যখন ঘরে বড়জোর দশ কিংবা কুড়ি জন অতিথির জন্য উৎসবের খাবার রান্না করতে গিয়েই ঘাম ছুটে যায়, তখন একবার ভাবা যেতে পারে গ্যারি থমাসের কথা। দুপুর একটায় তাঁর রেস্তোরাঁর ডাইনিং হলে নীরবতা, আর সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই সেই জায়গা রূপ নেয় জনসমুদ্রে। পাঁচশ আসনের টেবিল তিনবার ঘোরে, রেস্তোরাঁর আরও দুটি তলা যোগ হয়। মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ছয় হাজার মানুষ সেখানে খাবার খান। এটিই শেষ নয়। তাঁর তত্ত্বাবধানে রয়েছে আরও পঁচিশটি রেস্তোরাঁ। দিনের শেষে তাঁর অধীনে কাজ করা তিনশ চুয়াল্লিশ জন রাঁধুনি এবং সতেরশো সার্ভিস কর্মী মিলে এক লাখ খাবার প্রস্তুত, পরিবেশন ও পরিষ্কার করেন। সবকিছুই ঘটে ক্যারিবীয় সাগরের নীল জলে ভাসমান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ক্রুজ জাহাজে।
প্রায় সতেরো বছর ধরে ক্রুজ জাহাজে কাজ করছেন গ্যারি থমাস। এখন তিনি বিশ্বের অন্যতম বড় ক্রুজ কোম্পানির খাবার ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে। উনত্রিশটি জাহাজ আর দুটি ব্যক্তিগত দ্বীপে ছড়িয়ে থাকা হাজারো রন্ধনকর্মী তাঁর অধীনে কাজ করেন। প্রতিটি নতুন জাহাজ আগের চেয়ে বড়। বর্তমান জাহাজটিতে একসঙ্গে প্রায় সাত হাজার ছয়শ যাত্রী ও দুই হাজারের বেশি নাবিক থাকতে পারেন। এটি এতটাই দীর্ঘ যে উচ্চতায় আইফেল টাওয়ারের চেয়েও লম্বা। বিশটির বেশি ডেক, একাধিক সুইমিং পুল, বরফের রিঙ্ক আর সমুদ্রে সবচেয়ে বড় জলক্রীড়া পার্ক রয়েছে এতে। প্রযুক্তিগতভাবে আধুনিক জ্বালানিতে চললেও, যাত্রীদের সন্তুষ্ট রাখার আসল শক্তি আসে এই বিপুল খাবার উৎপাদন থেকেই।
এটি কোনো বিমান নয়, যেখানে আগে রান্না করা খাবার গরম করা হয়। এখানে মাংস কাটা, মাছ ফিলে করা, রুটি বেক করা, আলু ভাজা, ডিম ভাজা—সবই ঢেউয়ের ওপর দুলতে থাকা জাহাজে। গ্যারি থমাস হাসতে হাসতে বলেন, শুধু জীবন্ত গরুর খামারটাই নেই। এই বিশাল ব্যবস্থাপনায় দরকার নিখুঁত প্রস্তুতি, খুঁটিনাটির দিকে তীক্ষ্ণ নজর আর কঠোর শৃঙ্খলা।

এই শৃঙ্খলার শিকড় উনিশ শতকের ফ্রান্সে। আধুনিক রেস্তোরাঁ রান্নাঘরের জনক অগুস্ত এসকোফিয়ের রান্নাঘরে সামরিক শৃঙ্খলা এনেছিলেন। তাঁর আগে রান্নাঘর ছিল বিশৃঙ্খল ও কোলাহলপূর্ণ। সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি কাজের বিভাজন, দায়িত্ব বণ্টন ও নীরবতা আরোপ করেন। প্রতিটি খাবারের উপাদানের জন্য আলাদা রাঁধুনি দায়িত্ব নেন, শেষে একজন জ্যেষ্ঠ রাঁধুনি প্লেট সাজান। আজও এই নীতিতেই চলে ক্রুজ জাহাজের রান্নাঘর।
ভোর ছয়টায় যাত্রীরা ঘুমিয়ে থাকলেও নিচের ডেকগুলোয় ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ইনভেন্টরি ব্যবস্থাপক র্যান্ডি নিকোলাসের হাত ধরেই সবকিছুর সূচনা। জাহাজের দীর্ঘ করিডরজুড়ে তাঁর তত্ত্বাবধানে থাকে পঁচিশ হাজারের বেশি সামগ্রী, যার মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার লবস্টার আর শত শত টন পানির বোতল। এক সপ্তাহের খাবারের খরচই কয়েক মিলিয়ন ডলার ছুঁয়ে যায়। প্রতিদিন কয়েক হাজার কেজি প্রোটিন রান্না হয়, বিশাল ফ্রিজ আর ফ্রিজারে তা সংরক্ষিত থাকে। সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার, কারণ সামান্য স্বাস্থ্যঝুঁকিও একটি পুরো ভ্রমণ ধ্বংস করে দিতে পারে।
কোন যাত্রায় কত খাবার লাগবে, তা নির্ধারণে ব্যবহার হয় উন্নত সফটওয়্যার। যাত্রীদের বয়স, অঞ্চল, খাদ্যাভ্যাস সবকিছু বিশ্লেষণ করে আগাম হিসাব করা হয়। শিশু বেশি হলে আলু ভাজা আর বার্গারের পরিমাণ বাড়ে, কেউ কেউ চান নিরামিষ বা বিশেষ খাদ্য। এই নিখুঁত হিসাবের পেছনে কারণ একটাই, অপচয় কমানো। তবু উন্মুক্ত বুফেতে কিছু খাবার নষ্ট হয়ই। নির্দিষ্ট সময় পার হলে স্বাস্থ্যবিধির কারণে তা ফেলে দিতে হয়, কিছু সমুদ্রে যায়, কিছু পোড়ানো হয়, এমনকি সেই বর্জ্য থেকেই জ্বালানি তৈরি হয়।
ভোরে জাহাজ যখন নিজস্ব দ্বীপে ভেড়ে, তখনই শুরু হয় খাবার নামানো আর তোলার কাজ। সময়ের এক মুহূর্ত দেরি মানেই পুরো যাত্রাপথে সমস্যা। রাঁধুনি ও কর্মীরা টানা সাত দিন, মাসের পর মাস কাজ করেন। অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশের মানুষ, যাঁরা যাত্রীদের মতো বিলাসিতা পান না। দ্বীপে খাবার পরিবেশনের আগের রাতেই সব প্রস্তুত করতে হয়, তাই তাঁদের পরিশ্রম আরও বেড়ে যায়।
সন্ধ্যায় যাত্রীরা যখন রঙিন বুফেতে ভিড় করেন, তরমুজে খোদাই করা ফুল আর একসঙ্গে গ্রিলে ভাজা স্টেক দেখে মুগ্ধ হন, তখন তাঁদের অনেকেই জানেন না এর পেছনের অমানুষিক শ্রমের কথা। সেই শ্রমের স্বীকৃতি হয় একটিমাত্র বিষয়ে, খাবারটি যখন সত্যিই সুস্বাদু লাগে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















