বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বাতাস বর্তমানে সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের পার্থক্য ক্রমশ বাড়ছে। এর প্রভাবে আগামী সাত দিন রাজধানী থেকে উপকূল—সবখানে ঘন ঘন মাঝারি থেকে অতি ভারী বর্ষণ হতে পারে। উপকূলের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পায়রা ও মংলা—সব কটি সমুদ্রবন্দরেই ‘স্থানীয় সতর্কতা সংকেত নম্বর ৩’ বহাল রয়েছে। অর্থাৎ সামুদ্রিক এলাকায় ঝোড়ো হাওয়া ও উঁচু ঢেউ যে কোনো সময় শুরু হতে পারে।
ঢাকায় কী অপেক্ষা করছে?
রাজধানীতে প্রতিদিনই কখনও সকাল, কখনও রাতভর বৃষ্টি নামার সম্ভাবনা রয়েছে। দিনের তাপমাত্রা ৩০ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে থাকবে, আর্দ্রতা প্রায় আশি শতাংশ—ফলে অস্বস্তিকর আবহ টের পাওয়া যাবে। হঠাৎ বৃষ্টিতে নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে মিরপুর, পূর্ব রাজাবাজার, শ্যামপুর ও পুরান ঢাকার বেশ ক’টি এলাকা কয়েক ঘণ্টার জন্য পানির নিচে চলে যেতে পারে। জমে থাকা পানিতে মশার লার্ভা দ্রুত বেড়ে ওঠে; তাই ডেঙ্গুর ঝুঁকি মোকাবিলায় সিটি করপোরেশনকে ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়ার পাশাপাশি বাড়িঘরের চাল, ছাদ ও ফুলদানি পরিষ্কার রাখার অনুরোধ জানিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বন্দর এলাকায় সম্ভাব্য পরিস্থিতি
- চট্টগ্রাম বন্দর: টানা ভারী বর্ষণে পাহাড়ি ঢালে ধসের আশঙ্কা থাকে, আবার টার্মিনালে জমে থাকা পানি কন্টেইনার খালাসকে ধীর করে দিতে পারে। প্রয়োজনে বহির্নোঙরে পণ্য ওঠানামা সাময়িক স্থগিত রাখতে হবে।
- মংলা ও পায়রা: দক্ষিণ-পশ্চিম দমকা হাওয়ার কারণে জেটিতে ভেঙে পড়া ঢেউ জাহাজ বাঁধার দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে। ছোট নৌকা ও মাছ ধরার ট্রলারকে কাছাকাছি নদীপাড়ে আশ্রয় নিতে বলা হয়েছে।
- কক্সবাজার: সমুদ্রের ঢেউ স্বাভাবিকের চেয়ে উঁচু হবে। তাই পর্যটক-বাহী ট্রলার ও স্পিডবোট চলাচল আপাতত বন্ধ রাখার সুপারিশ।
কতটা বৃষ্টি কোথায়
আগামী সাত দিনে ঢাকায় প্রায় ৮০ থেকে ১৪০ মিলিমিটার বৃষ্টি হতে পারে। চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড়ি এলাকায় এই মাত্রা ১২০ থেকে ২২০ মিলিমিটারে পৌঁছাতে পারে, যা অতিভারী বর্ষণের সীমা ছুঁয়ে যায়। খুলনা-বরিশাল উপকূলে ১০০ থেকে ১৮০ মিলিমিটার বৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়েছে। ফলে পানির চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নদীর তীর ভাঙন, নিম্নাঞ্চল প্লাবন এবং সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হতে পারে।
পাহাড়ি জেলায় ভূমিধসের ঝুঁকি
চট্টগ্রাম, বান্দরবান ও রাঙামাটির ঢালে যদি এক-দু’ দিনে একশ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টি হয়, মাটি সিক্ত হয়ে দুর্বল জায়গায় ধস নামার সম্ভাবনা তীব্র হবে। স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি খালি করার নোটিশ দিয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত পরিবারকে অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে সরে যেতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
নদী ও বন্যা পরিস্থিতি
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা–কুশিয়ারা নদীর পানি দ্রুত বাড়তে পারে। বিশেষ করে সিলেট অঞ্চলে কয়েকটি পয়েন্ট বিপদসীমার কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে। তাই কৃষকদের এখনই ধান ও সবজিক্ষেতের অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
প্রস্তুতি ও করণীয়
১. নালা-নর্দমা পরিষ্কার রাখুন—বৃষ্টির আগে ড্রেজিং ও কাঠ-প্লাস্টিক অপসারণ জরুরি।
২. বন্দরে বালুর বস্তা ও পানি উৎক্ষেপণ যন্ত্র প্রস্তুত—জেটির জমা পানি দ্রুত সরাতে উচ্চক্ষমতার যন্ত্র লাগাতে হবে।
৩. বিদ্যুতের ঝুঁকি কমান—ঝুলন্ত তার ও খোলা বৈদ্যুতিক সংযোগ অবিলম্বে সারিয়ে নিন।
৪. স্বাস্থ্য-সতর্কতা—বর্ষাকালে জমা পানিতে হাঁটা এড়িয়ে চলুন; তিন দিনে একবার ফুলদানির পানি বদলান।
৫. সর্বশেষ খবর রাখুন—আবহাওয়া অধিদপ্তরের বুলেটিন ও স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশিকা নিয়মিত শুনুন। জরুরিতে ১০৯০ নম্বরে ফোন করুন।
জলাভূমি-বহুল এই দেশে বর্ষা আশীর্বাদও, আবার অল্প সময়ে দুর্ভোগের কারণও হতে পারে। রাজধানী ঢাকার জলাবদ্ধতা, বন্দর এলাকার কর্মঘণ্টা ও পাহাড়ি জেলায় ভূমিধস—সবই নির্ভর করবে কতটা আগে থেকে প্রস্তুতি নেয়া হবে তার ওপর। তাই নাগরিক-প্রশাসন-বন্দর কর্তৃপক্ষ সবাইকে এখনই সমন্বিত উদ্যোগে ঝুঁকি কমাতে হবে, যাতে বছরের এই ভেজা সপ্তাহ ক্ষতির বদলে উপকারই বয়ে আনে।