ছবির পরিচিতি ও প্রেক্ষাপট
সত্যজিৎ রায়ের নির্মিত গণশত্রু (১৯৮৯) তাঁর ক্যারিয়ারের শেষদিকের একটি চলচ্চিত্র, যা হেনরিক ইবসেনের ক্লাসিক নাটক An Enemy of the People অবলম্বনে নির্মিত। যদিও এর মূল কাঠামো পাশ্চাত্য নাট্যধারার, সত্যজিৎ রায় এটিকে ভারতীয় সমাজের বাস্তবতার সঙ্গে চমৎকারভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন। সিনেমাটি বাংলা ভাষায় নির্মিত হলেও এর বার্তা বিশ্বজনীন—সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো মানে কেবল ব্যক্তিগত বিপদের মুখোমুখি হওয়া নয়, বরং গোটা সমাজের মনন ও বিবেকের সংঘর্ষে অংশ নেওয়া।
মূল চরিত্র ও কাহিনির গঠন
চলচ্চিত্রটির কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেন ডা. অশোক গুপ্ত (অভিনয়: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়)—একজন সৎ ও আদর্শবাদী চিকিৎসক। তিনি একটি শহরের মন্দির পরিচালিত জল প্রকল্পে ব্যাকটেরিয়াল দূষণ খুঁজে পান এবং সতর্কতা জারি করেন। কিন্তু সমস্যার সূত্রপাত তখনই, যখন জানা যায় এই পবিত্র মন্দির এবং তার জলই শহরের প্রধান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চালিকাশক্তি। সত্য প্রকাশ করার চেষ্টায় ডা. গুপ্ত নিজেই পরিণত হন “গণশত্রু”-তে—একজন শত্রু, যিনি নাকি সমাজ ও ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
‘গণশত্রু‘ কে?
এই সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন: কে আসলে “গণশত্রু”? বাহ্যিকভাবে ডা. অশোক গুপ্তকে সমাজ ও মিডিয়া “গণশত্রু” হিসেবে চিত্রিত করে, কারণ তিনি ধর্মীয় কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বৈজ্ঞানিক সত্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু সত্যজিৎ রায় এই শব্দটির ভেতরে এক গভীর ব্যঙ্গ ও প্রতিবাদ ঢুকিয়ে দেন—বাস্তবিক “গণশত্রু” হল সেই ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ, দুর্নীতিগ্রস্ত মন্দির কর্তৃপক্ষ, দালাল সংবাদমাধ্যম এবং অন্ধবিশ্বাসে আচ্ছন্ন এক বিশাল জনসমষ্টি—যারা মিলে এক সত্যান্বেষীকে স্তব্ধ করতে চায়।
সমাজ ও ধর্মের সংঘর্ষ
চলচ্চিত্রটি ধর্মের অপব্যবহার ও অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে বিজ্ঞান ও মানবিক মূল্যবোধের অবস্থানকে তুলে ধরে। এটি প্রশ্ন তোলে—একটি শহরের অর্থনীতি যদি একটি পবিত্র মন্দিরের ওপর নির্ভরশীল হয়, এবং সেই মন্দির যদি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, তবে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ: জনস্বাস্থ্য না পবিত্রতা?
এই দ্বন্দ্বে সত্যজিৎ রায় স্পষ্ট বার্তা দেন—একটি সমাজ যদি বিবেক ও যুক্তিকে উপেক্ষা করে অন্ধ বিশ্বাসে বন্দী হয়ে পড়ে, তবে তা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।
মিডিয়া ও জনমতের ভূমিকা
সিনেমাটিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংবাদপত্র সম্পাদকদের মধ্যে কেউ কেউ ডা. গুপ্তকে সমর্থন করতে চাইলেও অধিকাংশই ক্ষমতাসীনদের চাপের মুখে মুখ বন্ধ করে থাকেন। এটি বাস্তব সমাজে গণমাধ্যমের দুর্বলতা এবং নিয়ন্ত্রণাধীন অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে।
তবে ডা. গুপ্তকে কিছু তরুণ, কিছু সচেতন মানুষ এবং তার পরিবারের একজন সদস্য যখন সমর্থন করে, তখন দেখা যায় যে আশার আলো নিভে যায়নি। রায় এই সিনেমার মাধ্যমে দেখান, তরুণদের মধ্যেই পরিবর্তনের বীজ রয়েছে।
বার্তাটি কী?
গণশত্রু কোনো নিছক রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নয়, বরং এটি নৈতিক সাহস, স্বাধীন মত প্রকাশ, বিজ্ঞানচেতনা এবং ন্যায়বোধের পক্ষের এক সাহসী কণ্ঠস্বর। সত্যজিৎ রায় এই সিনেমার মাধ্যমে সমাজকে বলছেন—যে সমাজ সত্যভাষীকে শত্রু মনে করে, সে সমাজ নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। একইসঙ্গে তিনি অনুপ্রাণিত করেন আমাদের—সত্যের পথে একা হলেও চলতে হবে, কারণ সেই পথেই ভবিষ্যতের মুক্তি।
মানুষ চুপ থাকলে মানুষ মারা যায়
সত্যজিৎ রায়ের গণশত্রু এক নিরবিচারে সময়োপযোগী ও সাহসী চলচ্চিত্র, যা আজকের সমাজেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। অন্ধবিশ্বাস, দুর্নীতি, ধর্মীয় ব্যবসা এবং মতপ্রকাশের দমন—এসবের বিরুদ্ধে সত্যের দীপ্ত উচ্চারণ হিসেবে রায়ের এই সৃষ্টি বাংলা চলচ্চিত্রে এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে।
এ ছবির শেষ দৃশ্য যেন আমাদের চেতনায় অনুরণন তোলে—“মানুষ যদি চুপ করে থাকে, তাহলে সত্য মরে যাবে।”
এটাই ছিল সত্যজিৎ রায়ের বার্তা—সত্যকে রক্ষা করতে হলে, তাকে প্রকাশ করতেই হবে—যত বড় বিপদই আসুক না কেন।