শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
বাংলাদেশের নাট্যজগতের এক উজ্জ্বল নাম হলেন ডলি জহুর। জন্মেছিলেন চট্টগ্রামে, এক সাংস্কৃতিক অনুরাগী পরিবারে। ছোটবেলা থেকেই গান, আবৃত্তি ও নাটকে তার ঝোঁক ছিল প্রবল। পরিবারের সদস্যরাও সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, যা তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল শিল্পের পথে এগিয়ে যেতে।
ডলি জহুরের একমাত্র সন্তান বর্তমানে বিদেশে বসবাস করেন। যদিও তিনি কখনো গণমাধ্যমে আসেননি, তবে মায়ের সাফল্যে গর্বিত—এ কথা ডলি জহুর একাধিক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন।
নাট্যজগতে পথচলার সূচনা
ডলি জহুরের অভিনয়জীবনের শুরু মঞ্চনাটক দিয়ে। ১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি চট্টগ্রামের নাট্যচর্চায় যুক্ত হন। পরে ১৯৮১ সালে ঢাকায় এসে সক্রিয়ভাবে মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। তার প্রথম আলোচিত মঞ্চনাটক ছিল “দহন”, যা তাকে রাজধানীর নাট্যপ্রেমীদের কাছে পরিচিত করে তোলে।
টেলিভিশনের মাধ্যমে তারকা খ্যাতি
তবে ডলি জহুর সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। ১৯৮০-এর দশকের শুরু থেকে তিনি বিটিভিতে নিয়মিত অভিনয় শুরু করেন।
তার অভিনীত কিছু স্মরণীয় নাটক হলো—
- • আজ রবিবার (রচনা ও পরিচালনা: হুমায়ূন আহমেদ)
- • এইসব দিনরাত্রি
- • কোথাও কেউ নেই
- • সংশপ্তক
- • অয়োময়
ডলি জহুরের অভিনয়ে সংবেদনশীলতা, দৃঢ়তা ও মমত্ববোধ ছিল অপূর্ব। যে চরিত্রেই অভিনয় করেছেন, সেটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। একজন মমতাময়ী মা, কষ্টে লড়াকু নারী, কিংবা শিক্ষিত পরিণত নারীর চরিত্রে তিনি বরাবরই রেখেছেন দুর্দান্ত অভিনয়ের ছাপ।
বৈবাহিক জীবন
ডলি জহুরের স্বামী ছিলেন একজন প্রকৌশলী। তাদের দাম্পত্য জীবন ছিল সৌহার্দ্যপূর্ণ ও সম্মাননাপূর্ণ। তিনি সবসময় স্বামী ও সন্তানের সমর্থন পেয়েছেন, যা তার অভিনয়জীবনকে করেছে সহজ ও প্রাণবন্ত।
চলচ্চিত্রে অবদান: রূপালি পর্দায় এক শক্তিশালী উপস্থিতি
ডলি জহুর শুধুমাত্র টেলিভিশন ও মঞ্চেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না—তিনি চলচ্চিত্রেও রেখেছেন উজ্জ্বল উপস্থিতি। তার অভিনীত প্রথম বাণিজ্যিক ছবি “শঙ্খনীল কারাগার”, যা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল। ছবিতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয় ব্যাপকভাবে।
তিনি অভিনয় করেছেন আরও কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিতে, যার মধ্যে রয়েছে:
- • আগুনের পরশমণি (পরিচালনা: হুমায়ূন আহমেদ)
- • দুই দুয়ারী
- • চন্দ্রকথা
- • থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার (পরিচালনা: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী)
- • আয়নাবাজি (একটি ক্যামিও চরিত্রে)
তার চলচ্চিত্রে অভিনয় ছিল সংযত, সংবেদনশীল এবং বাস্তব। মায়ের চরিত্রে, শিক্ষিকার ভূমিকায় কিংবা একজন প্রজ্ঞাবান পরিণত নারীর চরিত্রে—প্রতিটি রূপেই তিনি ছিলেন প্রাণবন্ত।
পুরস্কার ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
ডলি জহুর তার অভিনয় জীবনে বহু সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৮ সালে বাংলা একাডেমি থেকে নাট্যকলায় অবদানের জন্য সম্মাননা পান। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন—
- • জাতীয় টেলিভিশন পুরস্কার
- • বাচসাস পুরস্কার
- • নাট্যকার পরিষদ সম্মাননা
আন্তর্জাতিকভাবে তিনি যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ভারত ও কানাডায় অনুষ্ঠিত নাট্যোৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মঞ্চে তার পারফরম্যান্স দেখে বিদেশি দর্শকরাও হয়েছেন অভিভূত।
সাম্প্রতিক কাজ ও বর্তমান ব্যস্ততা
সত্তরের দশকের শেষ থেকে আজ পর্যন্ত ডলি জহুর অভিনয়ে সক্রিয় আছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও তিনি টেলিভিশন নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ২০২২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “অ্যাডভেঞ্চার অব সুন্দরবন” নামক শিশুতোষ চলচ্চিত্রে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন।
এছাড়াও তাকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা যায়, বিশেষ করে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতা ও বয়স্ক নাগরিকদের জীবনমান নিয়ে। তরুণ পরিচালকদের নাটক ও ওয়েব সিরিজেও তিনি অংশ নিচ্ছেন এবং তরুণদের পেশাদার গাইডেন্স দিচ্ছেন।
সম্প্রতি তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, “অভিনয় আমার শ্বাসের মতো। যতদিন পারি, এই জগতেই থাকতে চাই।”
কোন মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়?
যদিও ডলি জহুরের অভিনয় শুরু হয়েছিল মঞ্চ দিয়ে, কিন্তু তিনি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছেন টেলিভিশন নাটকের মাধ্যমে। ১৯৮০ ও ৯০-এর দশকে বিটিভির স্বর্ণযুগে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান নারী মুখ। তার কণ্ঠস্বর, সংলাপ বলার ভঙ্গি এবং চরিত্রে একীভূত হওয়ার দক্ষতা তাকে দিয়েছে দীর্ঘস্থায়ী খ্যাতি।
ডলি জহুরের উত্তরাধিকার
বর্তমানেও নাটক, সিনেমা এবং মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনচিত্রে তাকে দেখা যায়। তরুণ প্রজন্মের অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করে তিনি তাদের মধ্যে পেশাদারিত্বের শিক্ষা দিচ্ছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন—“ভালো অভিনয়ের জন্য আগে মানুষ হতে হয়।”
ডলি জহুর শুধু একজন অভিনেত্রী নন, তিনি একজন প্রেরণাদায়ী শিল্পী, যিনি জীবনের নানা ধাপে সংগ্রাম করে, শিল্পকে ভালোবেসে, নিজের স্বকীয় অবস্থান গড়ে তুলেছেন। মঞ্চ থেকে টেলিভিশন—তার প্রতিটি পদক্ষেপই ছিল নিখুঁত, শক্তিশালী ও স্মরণীয়। আজকের নাট্যাঙ্গনে তার অবদান নিঃসন্দেহে এক অনন্য শিক্ষণীয় অধ্যায়।