বাংলাদেশ ক্রিকেটের সেরা রাতগুলোর একটি
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে অনেক ম্যাচ আছে যেগুলো আজও স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। তবে ২০১৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে (MCG) আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ ম্যাচটি নিঃসন্দেহে একটি অনন্য উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে। আর এই জয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের পোস্টারবয়—সাকিব আল হাসান। এই ম্যাচে সাকিব ব্যাটে ও বলে সমান দক্ষতায় খেলেন এবং প্রমাণ করেন কেন তিনি বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন।
ম্যাচের পটভূমিঃ নতুন চ্যালেঞ্জ, নতুন প্রতিপক্ষ
২০১৫ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশ তাদের প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি হয়েছিল আফগানিস্তানের। এটি ছিল বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ এবং আফগানিস্তান তখন সদ্য ওয়ানডে স্ট্যাটাস পাওয়া একটি উদীয়মান দল। তবে ২০১৪ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের কাছে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ শিবিরে ছিল উত্তেজনা ও প্রতিশোধের স্পৃহা। সবার চোখ ছিল দলের অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ওপর—বিশেষ করে সাকিব আল হাসানের ওপর।
ব্যাট হাতে সাকিবের নির্ভরযোগ্য ইনিংস
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে ধাক্কা খায়। স্কোরবোর্ডে মাত্র ১১৯ রানে ৪ উইকেট পড়ে যায়। তখন উইকেটে আসেন সাকিব আল হাসান। পরিস্থিতি ছিল চাপে ভরা, কিন্তু সাকিব একদমই বিচলিত ছিলেন না। ধীরে ধীরে ইনিংস গুছিয়ে নেন এবং মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ১১৪ রানের অনবদ্য জুটি গড়ে তোলেন।
সাকিব খেলেন ৫৭ রানের গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস মাত্র ৬৪ বলে, যাতে ছিল ৬টি চারে সমৃদ্ধ। এই ইনিংসটি বাংলাদেশের স্কোরকে ২৬৭ রানে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে, যা তখন আফগানিস্তানের মতো দলের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য ছিল।
বল হাতে সাকিবের ধারালো আক্রমণ
সাকিব ব্যাটে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের পর বল হাতে আরও বিধ্বংসী হয়ে উঠেন। আফগানিস্তান ইনিংসের শুরুতেই রুবেল হোসেন ও মাশরাফির আঘাতে প্রতিপক্ষ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এরপর সাকিবের ঘূর্ণিতে ধ্বংস হয়ে যায় মিডল অর্ডার।
সাকিব ৮.১ ওভারে ১ মেডেনসহ ৪৩ রান দিয়ে ২টি উইকেট নেন। তার বল হাতে এই সফলতাই নিশ্চিত করে দেন যে আফগানিস্তান কখনোই ম্যাচে ফিরতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান গুটিয়ে যায় মাত্র ১৬২ রানে।
ম্যাচের ফলাফল ও সাকিবের স্বীকৃতি
বাংলাদেশ জয় পায় ১০৫ রানের বিশাল ব্যবধানে। এটি ছিল বাংলাদেশ বিশ্বকাপ ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জয়গুলোর একটি। এই ম্যাচেই সাকিব অর্জন করেন ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ খেতাব।
এই পারফরম্যান্স শুধু একটি ম্যাচ জয়ের গল্প নয়, বরং এটি ছিল আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার মুহূর্ত, বিশ্বমঞ্চে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠার সময়। সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্য বাংলাদেশকে এগিয়ে দেয় এক নতুন দিগন্তে।
পরবর্তী প্রভাব ও ওই ম্যাচের তাৎপর্য
এই ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ মিশনের শুরু। এরপর স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল। যা ছিল প্রথমবারের মতো। এই টুর্নামেন্টে সাকিব ছিলেন ধারাবাহিক, এবং আফগানিস্তানের বিপক্ষে সেই প্রথম ম্যাচে তিনি যে আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তা দেখান, তা পুরো দলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
সাকিব প্রমাণ করেছিলেন তিনি কেবল একজন অলরাউন্ডার নন, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেটের চালিকাশক্তি। এই পারফরম্যান্স তাঁর ক্যারিয়ারের অন্যতম উজ্জ্বল মাইলফলক হয়ে রইল।
সাকিব মানেই নির্ভরতার প্রতীক
মেলবোর্নের সেই রাত আজও বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে গেঁথে আছে। কারণ এটি কেবল একটি জয় ছিল না, এটি ছিল আত্মমর্যাদার পুনর্জাগরণ। সাকিব আল হাসানের অসাধারণ ব্যাটিং ও বোলিং সেদিন প্রমাণ করেছিল—যত কঠিন হোক পরিস্থিতি, সাকিব থাকলে আশা থাকে।