কিশোরগঞ্জের একটি বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি টিউশনি করে সংসার চালান এবিএম শফিউল্লাহ। সেখান থেকে তার যে উপার্জন হয়, তা দিয়ে সংসারে ব্যয় মেটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল। যে কারণে কয়েক বছর আগে কিছু টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগও করেছিলেন।
চাকরি ও টিউশনির উপার্জনের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে তার যে আয় হতো সেটি দিয়ে মোটামুটিভাবে তার সংসারের ব্যয় নির্বাহ হতো।
এ বছরের জুলাই থেকে আগামী ছয় মাসের জন্য সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। সঞ্চয়পত্রে সুদের হার কমানোর বিষয়টি নিয়ে বেশ ক্ষুব্ধ স্কুল শিক্ষক মি. শফিউল্লাহ।
বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, “খুব হিসাবের সংসার আমার। এখন যদি আমার উপার্জন এক হাজার টাকাও কমে তখন পরিবারের খরচ, মায়ের ওষুধ কেনা ও অন্যান্য ব্যয় আমি কিভাবে মেটাব? এটা তো মধ্যবিত্তের ওপর জুলুম”।
যদিও সরকার যে সুদহার কমিয়েছে, সেটা তার আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে আপাতত কোনো পরিবর্তন আনবে না। তবে তিনি নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনলে বা পুনঃবিনিয়োগ করলে নতুন হার প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশে ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেকেই সঞ্চয়পত্র কিনে থাকেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোর আয়ের একটি অংশ আসে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা থেকে।
চাকরিজীবীদের অনেকেই অবসরে যাওয়ার পর পেনশনের টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। সরকার হঠাৎই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমানোয় বিবিসি বাংলার কাছে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন শফিউল্লাহর মতো আরো কয়েকজন।
চলতি বছরের বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয় নি। অন্যদিকে সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানো হয়েছে। সেই সাথে মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকায় এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে সীমিত আয়ের মানুষজনের ওপর।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগের কথা চিন্তা করে সঞ্চয়পত্রে অনেকেই বিনিয়োগ করে থাকেন। সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে বেশ চাপে পড়বেন সীমিত আয়ের মানুষজন।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “ছোট ও ক্ষুদ্র পেনশন অর্জনকারীদের সুদের হার কমালে তাদের জীবন জীবিকার ওপর চাপ পড়ে। সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে এভাবে সুদহার কমানো সঠিক পলিসি নয়”।
তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ’র শর্ত বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোর এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এর আগে অবশ্য গত জানুয়ারি মাসেই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কিছুটা বাড়ানো হয়েছিল। সেই সময় প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, প্রতি ছয়মাস পরপর মুনাফার হার পুনরায় নির্ধারণ করা হবে।
সঞ্চয়পত্রের রশিদ
সঞ্চয়পত্রের নতুন সুদহার কত?
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নতুন বিনিয়োগে বিভিন্ন পলিসিতে সঞ্চয়পত্রের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১১ দশমিক ৯৮ শতাংশ এবং সর্বনিম্ন সুদহার হবে ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।
পহেলা জুলাই থেকে যে সুদহার চালু হয়েছে, সে অনুযায়ী যাদের বিনিয়োগ কম তাদের সুদহার তুলনামূলক বেশি। আর যাদের বিনিয়োগের পরিমাণ বেশি তারা সুদ পাবেন কিছুটা কম।
এক্ষেত্রে কম ও বেশির সীমাও নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে সাত লাখ টাকা। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্রে কারো বিনিয়োগ যদি সাড়ে সাত লাখ টাকার কম হয় তাহলে সে তুলনামূলকভাবে বেশি সুদহার পাবে।
আর সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সুদহার পাবেন তুলনামূলক কিছুটা কম।
বর্তমানে জাতীয় সঞ্চয়পত্রের অধীনে যে সব সঞ্চয়পত্র রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় পরিবার সঞ্চয়পত্র। এই সঞ্চয়পত্রে এতদিন সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফার হার ছিল সাড়ে ১২ শতাংশ। এখন তা কমে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ হচ্ছে।
আর সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে এই মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সেটি কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
অন্যদিকে, পাঁচ বছর মেয়াদী পেনশন সঞ্চয়পত্রে সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মেয়াদ পূর্তিতে মুনাফা ছিল ১২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। পহেলা জুলাই থেকে তা করা হয়েছে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
সাড়ে সাত লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ, এখন থেকে তা হবে ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।
একই ভাবে অন্যান্য সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রেও চলতি অর্থবছর থেকে সুদহার কমানো হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, “যারা চলতি অর্থ বছর থেকে নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনবেন তাদের ক্ষেত্রে এই সুদহার কার্যকর হবে। এছাড়া মেয়াদ ফুরালে নতুন পুনঃবিনিয়োগ করতে গেলে নতুন এই সুদহার কার্যকর হবে”।
সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমেছে
কী প্রভাব পড়বে?
দেশে সঞ্চয় অধিদপ্তরের অধীন যেসব সঞ্চয়পত্র রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল পরিবার সঞ্চয়পত্র। পাঁচ বছর মেয়াদী এ সঞ্চয়পত্রে এত দিন সাড়ে ৭ লাখ টাকার কম বিনিয়োগে মুনাফার হার ছিল ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
মুন্সিগঞ্জের মো. আহসান উল্লাহ সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন গত কয়েক বছর আগে। অবসরের টাকা দিয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।
এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফা দিয়ে যে আয় হয় সেই টাকা দিয়েই তার পুরো পরিবারে খরচ মেটাতে হয়।
সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে মি. আহসানউল্লাহ বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এখনো তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না মেয়াদ শেষে সঞ্চয়পত্রে যখন পুনঃবিনিয়োগ করবেন তখন তার যে আয় হবে সেটি দিয়ে পরিবারের খরচ মিটবে কি-না।
যারা সঞ্চয়পত্রকে একটি নিরাপদ বিনিয়োগ ও মাসিক আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন, বিশেষ করে অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী, গৃহবধূ, প্রবাসী পরিবারের সদস্যসহ মধ্যবিত্ত শ্রেণির অনেকেই বেশ চাপের মুখে পড়তে পারেন বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
কিশোরগঞ্জের স্কুল শিক্ষক এবিএম শফিউল্লাহ কিংবা মুন্সিগঞ্জের আহসানউল্লাহর মতো বাংলাদেশের অনেক পরিবার তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্তভাবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন।
মি. শফিউল্লাহ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ”এমনিতেই মূল্যস্ফীতির ফলে দিন দিন সংসার খরচ বাড়ছিল। তার ওপর সুদহার কমানোয় যে ঘাটতি তার তৈরি হবে সেটি পুষিয়ে নেয়ার মত কোন উপার্জনের পথ তার নেই। যেটি তাকে অনেকটা দুশ্চিন্তায় ফেলেছে।
যে কারণে পেনশনভোগী মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য এটিকে একটি আর্থিক ধাক্কা হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যারা মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত, পেনশনের টাকা পেয়ে সঞ্চয়পত্র কিনেন সেখান থেকে নিয়মিত সুদ পেয়ে সেটা দিয়ে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন, তারা সরকারের নতুন এই সিদ্ধান্তে সরাসরি প্রভাবিত হবেন”।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হলে সামাজিক নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন শঙ্কার কথা চিন্তা করে বিকল্প কোনো ব্যবস্থারও পরামর্শ দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ
আইএমএফ’র শর্তই কী মূল কারণ?
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে যেসব শর্ত দিয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানো এবং এর সুদহার নির্ধারণে বাজারভিত্তিক ফর্মুলা অনুসরণ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সুদহার কমাতে সরকারের এ সিদ্ধান্তের পেছনে প্রধান অনুঘটক আইএমএফ ঋণচুক্তির শর্ত।
অধ্যাপক এম এম আকাশ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”আইএমএফ-বিশ্ব ব্যাংক এরা বাজার মৌলবাদী। তারা বাজারের বাইরের কিছু বোঝেন না। শুধুমাত্র তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই সুদহার কমানো হয়েছে।”
যদিও শনিবার বাহ্মণবাড়িয়ায় এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বাড়িয়ে দিলে সবাই সঞ্চয়পত্র কিনবে, তখন কেউ আর ব্যাংকে টাকা রাখবে না।
সেখানে তিনি বলেছেন, “ব্যাংকগুলোতে তারল্য একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ব্যালেন্স করে দেখতে হবে। সবাই সঞ্চয়পত্র কিনলে ব্যাংক কোথায় টাকা পাবে”।
সরকারের ভাষ্য, তারা ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকটের কথা মাথায় রেখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
নিরাপদ বিনিয়োগ ও বেশিরভাগ বাণিজ্যিক ব্যাংকের তুলনায় সুদের হার বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ ব্যাংকে টাকা জমার পরিবর্তে সঞ্চয়পত্রের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সরকারকেও প্রতি বছর এই খাতে বিপুল পরিমাণ সুদ পরিশোধ করতে হয়।
গত এপ্রিল পর্যন্ত সঞ্চয়পত্রে সরকারের ঋণস্থিতি ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকারের এই খাত থেকে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। গত অর্থবছরে এই পরিমাণ ছিল ১৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে এসব সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে বিপুল অংকের মুনাফা পরিশোধ করতে হয়।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বাংলাদেশকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দেওয়ার সময় যেসব শর্ত দিয়েছিল, তার ম্যধে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানোর মতো শর্ত ছিল।
যদিও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, আইএমএফ বাংলাদেশের সংস্কার কর্মসূচিতে সহায়তা করছে। সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানো সেটারই একটা অংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে না পেরে তারা সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমিয়ে এই ঘাটতি মেটানোর চেষ্টা করছে।
মি. হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার যেখানে রাজস্ব বাড়াতে পারছেন না, সেখানে সুদের হার যদি বাড়তি হয় তাহলে এক পর্যায়ে বেতন দিতে গেলেও তো ঋণ করতে হবে। যে কারণে তারা নজর দিয়েছে সুদহার কমানোর দিকে”।
বিবিসি নিউজ বাংলা