। নৌকা, পালতোলা সাম্পান ও পরে ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌযান এই পথে চলত।
খেজুরগুড়, ধান, চাল, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, কাঠের আসবাব, নারকেল, সুপারি, মাছ—সবকিছুই নদীপথে পরিবহন করা হত। ব্যবসায়ী, মাঝি ও হাটের মালিকরা নদীর পাড়ে গড়ে তুলেছিল গুদাম, আড়ত, খাজাঞ্চিখানা।
সংস্কৃতি ও সাহিত্য
দড়াটানা নদী বাগেরহাট অঞ্চলের লোকসংস্কৃতিতেও প্রবলভাবে উপস্থিত। লোককথা ও পালাগানে নদীর বর্ণনা পাওয়া যায়। কিছু এলাকায় বিয়ে বা উৎসবে নদীর নাম করে গান হয়—
“দড়াটানা তুই বইস না রে কূল ভাঙি,
নাও ভাসাইয়া নে যাইও সখা বাগেরহাট মাঙি।”
এই নদীর তীরেই বসত বৈঠকি আসর, পুঁথি-পাঠ, বাউল গানের আসর। নদীর পাড়ে মেলা বসত, যেখানে পালা-গান, যাত্রা হত।
সাহিত্যিক বর্ণনা
১৯ শতক ও ২০ শতকের গোড়ার দিকে বাগেরহাটের কবি ও গীতিকারদের কিছু রচনায় দড়াটানা নদীর নাম ও রূপক ব্যবহার আছে। নদীর বুকে জোয়ার-ভাটার খেলা, মাঝিদের জীবনযুদ্ধ, নদীর দিকেই চেয়ে থাকা প্রিয়তমার গান—এসব নিয়ে রচিত হয়েছে পদ্য ও গান।
নদীর পরিবর্তন ও সংকট
দুই শত বছরের ব্যবধানে দড়াটানা নদী অনেক বদলে গেছে। পল সঞ্চয়, নাব্যতা কমা, অপরিকল্পিত বাঁধ, শিল্প ও গৃহস্থালীর বর্জ্য—সব মিলিয়ে নদীর স্বাস্থ্য বিপন্ন। বন্যা-নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাস্তা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ আটকে দিয়েছে। কিছু জায়গায় নদীর দুই পাড় দখল হয়ে গেছে।
পুনরুজ্জীবনের আশা
তবু দড়াটানা নদীর গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি। এখনো বাগেরহাট শহরের মানুষ নদী থেকে পানি ব্যবহার করে, নদী পাড়ের হাট-বাজার আংশিকভাবে সচল। পর্যটনের সম্ভাবনাও আছে—পুরনো বাজারঘাট, ঔপনিবেশিক গুদামঘর, নদীর মোহনা, সুন্দরবনের সংযোগ এই নদীকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
পরিকল্পিত খনন, দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও নদীভিত্তিক পর্যটন উদ্যোগ নিলে দড়াটানা নদী আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে।
দড়াটানা নদী শুধু বাগেরহাটের নদীপথ নয়—এটি দুই শত বছরের ইতিহাস, সভ্যতা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জীববৈচিত্র্য এবং সংস্কৃতির ধারক। এই নদীর পাড়ে জন্মেছে বাজার, নগর, বনজীবন, গান, কবিতা, মানুষের হাসি-কান্না। দড়াটানা নদী বাঁচলে বাঁচবে বাগেরহাটের ঐতিহ্যও।