আর্জেন্টিনার জাতীয় জেনেটিক ডেটা ব্যাংক (Banco Nacional de Datos Genéticos — বিএনডিজি) গত চার দশক ধরে হারিয়ে যাওয়া শত শত শিশুর প্রকৃত পরিচয় ফিরিয়ে দিতে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আর মানবিক ন্যায়বিচার রক্ষা করে এসেছে। সামরিক শাসনের সময় চুরি হওয়া এসব শিশু আজ প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি বয়সে পৌঁছেছে। নতুন সরকারী বাজেটে ব্যাপক কাটছাঁট এবং জেনেটিক ব্যাংক পুনর্গঠনের ঘোষণা এই অমূল্য প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
স্বৈরশাসন ও শিশুচুরির ইতিহাস
১৯৭৬ সালের ২৪ মার্চ আর্জেন্টিনায় সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রায় আট বছর ধরে সামরিক জান্তা ৩০ হাজারের বেশি নাগরিককে গুম করে। তাদের মধ্যে ৩৫৮ জন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা নারী। গোপন বন্দিশিবিরে তাদেরকে সন্তান প্রসব করিয়ে নবজাতকদের সামরিক ও পুলিশের পরিবারে দিয়ে দেওয়া হয়; অনেক শিশু আবার বাবা–মা-সহ গ্রেপ্তারের পর অন্য পরিবারে পালকত্ব পায়। এসব শিশুর জন্মসনদ ভুয়া নামে তৈরি করে প্রকৃত রক্তসম্পর্ক মুছে ফেলা হয়।
দাদিমাদের সংগঠন: আবুয়েলাস দে প্লাসা দে মায়ো
নিখোঁজ সন্তান ও নাতিদের খোঁজে দাদিমারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায় নামেন। প্রেসিডেনসিয়াল প্রাসাদের সামনে প্লাসা দে মায়ো চত্বরে সাপ্তাহিক প্রতিবাদ থেকে তাদের সংগঠনের নাম হয় ‘আবুয়েলাস দে প্লাসা দে মায়ো’। তারা গির্জা, আদালত, প্রসূতিবাহীনি—যে কোথাও আশা পেয়েছেন, ছুটে গেছেন। গোপনে শিশুর সন্ধান করতে কেউ আবার সেবিকা বা গৃহকর্মীর ছদ্মবেশেও ঢুকে পড়েছেন।
জেনেটিক বিপ্লব: বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করা
ডিএনএ বিশ্লেষণ তখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের জেনেটিকবিদ ম্যারি-ক্লেয়ার কিং দাদিমাদের সঙ্গে হাত মেলান। তিনি ‘ইন্ডেক্স অব গ্র্যান্ডপ্যাটার্নিটি’ নামের গাণিতিক পদ্ধতি তৈরি করেন, যা বাবা-মা না থাকলেও নাতির সঙ্গে দাদা-দাদির রক্তসম্পর্ক শনাক্ত করে। পরে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ পরীক্ষাসহ আধুনিক পদ্ধতি যুক্ত হয়। ১৯৮৭ সালে দাদিমাদের দাবিতে সরকার বিএনডিজি গঠন করে, যেখানে তাদের রক্তের নমুনা আজও সংরক্ষিত। এটি বিশ্বের প্রথম জাতীয় জেনেটিক বায়োবাংল।
পরিচয় ফিরে পাওয়া একটি জীবন্ত উদাহরণ
২০২৩ সালের এপ্রিলে ৪৬ বছরের ড্যানিয়েল এনরিকে গনসালেস ব্যাংকে রক্ত দেন। কয়েক মাস পরে তাকে জানানো হয়, তিনি আসলে ‘ড্যানিয়েল সান্তুচো নাভাখাস’—মা ক্রিস্তিনা সিলভিয়া নাভাখাস ১৯৭৬-এর জুলাইয়ে গুম হয়েছিলেন, বাবা হুলিও সেসার দে এসুস সান্তুচো তখন দেশ ছেড়ে পালিয়ে প্রাণে বেঁচে যান। দাদিমা নেলিদা নাভাখাস জীবদ্দশায় প্রতি জন্মদিনেই অনাগত নাতির জন্য কেক বানিয়েছিলেন। ড্যানিয়েল ছিলেন দাদিমাদের খুঁজে পাওয়া ১৩৩-তম নাতি। আজ পর্যন্ত মোট ১৩৯ জন নাতি-নাতনি নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ফিরে পেয়েছেন।
বর্তমান সংকট: প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেইয়ের সিদ্ধান্ত
অস্বাভাবিক খ্যাতির অধিকারী, ‘চেইন-স’ লক্তোর নীতি ঘোষণা করা লিবার্টেরিয়ান প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই সরকারি ব্যয় কমানোর নামে বিএনডিজি পুনর্গঠনের ডিক্রি জারি করেছেন। আগে থেকেই তিনি সামরিক শাসনের ইতিহাস ‘ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধ’ বলে পুনর্লিখনের চেষ্টা করেছেন। তদন্তকারী সরকারি দফতর বাতিল ও দাদিমাদের সহায়তা তহবিল বন্ধ হওয়ার পর এবার জেনেটিক ব্যাংকের কাঠামো পরিবর্তনের উদ্যোগে দাদিমারা একে ‘আটকে নেওয়া’ বলে আশঙ্কা করছেন। আদালতে তারা ডিক্রি বাতিলের আবেদন জানিয়েছেন; আপাতত যে কোনো পরিবর্তনের আগে বিচারিক অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বাজেট সংকোচন ও পরিচালনার অনিশ্চয়তা
দেশে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও ২০২৩ সালের পর নতুন বাজেট পাস হয়নি। ফলে ব্যাংকের ক্রয়ক্ষমতা কমছে, পরীক্ষার কিট থেকে শুরু করে কর্মীর বেতন—সবই টানাটানিতে পড়েছে। পরিচালকের মেয়াদ শেষ হলেও নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি; ডা. মারিয়ানা হেরেরা পিনিয়েরা আপাতত দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যাংকে আজও ১৮০টি পরিবারের জেনেটিক তথ্য সংরক্ষিত, যারা প্রিয়জনের খোঁজে অপেক্ষায় আছেন।
সময়ের বিরুদ্ধে দৌড়
বর্তমান জীবিত দাদিমাদের বয়স ৮৭ থেকে ১০৫ বছর। বহু দাদি নাতিকে দেখার আগেই পরপারে পাড়ি দিয়েছেন। গুম হওয়া অবশিষ্ট নাতি-নাতনিরা এখন ৫০ ছুঁইছুঁই; তাদের জীবদ্দশায় পরিচয় ফেরানো না গেলে ইতিহাসের এই বিচার অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
দাদিমাদের অবিস্মরণীয় সাহস ও বিজ্ঞানভিত্তিক লড়াই আর্জেন্টিনাকে তার অন্ধকার অতীতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। প্রতিটি চুরি হওয়া পরিচয় উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত সেই অতীত মধ্যবর্তি হবে না, বর্তমানকে তাড়িয়ে বেড়াবে। জেনেটিক ডেটা ব্যাংককে স্থবির করে দেওয়া মানে শুধু সম্ভাব্য পারিবারিক মিলনের দ্বার বন্ধ করা নয়, বরং জাতির পূর্ণ নিরাময়ের পথও রুদ্ধ করা। অতএব, বিজ্ঞান ও মানবাধিকারের এই যৌথ অনুসন্ধান থামিয়ে দেওয়া কারও জন্যই সুফল ডেকে আনবে না—না আর্জেন্টিনার, না বিশ্বসমাজের।