তারেক রহমান ও ইউনূসের বৈঠকের পরে একটি লেখায় লিখেছিলাম এই বৈঠকের ফল সময় বলে দেবে। ওই সময়ে শুধু বলেছিলাম, “হাতে রইল পেন্সিল”। ঠিক তেমনিভাবে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের মূল কারিগর কারা সেটাও সময় বলে দেবে। এখনও বলার বা বোঝার সময় আসেনি। তবে এটা সত্য, শেখ হাসিনার সরকারের বিপরীতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে গেছে দেশের বড় বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি। এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে ফেসবুক স্ক্যাম বাদ দিয়ে প্রকৃত জনমত যতটুকু গড়ে উঠেছিল সেটা গড়ে তুলেছিল বিএনপি। ফেসবুক স্ক্যাম যে ক্ষণস্থায়ী বিষয় তা বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা- বিশিষ্ট ভদ্রলোক ও শিক্ষাবিদ খান সরওয়ার মুরশীদের কন্যা শারমীন মুরশিদ পরোক্ষভাবে বলেছেন। পিতা ও মাতার ঐতিহ্য ও অবস্থান বিচারে এই সরকারে তার যাবার কথা নয়—হয়তো দীর্ঘদিন ধরে এনজিও করার ফলে রূপান্তরিত মানুষ হিসেবে তিনি এ সরকারে। তিনি দুই দিন আগে বলেছেন, জুলাইয়ের নারীদেরকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কেন ঘরে লুকালো? তাদেরকে খুঁজে বের করার জন্য একশ মানুষ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শারমীন মুরশিদের এই বক্তব্যের ভেতর লুকিয়ে আছে ফেসবুক স্ক্যামের একটা ফসলের উদাহরণ।
তাই সত্যি অর্থে মেটিকুলাস ডিজাইনের বাইরে শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে যে জনমত গড়ে উঠেছিল তা মূলত বিএনপি ও অন্যান্য মধ্যপন্থী ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোই তৈরি করেছিল। আর এ হিসেবে আওয়ামী লীগের সমকক্ষ দল যেহেতু বিএনপি ছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেই—তাই মূল ভূমিকা তাদেরই। এবং বিএনপির অবর্তমানে দেশ কোথায় যাবে সেটা শেখ হাসিনাও বুঝতেন।
সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু যা তথ্য সত্য ওই সময়ে পেয়েছি ও দেখেছি তাতে দেখেছি, বিএনপির প্রতি চরম নির্যাতন হয়েছে ওই সময়ে। তবে এ সত্য বলতে হবে, কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতাচ্যুত হলে ওই দলকে সত্য মিথ্যা মামলা ও সরকারি প্রশাসন কাজে লাগিয়ে নির্যাতন বড় আকারে শুরু হয় এরশাদ পতনের পর থেকে। এরশাদ ওই সময়ে তার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত তিন জোটের সঙ্গে বিদেশি মাধ্যম ও দেশি মাধ্যমে আলোচনা করেই পদত্যাগ করেছিলেন। সেখানে তিন জোটের পক্ষ থেকে কথা দেওয়া হয়েছিল, তাকে অবাধে রাজনীতি ও ভোটে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে। কিন্তু সে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এরশাদকে জেলে নেওয়া হয়। কেন তাকে জেলে নেওয়া হয়, রাজনীতির এ বিষয়গুলো এখনও এ দেশে লেখার সময় আসেনি। তবে শুধু এরশাদকে জেলে নেওয়া হয়নি, তার দলের স্থানীয় নেতাদেরকেও নির্বাচন করার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ দেওয়া হয়নি। স্থানীয়ভাবে আন্দোলনে বিজয়ী দলের নেতারা নানাভাবে তাদেরকে নিগৃহীত করে। প্রশাসনকে সে কাজ করতে বাধ্য করে।
এরশাদের কথাটুকু উল্লেখ করলাম এ কারণে, শুধু এরশাদের বিচার নয় স্থানীয় পর্যায়ে তার দলের নেতাদের ওপর নির্যাতন করেছিল বিজয়ী স্থানীয় নেতারা, পরবর্তী সরকারি দলের স্থানীয় নেতারা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য পেশী শক্তিতে নির্বাচন জেতা, জনগণের মন জয় করে নয়।
শেখ হাসিনার আমলে তার দলের স্থানীয় নেতারা নির্বাচন করতে ভুলে গিয়েছিল সেকথা আগের একটা লেখায় উল্লেখ করেছি। তারাই স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপি নেতা কর্মীদের ওপর অত্যাচার ও তাদের অনেককে এলাকাছাড়া করে।
আগেই উল্লেখ করেছি, বিএনপির অবর্তমানে দেশের অবস্থা কী হবে সেটা শেখ হাসিনাও বুঝতেন। বিএনপি নেতা জিয়াউর রহমান সম্পর্কে শেখ হাসিনা যে ন্যারেটিভ তার কর্মীদের সামনে দাঁড় করাতেন, সেটা তিনি কেন করতেন তা রাজনীতিবিদরাই ভালো বুঝবেন, আমাদের মতো সাধারণ সাংবাদিকদের পক্ষে সবটুকু বোঝা সম্ভব নয়। তবে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে জিয়াউর রহমান ও জিয়াউল হকের মধ্যে যে আলোচনা হয়—তা নিয়ে পাকিস্তানি এক আমলার একটা বই পড়ে জানতে পারি, জিয়াউর রহমান কীভাবে তার পজিশনে দৃঢ় ছিলেন জিয়াউল হকের সামনে—পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা আদায় ও আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে শতভাগ মিলে যায়।
জিয়াউর রহমানের এই অবস্থান আবার তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের এই অবস্থান—বিষয়টা ঠিক বুঝতে না পেরে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে প্রশ্ন করেছিলাম, আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, রাজনীতিক ও সাংবাদিক শফিকুল আজিজ মুকুল ভাই এর কাছে। মুকুল ভাই তার স্বভাবসুলভ হো হো করে হাসি দিয়ে বললেন, “তুমিও এটা বুঝতে পারলে না। শোন, বাংলাদেশে বা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫৪ এর পরে জিয়াউর রহমানই একমাত্র একটা রাজনৈতিক দল গড়েছে যা আওয়ামী লীগ যদি এক চড় মারে তারাও আরেকটা চড় মারতে পারে। বাদবাকিরা তো সব সময়ই আওয়ামী লীগের কাছে চড় খেয়ে গেছে”।
বুঝতে পারলাম সংঘাত ও ন্যারেটিভ ভোটের রাজনীতির কারণে। অন্য কোনো কারণে নয়। আর ৯১ এর পর থেকে এটা আরও প্রকট হয় যে—এ দুই দলের মূল অর্থনৈতিক কর্মসূচি বা ধারণায় খুব কোনো পার্থক্য ছিল না। দু’দলই মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ তাদের আধা সমাজতান্ত্রিক ও আধা ক্যাপিটালিজমের পথ ছেড়ে আসে।
তাই ২০১৪ ও ২০১৮’র নির্বাচনের পরে যখন অনেক বড় বড় বিএনপি নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিতে রাজি হয় বা যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে—সে সময়ে সাংবাদিক হিসেবে দেখেছি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এ নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু তারা শেখ হাসিনাকে সবার ক্ষেত্রে রাজি করাতে পারতেন না। তখন অনেকটা খোঁজ খবর নিয়ে বুঝতে পারি, শেখ হাসিনা জানেন, বাংলাদেশে আইএস সহ অন্যান্য জঙ্গিরা কীভাবে স্থান করে নিচ্ছে। তার প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী হিমশিম খাচ্ছে তাদেরকে ঠেকাতে। এমনকি ২০১৬তে হোলি আর্টিজানে হামলাকারীরা যে আইএস ছিল এটা শেখ হাসিনা জানা সত্ত্বেও দেশীয় জঙ্গি বলে প্রচার করেন এ কারণে যে- দেশে আইএস আছে এটা প্রচার হলে বিনিয়োগ আসবে না। এছাড়া হয়তো আরও কিছু কারণ থাকতে পারে—যা আমার মতো সাংবাদিকের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
দেশে যেহেতু জঙ্গি প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়ে গেছে। এবং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে তাদের সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে, বিএনপিকে আন্দোলন করার স্বার্থে তাদের একাংশের সঙ্গে আপোস করতে হচ্ছে—এমত অবস্থায়—শেখ হাসিনা বুঝেছিলেন, বিএনপির বড় বড় নেতাদের তাঁর দলে ভিড়িয়ে যদি বিএনপিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়—তাহলে তার বিপরীতে থাকবে শুধু জঙ্গি শক্তি। অর্থাৎ ক্ষমতার বাইরে রাজনীতির মাঠে মধ্যপন্থী রাজনৈতিক শক্তি আর থাকবে না। আর এ ধরনের জঙ্গি ব্রিডিং মাটিতে ক্ষমতার বাইরে শুধু নয়, সবমিলে যদি একাধিক মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দল না থাকে তাহলে কখনই জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। বরং দেশ দ্রুত জঙ্গিদের কবলে চলে যায়।
শেখ হাসিনার পতনের পরে যখনই ঢাকার রাস্তায় জঙ্গিদের মিছিল দেখা গেল সে সময়ে দেশের বড় মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিএনপির রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল- অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ দিয়ে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেশে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু বিএনপি তা না করে ইউনূসের মেটিকুলাস ডিজাইনের ফাঁদে তাদের দলকে তুলে দেয়। এতবার ক্ষমতায় থাকা একটি দলের নেতারা কেন যেন কয়েকজন এনজিও করা মানুষ ও কিছু নামবিহীন রাজনৈতিক দলের কাছে অসহায় পড়ে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, তাদের দাবার ছকের শেষ শক্তি তারেক রহমানকেও এক পর্যায়ে ইউনূসের হাটে তুলে দেয়। কেন তারা এটা করে তা সবটুকু যেমন বোঝা সম্ভব নয়, তেমনি যতটুকু বুঝি বলে মনে হয় তাও সবটুকু লেখা সম্ভব নয়। তবে তারপরেও তারেক রহমান-ইউনূস বৈঠকের পরে লিখেছিলাম—“হাতে রইল পেন্সিল”।
এখন মুহাম্মদ ইউনূসের হাতের পেন্সিল তার উপদেষ্টা রেজওয়ানা হাসানের বক্তব্য অনুযায়ী “সরকারি দল” অর্থাৎ তাদের আরেক “পেন্সিল” এনসিপি বিএনপির ভাগ্য তৈরির জন্য তাদের হাতের পেন্সিল দিয়ে সরকারের পরোক্ষ সমর্থনে কী করছে তা বিএনপি ভালো মতো বুঝতে পারছে।
এখন বিএনপি ও তারেক রহমানের হাতে পেন্সিল বলতে তাদের জনসমর্থন ও জিয়াউর রহমানের উত্তরসূরীদের ওপর আস্থা রাখা। মুহাম্মদ ইউনূস যে খুব শীঘ্র নির্বাচন দেবেন না তা এখন নিশ্চয়ই বিএনপির কাছে স্পষ্ট। বা এর পরে যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে হয়তো সাংবাদিক হিসেবে যতটুকু রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করি সেটা ভুল। বিএনপি হয়তো মনে করতে পারে ইউনূস সাহেবের মাধ্যমে তারা নির্বাচন ও ক্ষমতা পেতে পারে। তবে এ সত্য বিএনপিকে মানতে হবে দেশ সে দিকে যাচ্ছে না। আর বিএনপিকেও সেদিকে যেতে না দিয়ে অন্যভাবে চিত্রিত করা হচ্ছে বা অন্যপথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
তাছাড়া বর্তমান সময়ে দেশ ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের পরের থেকেও অনেক বেশি অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। ওই সময়ে সেনাবাহিনীকে শৃঙ্খলার মধ্যে এনে সেনাবাহিনীর মাধ্যমেই জিয়াউর রহমান দেশকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ফিরিয়ে আনেন। এখন বিএনপি কি বর্তমানে যে ফাঁদে আছে সেখানে থাকবে, না, দেশে যাতে সত্যিই নির্বাচন হয় সে পথে হাঁটবে- সে সিদ্ধান্ত বিএনপির।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.